Logo
Logo
×

বাতায়ন

‘তোমার যুদ্ধ আর আমার যুদ্ধ এক নয়’

Icon

ড. আবু এন এম ওয়াহিদ

প্রকাশ: ১৫ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

১৯৯০ সালের কথা। তখন আমি চার্লসটনে ইস্টার্ন ইলিনয় ইউনিভার্সিটিতে পড়াই। ওই বছরের মাঝামাঝিতে সাদ্দাম হোসেন কুয়েত দখল করে ইরাকের অঙ্গীভূত করেছেন। বুশ (সিনিয়র) প্রশাসন ইরাককে কুয়েত ছেড়ে আসার আলটিমেটাম দিচ্ছেন। তর্জন-গর্জন করছেন। যুদ্ধের দামামা বাজাচ্ছেন। আর ইরাকিরা চারদিকে ট্রেঞ্চ খুঁড়ে ডিফেন্সিভ পজিশন নিচ্ছেন। সোশ্যাল পার্টিতে গেলে ‘গাল্ফ-ক্রাইসিস’, গল্প-আড্ডার প্রধান বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে। এমনই একদিন এক গল্পের আসরে ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমার এক সহকর্মীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। গান্ধীবাদী দর্শনে বিশ্বাসী ড. সুহৃদ দে আলোচনার একপর্যায়ে বললেন, ‘No war is holy,’ অর্থাৎ ‘কোনো যুদ্ধই পুণ্যময় বা পূতপবিত্র নয়’। তিনি আরও বললেন, ‘মানুষে মানুষে এমন কোনো সমস্যা থাকতে পারে না, যা আলোচনার মাধ্যমে মিটমাট করা যায় না। যুদ্ধ মানেই ধ্বংস। যুদ্ধ মানেই মৃত্যু। যুদ্ধ মানেই অমঙ্গল। এর কোনো ভালো দিক নেই।’

তার কথা শুনে আমি বেশ অভিভূত হলাম। তাৎক্ষণিক কিছু বলতে পারলাম না। তবে মনে হলো-কথাটার মধ্যে কোথায় যেন একটা ফাঁক আছে, অথচ আমি ধরতে পারছি না। যুদ্ধ সম্বন্ধে আরও অনেক কথা আছে, যার কিছুটা আমি জানি। কিছু আবার জানিও না। যেমন, ‘তর্ক না করে যদি তর্কে জেতা যায়, যুদ্ধ না করে কেন যুদ্ধে জেতা যায় না?’ ‘যুদ্ধ এতই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা কেবল জেনারেলদের হাতে ছেড়ে দেওয়া যায় না।’ ‘রাজনৈতিক সমস্যা রাজনীতি দিয়ে মোকাবিলা করতে হয়, অস্ত্র দিয়ে নয়।’ ‘যুদ্ধের বিভীষিকা যোদ্ধার চেয়ে আর কেউ ভালো করে জানে না।’ ‘যুদ্ধে যারা জিতে, তাদের মতো করেই তারা ইতিহাস লিখে।’ ‘যুদ্ধ হলো সশস্ত্র রাজনীতি, আর রাজনীতি হলো নিরস্ত্র যুদ্ধ।’ ‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।’ ইত্যাদি।

পৃথিবীর আদিকাল থেকে যত যুদ্ধবিগ্রহ হয়েছে, জানমালের ক্ষয়ক্ষতির দিক থেকে ভিয়েতনাম যুদ্ধ তাদের অন্যতম। নতুন প্রজন্মের অবগতির জন্য এ যুদ্ধের একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তুলে ধরছি। ভিয়েতনাম যুদ্ধ ‘কোল্ড ওয়ার’ যুগের একটি মারাত্মক সামরিক সংঘাত, যা সংঘটিত হয়েছিল ভিয়েতনাম, লাওস ও কম্বোডিয়ার সবুজ জমিনের বুকে। এ যুদ্ধ শুরু হয় ১৯৫৫ সালের ১ নভেম্বর এবং দীর্ঘ ২০ বছর পর শেষ হয় ১৯৭৫ সালের ৩০ এপ্রিল। মূল সংঘাতের একদিকে ছিল ভিয়েত কং গেরিলারা এবং অন্যদিকে ছিল যুক্তরাষ্ট্র। ভিয়েত কংরা উত্তর ভিয়েতনামের সঙ্গে দক্ষিণ ভিয়েতনামকে একীভূত করে একটি কমিউনিস্ট রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছিল। আমেরিকা সে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এ দক্ষিণ ভিয়েতনামে কমিউনিস্টদের অগ্রযাত্রা রুখে দেওয়ার তাগিদে। অবশেষে পরাজয়ের মুকুট মাথায় নিয়ে মার্কিনিরা যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। ভিয়েতনামের পক্ষে আত্মাহুতি দেয় ২০ থেকে ৩০ লাখ নিরীহ মানুষ এবং আমেরিকা হারায় ৫৮ হাজার ২২২ জন মিলিটারি ও প্যারামিলিটারি বাহিনীর সদস্য। আর খরচ করে শত শত বিলিয়ন ডলার।

এ যুদ্ধের মূল হোতা ছিলেন প্রেসিডেন্ট কেনেডি এবং জনসনের দুর্ধর্ষ সমরমন্ত্রী রবার্ট ম্যাক্নামারা। ষাটের দশকের গোড়ার দিকে তিনিই ওই যুদ্ধকে ধাপে ধাপে তীব্র থেকে তীব্রতর করে ইন্দোচীনকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করেছিলেন। যুদ্ধ সম্বন্ধে তো অনেক কথা শুনলাম, এবার দেখা যাক যুদ্ধবাজ ম্যাক্নামারা যুদ্ধ বিষয়ে কী কথা বলেন। ১৯৯৫ সালের কথা। ততদিনে আমি ইলিনয়ের চার্লস্টন থেকে আমেরিকার লোকসংগীতের রাজধানী ন্যাশভিলে, টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে চলে এসেছি। এপ্রিল-মে মাসের দিকে একদিন কোনো এক টিভি চ্যানেলের টকশোতে দেখি ম্যাক্নামারা হাজির। তখন তিনি বৃদ্ধ। বয়স ৭৯। গোটা ইন্টারভিউয়ে ভিয়েতনাম যুদ্ধের কথাই আলোচনা হচ্ছে। আগে কখনো তার এমন বোধোদয় হয়েছিল কি না জানি না, তবে সেদিন তিনি বিভীষিকার বর্ণনা দিয়ে এর মূল দায়ভার অকপটে নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। কথা বলতে বলতে একপর্যায়ে তিনি অপরাধবোধে ভীষণভাবে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলেন। অনেকক্ষণ কাঁদলেন। একটু পরে আমি টের পেলাম, মনের অজান্তে আমারও চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে নোনা পানি।

‘No war is holy.’ কথাটার গোমর ধরা হলো না। আমার মনের খটকা মনেই রয়ে গেল। ২০০৯ সাল। ম্যাক্নামারা মারা গেলেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধ ইতিহাস হয়ে গেল। সবার চেতনায় হয়তো বা বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যেতে লাগল। খোদ ভিয়েতনামবাসীও যুদ্ধকে পেছনে ফেলে যুদ্ধের ধ্বংসের ওপর নতুন নতুন সৃষ্টির উল্লাসে আরেক নতুন যুদ্ধে মাতোয়ারা হয়ে উঠল। দুই ভিয়েতনাম এক হয়ে তরতর করে শনৈ শনৈ উন্নতির দিকে ধাপে ধাপে এগিয়ে যেতে লাগল। বাংলাদেশের পরে মুক্ত হয়ে তারা আমাদের চেয়ে এগিয়ে গেছে। তাদের একতা, দেশপ্রেম ও শৃঙ্খলাবোধ রীতিমতো ঈর্ষণীয়। সাম্প্রতিক সময়ে ‘কোভিড-১৯’-কে তারা কীভাবে মোকাবিলা করেছে, সে খবর তো আপনারা সবাই জানেন। আগামীতে এ সংগ্রামী দেশ ও জাতির ওপর আরেকটি রচনা লেখার ইচ্ছা আছে। এর মাঝে আমি সুহৃদ বাবুর রহস্যময় বক্তব্যের কথা ভুলে যাইনি। আমি আমার প্রশ্নের জবাব নিরন্তর খুঁজতে থাকলাম। হঠাৎ সেদিন পেয়েও গেলাম। পাঠকরা এবার শুনুন কীভাবে রহস্যের উদ্ঘাটন হলো এবং ফাঁকটাই বা কোথায়?

স্মৃতি যদি আমার সঙ্গে প্রতারণা না করে, তাহলে ২০১৫ সালের জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে আমেরিকার পিবিএসের (পাবলিক ব্রডকাস্টিং করপোরেশন) তৎকালীন জনপ্রিয় টকশো হোস্ট ‘বিল মোয়ার’ সেদিন তার স্টুডিওতে এনেছিলেন এক ভিয়েতনাম ভেটারানকে। অনুষ্ঠানটি আমি যেহেতু শুরু থেকে দেখতে ও শুনতে পারিনি, তাই অতিথির নামটা জানা হয়নি। তিনি ভিয়েতনাম যুদ্ধে তার লোমহর্ষক প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিচ্ছিলেন। তিনি বলছেন, ১৯৬৮-৬৯-এর কথা। তখন তার বয়স মাত্র ১৮ বা ১৯। ছোটবেলা মা-বাবার সঙ্গে চার্চে গিয়ে শিখেছেন ‘টেন কমান্ডম্যান্ট্স’-এর কথা। ওল্ড টেস্টামেন্টে লেখা আছে, ‘Thou shall not kill.’ তারপর এ কচি বয়সে তাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে অস্ত্র হাতে তুলে দেওয়া হলো। বলা হলো, ভিয়েতনাম যাও। আপন দেশের জন্য যত পারো শত্রুকে নিধন করো। তারা ঠিকই যুদ্ধে গেল। বুঝে নিল। মারতে হবে নয়তো মরতে হবে। শত্রু কে? কীভাবে সে তার শত্রু হলো? কেন তাকে মারতে হবে? অথবা শত্রুর হাতে কেন মরতে হবে? এসব প্রশ্ন তখন তার ছোকরা মনকে কোনোভাবে নাড়া দিতে পারেনি। উত্তর খোঁজার তো প্রশ্নই ওঠে না।

যুদ্ধের মাঠে তিনি নিরপরাধ মানুষসহ ডজন দুই ভিয়েতনামিকে নিজ হাতে খুন করেছেন। তার মধ্যে একদিনকার যুদ্ধের বিবরণ দিলেন এভাবে-এনকাউন্টারের একপর্যায়ে তিনি বন্দুক হাতে সাথিহারা হয়ে একেবারে একা অবস্থান নিয়েছেন ভিয়েতনামের কোনো এক গহিন জঙ্গলে। হঠাৎ দেখতে পেলেন, মাত্র কয়েক ফুট দূরে গ্রেনেড হাতে সাক্ষাৎ যম তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। অল্পবয়সি ভিয়েত কং গেরিলা। তিনি আফসোস করছেন, ভিয়েতনামি ভাষা জানেন না। জানলে এখন জানটা হয়তো বাঁচাতে পারতেন। তিনি পজিশন নিয়ে ইংরেজিতে বললেন, ‘Don't throw grenade, I will pull the trigger.’ অর্থাৎ, ‘গ্রেনেড ছুড়ো না, আমি কিন্তু গুলি করব’। ওই দুঃসময়ে তিনি মনে মনে ভাবলেন, ‘এটি তো যুদ্ধ, হয় তুমি আমাকে মারবে, নয় তো আমি তোমাকে মারব। জীবনের চরম ও পরম মুহূর্তে আমাদের দুজনের অবস্থা সমান সমান। হয় আমি বাঁচব, নয়তো তুমি বাঁচবে।’ ভাবতে ভাবতে তিনি আবার বললেন, ‘Don't throw, I will pull the trigger.’

ভিয়েত কং গেরিলা তার কথা বুঝল কি না আমেরিকান সৈনিকের বোঝার কোনো উপায় নেই। এর মধ্যে সে গ্রেনেড ছুড়ে মারল, তিনি গুলি করলেন। গেরিলা টার্গেট মিস করল, তিনি টার্গেট হিট করলেন। ছেলেটি গুলি খেয়ে তার চোখের সামনে ছটফট করে মরে গেল। সেদিনকার এনকাউন্টার এখানেই শেষ। তারপর যুদ্ধ থামল। সবার সঙ্গে তিনি ‘ভিয়েতনাম ভেটারান’ হয়ে দেশে ফিরে এলেন।

কয়েক বছর পরের কথা। একদিন রাতের বেলা তিনি একা গাড়ি চালাচ্ছেন ‘ওরিগন’ অঙ্গরাজ্যে। ঘুটঘুটে অন্ধকার। নির্জন রাস্তা। দুদিকে ঘন জঙ্গল। হঠাৎ তার হেলোসিনেশন হলো। তিনি দেখতে পেলেন, তার গাড়ির উইন্ডশিল্ডে গ্রেনেড হাতে দাঁড়িয়ে আছে সেই ছেলেটি। সেই ভিয়েত কং গেরিলা, যাকে তিনি অনেক বছর আগে ভিয়েতনামের জঙ্গলে গুলি করে বধ করে এসেছেন। চোখ বড় বড় করে গেরিলা ছেলেটি তার দিকে তাকাচ্ছে এবং বলছে, ‘তোমার সঙ্গে আমার যুদ্ধ সমানে সমান ছিল না। তোমার যুদ্ধ আর আমার যুদ্ধ একও ছিল না। তুমি ছিলে আমার দেশে ইন্ভেডার (দখলদারি) আর আমি ছিলাম ডিফেন্ডার (আত্মরক্ষাকারী)। তোমার যুদ্ধের কোনো নৈতিক ভিত্তি ছিল না। আমার যুদ্ধের নৈতিক ভিত্তি ছিল শক্তপোক্ত। মজবুত। তোমার যুদ্ধ আর আমার যুদ্ধ এক ছিল না। কক্ষনো না। কক্ষনো না।’

সুহৃদদের ‘No war is holy,’ কথাটার গোমর ফাঁস হলো। আমার রহস্যের উদ্ঘাটন হলো। বুঝলাম, ইন্ভেডারের যুদ্ধ আনহোলি, অন্যায় ও অপরাধ। ডিফেন্ডারের যুদ্ধ ‘হোলি’, ন্যায়সংগত ও পূতপবিত্র!

ড. আবু এন এম ওয়াহিদ : অধ্যাপক, টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র

wahid2569@gmail.com

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম