নিউইয়র্কের চিঠি
সিটি মেয়র নির্বাচনে মামদানির পক্ষে বাংলাদেশিরা
আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু
প্রকাশ: ০১ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
আগামী ৪ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হবে যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম সিটি নিউইয়র্কের ১১১তম মেয়র নির্বাচন। এ নির্বাচন ঘিরে ইতোমধ্যে প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের তৎপরতা জোরদার হয়েছে। প্রধান প্রধান মেয়র প্রার্থীর পক্ষে জোর প্রচার চলছে সিটির প্রতিটি এলাকায়। নিউইয়র্কের বাংলাদেশি কমিউনিটির যারা আমেরিকার মূলধারার রাজনীতিতে সক্রিয় ও সচেতন, তারাও মেয়র নির্বাচনে তাদের পক্ষ থেকে যথাসাধ্য ভূমিকা রাখছেন। কারণ এবারের সিটি মেয়র নির্বাচনে প্রধান তিন প্রার্থীর মধ্যে কোনো কোনো জরিপে এগিয়ে আছেন উগান্ডায় জন্মগ্রহণকারী ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকান জোহরান মামদানি। সিটির শীর্ষপদে ডেমোক্রেটিক পার্টির মনোনয়ন লাভের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ তিনিই প্রথম মুসলিম। জোহরান মামদানি বর্তমানে নিউইয়র্ক স্টেট অ্যাসেম্বলির একজন সদস্য। সিটির বাংলাদেশি, ভারতীয় ও পাকিস্তানি অধ্যুষিত এলাকাগুলো মামদানির প্রচারণায় মুখর।
বর্তমান মেয়র, অর্থাৎ সিটির ১১০তম মেয়র এরিক অ্যাডামস পুনঃনির্বাচনের জন্য প্রার্থী হতে যাচ্ছেন। সিটির ৩৬০ বছরের মেয়রের তালিকায় এরিক অ্যাডামস দ্বিতীয় কৃষ্ণাঙ্গ মেয়র, যিনি ২০২১ সালে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী হিসাবে নির্বাচিত হন। প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ মেয়র ছিলেন ডেভিড নরম্যান ডিনকিনস, যিনি সিটির ১০৬তম মেয়র হিসাবে ১৯৯০ থেকে ১৯৯৩ মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমান মেয়র এরিক অ্যাডামসের বিরুদ্ধে ২০২৪ সালে অর্থ আত্মসাৎ, ঘুস গ্রহণ, নির্বাচনি প্রচারণা পরিচালনার বিদেশি নাগরিকের কাছে অবৈধভাবে তহবিল সংগ্রহসহ পাঁচটি ফৌজদারি অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় এফবিআই’র তদন্তের মুখোমুখি হন। তার কয়েকজন সহকারীর ফোন, ল্যাপটপ ও অন্যান্য আলামত জব্দ করা হয়। সিটি প্রশাসনের একজনকে গ্রেফতার করা হয় এবং সিটির পুলিশপ্রধানসহ কয়েকজন পদত্যাগে বাধ্য হন। স্থানীয় সরকার কাঠামোর নির্বাচিত প্রতিনিধির বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ উঠলে স্টেট গভর্নর তার ক্ষমতাবলে অভিযুক্তকে ৩০ দিনের জন্য সাসপেন্ড করতে পারেন। কিন্তু মেয়র এরিকের বিরুদ্ধে স্টেট গভর্নর তা না করলেও প্রশাসন থেকেই মেয়রের পদত্যাগের দাবি ওঠে। ডেমোক্রেট হওয়া সত্ত্বেও মেয়র অ্যাডামস প্রেসিডেন্ট বাইডেনের নমনীয় ইমিগ্রেশন নীতির কঠোর সমালোচনা করে ডেমোক্রেটদের বিরাগভাজন হন। ২০২৪-এর সেপ্টেম্বরে মেয়রের বিরুদ্ধে ফেডারেল আদালতে অভিযোগ দায়ের করা হয়। বেশ বেকায়দায় পড়েন তিনি। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর মেয়র অ্যাডামস তার সঙ্গে একাধিকবার সাক্ষাৎ করেন। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ফেডারেল ডিপার্টমেন্ট অয জাস্টিস তার বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগ থেকে তাকে অব্যাহতি দেয়। এরিক অ্যাডামস ডেমোক্রেটিক পার্টির আস্থা হারিয়েছেন। পুনঃনির্বাচনের জন্য তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন।
নিউইয়র্ক স্টেটের সাবেক জনপ্রিয় ডেমোক্রেট গভর্নর অ্যান্ড্রু ক্যুমো, যিনি যৌন কেলেঙ্কারির অভিযোগে ২০২১ সালে তার পদ থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন, তার বিরুদ্ধে তারই অফিসের এগারো জন নারী সহকারী যৌন হয়রানিসহ বিভিন্ন ধরনের হয়রানির অভিযোগ এনেছিলেন। যদিও তিনি অভিযোগগুলো অস্বীকার করেছেন, তবুও তদন্ত শুরু হওয়ার আগেই তিনি পদত্যাগ করেন। তার পিতা মারিও ক্যুমোও এক সময় নিউইয়র্ক স্টেটের গভর্নর হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। অ্যান্ড্রু ক্যুমো এখন নিউইয়র্ক সিটি মেয়র পদে একজন শক্তিশালী প্রার্থী হিসাবে আবির্ভূত হয়েছেন। ক্যুমো তার প্রার্থিতা ঘোষণা করায় মেয়র এরিকের পুনঃনির্বাচিত হওয়ার সুযোগ কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। কারণ চলমান জরিপগুলোতে ক্যুমোর অবস্থান এরিকের ওপরে।
প্রাইমারি নির্বাচনের এক মাস আগে অর্থাৎ মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে পরিচালিত একটি সংস্থার জরিপ রিপোর্ট অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত সিটির ভোটারদের মধ্যে ডেমোক্রেটিক পার্টির মনোনয়ন প্রত্যাশী স্টেট অ্যাসেম্বলিম্যান জোহরান মামদানির পক্ষে সমর্থন ছিল ৪৪ শতাংশ, স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু ক্যুমোর পক্ষে সমর্থন ৪২ শতাংশ এবং মেয়র পদে পুনঃনির্বাচিত হতে প্রত্যাশী বর্তমান ডেমোক্রেট মেয়র স্বতন্ত্র প্রার্থী এরিক অ্যাডামসের পক্ষে সমর্থন মাত্র ১৪ শতাংশ। কিন্তু এর আগের মাসে ‘এমারসন কলেজ পোলিং পিক্স১১ ও দ্য হিল’-এর জরিপে সিটি মেয়র পদে অ্যান্ড্রু ক্যুমো ছিলেন ভোটারদের সবচেয়ে পছন্দের প্রার্থী। তার পক্ষে জরিপে অংশগ্রহণকারী ভোটারদের ৩৫ শতাংশের সমর্থন ছিল। দ্বিতীয় পছন্দে ছিলেন জোহরান মামদানি, তার পক্ষে ২৩ শতাংশ ভোটারের সমর্থন ছিল। অন্যান্য ডেমোক্রেট প্রার্থীর মধ্যে নিউইয়র্ক সিটির কম্পট্রোলার ব্র্যাড ল্যান্ডারও একজন গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থী, যিনি জরিপে ১১ শতাংশ ভোট পেয়ে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছেন। এদিকে ২০২১ সালে সিটিতে চালুকৃত ‘র্যাংকড চয়েস ভোটিং’ (আরসিভি) ব্যবস্থায় ক্যুমোর ভোট ৫৪ শতাংশ এবং মামদানির ৪৬ শতাংশ। ধরেই নেওয়া যায়, এ দুই ডেমোক্রেট প্রার্থীর মধ্যেই প্রাইমারি নির্বাচনের মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা সীমাবদ্ধ থাকবে, এবং তাদের মধ্যেই একজন মেয়র নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টির মনোনয়ন লাভ করবেন।
২০২৪ সালের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী নিউইয়র্ক সিটির বর্তমান জনসংখ্যা ৮০ লাখ ৯৭ হাজার। এর মধ্যে শ্বেতাঙ্গ জনসংখ্যা সিটির মোট জনসংখ্যার ৩৭.৪৭ শতাংশ; কৃষ্ণাঙ্গ বা আফ্রিকান আমেরিকান জনসংখ্যা ২৩.১ শতাংশ; অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর জনসংখ্যা ১৫.৩৮ শতাংশ; এশিয়ান ১৪.৪৭ শতাংশ এবং অন্যান্য ৯.৫৭ শতাংশ। সিটি অধিবাসীদের মধ্যে ৬৩.৬৬ শতাংশের জন্ম যুক্তরাষ্ট্রে। ন্যাচারালাইজড সিটিজেন, যারা ভোটার, তাদের সবচেয়ে বড় অংশ ল্যাটিন আমেরিকান দেশগুলো থেকে আগত। নিউইয়র্ক সিটিতে বসবাসকারী বাংলাদেশির মধ্যে ন্যাচারালাইজড আমেরিকান সিটিজেন সংখ্যা সম্পর্কে সঠিক কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও কোনো নির্বাচনি প্রচারণা অভিযানে বৈধ-অবৈধ নির্বিশেষে সব বাংলাদেশি আগ্রহের সঙ্গে অংশগ্রহণ করেন।
আমেরিকান নির্বাচনগুলোর নেতিবাচক দিক হচ্ছে, ভোটারদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের ভোট প্রদানে অনীহা। শুধু তাই নয়, জন্মসূত্রে হোক বা ন্যাচারালাইজড সিটিজেন হোক, তাদের একটি বড় অংশ ভোটার হতেও আগ্রহ পোষণ করেন না। এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী নিউইয়র্ক সিটিতে বর্তমানে সক্রিয় ভোটার সংখ্যা ৪৭ লাখ। মোট ভোটারের মধ্যে ৩১ লাখ রেজিস্ট্রার্ড ডেমোক্রেট ভোটার। নিউইয়র্ক প্রচলিতভাবেই একটি ডেমোক্রেট স্টেট এবং নিউইয়র্ক সিটিও একইভাবে ডেমোক্রেট নিয়ন্ত্রিত। সে জন্য নিউইয়র্ক সিটিতে রেজিস্ট্রার্ড রিপাবলিকান ভোটার সংখ্যা মাত্র ৫ লাখ ২৩ হাজার। কোনো দলের রেজিস্ট্রার্ড ভোটার নয় এমন ভোটার সংখ্যা আনুমানিক ১০ লাখ। অর্থাৎ সিটির ভোটারদের দুই-তৃতীয়াংশ ডেমোক্রেট ভোটার, প্রায় ১১ শতাংশ রিপাবলিকান ভোটার এবং প্রায় ২১ শতাংশ স্বতন্ত্র ভোটার। প্রাইমারি নির্বাচনে কোনো ভোটারকে তিনি যে দলের রেজিস্ট্রার্ড ভোটার, সেই দলের প্রার্থীকেই ভোট প্রদান করতে হবে। কোনো রেজিস্ট্রার্ড ডেমোক্রেট ভোটার প্রাইমারিতে কোনো রিপাবিলিকান প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবেন না। তাহলে তার ভোট কোনো প্রার্থীর পক্ষে গণনা করা হবে না। তবে যেদিন সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, অর্থাৎ এবার মেয়র নির্বাচনের দিন আগামী ৪ নভেম্বর তারিখে যে কোনো দলের রেজিস্ট্রার্ড ভোটার অন্য দলের প্রার্থীকেও ভোট দিতে পারবেন।
নিউইয়র্ক বোর্ড অফ ইলেকশনসের চিত্র অনুযায়ী, সিটিতে নিকট অতীতে অনুষ্ঠিত যে কোনো নির্বাচন, তা সাধারণ নির্বাচন বা ভোট প্রদানের দিবসে হোক, অথবা আগাম ভোট ও ডাকযোগে প্রেরিত ভোট হোক, যে কোনো নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের চূড়ান্ত গণনা অনুযায়ী মোট ভোটার সংখ্যার এক-তৃতীয়াংশের কমসংখ্যক ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। সে হিসাবে যারা মেয়র, পাবলিক অ্যাডভোকেট, কম্পট্রোলার, বরো প্রেসিডেন্ট অথবা সিটি কাউন্সিল সদস্য হিসাবে নির্বাচিত হন, তারা মূলত সংখ্যালঘু ভোটারদের ভোটে নির্বাচিত হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন। সকাল ৬টা থেকে শুরু হয়ে রাত ৯টা পর্যন্ত মোট ১৫ ঘণ্টা ভোটকেন্দ্রে হাজির হয়ে ভোট প্রদানের সুযোগ থাকলেও বেশিরভাগ ভোটার ভোট দিতে যান না। ২০১৩ সালে মেয়র নির্বাচনে ৪২ লাখ ভোটারের মধ্যে ১১ লাখ; ২০১৭ সালে ৪৫ লাখ ভোটারের মধ্যে ১১ লাখ ৪৮ হাজার; ২০২১ সালে ৪৯ লাখ ভোটারের মধ্যে ১১ লাখ ২০ হাজার ভোটার ভোট প্রদান করেছেন।
সিটি মেয়র পদে আগামী ২৪ জুন ডেমোক্রেটিক প্রাইমারিতে যিনি নির্বাচিত হবেন, তিনিই যে আগামী ৪ নভেম্বর অনুষ্ঠেয় মেয়র নির্বাচনে বিজয় লাভ করবেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ তার প্রতিদ্বন্দ্বী রিপাবলিকান প্রার্থী কার্টিস সিলওয়ার প্রার্থিতা কেবল তার দলের পক্ষ থেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের রীতি রক্ষার জন্য।
এখন পর্যন্ত ডেমোক্রেটিক প্রাইমারির ভোটের গতিপ্রকৃতি অনুযায়ী, সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু ক্যুমো এবং অ্যাসেম্বলিম্যান জোহরান মামদানির মধ্যে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। এ দুই শক্তিশালী প্রার্থীরই তাদের নিজস্ব ভোট ব্যাংক রয়েছে। ক্যুমো শ্বেতাঙ্গ হলেও কৃষ্ণাঙ্গ ভোটারদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের সমর্থন রয়েছে তার প্রতি। একটি হিসাবে দেখানো হয়েছে, পঞ্চাশোর্ধ কৃষ্ণাঙ্গ ভোটারদের মধ্যে ক্যুমোর জনপ্রিয়তা অধিক। তাদের ৭৪ শতাংশ ক্যুমোর সমর্থক। অন্যদিকে পঞ্চাশ বছর বয়সের নিচে কৃষ্ণাঙ্গ ভোটারদের ৬১ শতাংশ জোহরান মামদানির সমর্থক এবং লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, কলেজ শিক্ষিত কৃষ্ণাঙ্গ ভোটারদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ মামদানির সমর্থক। দুই প্রার্থীর বয়সও একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। ক্যুমোর বয়স ৬৭ বছর; মামদানি বয়সে তরুণ, মাত্র ৩৩ বছর। গাজায় ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরাইলি ধ্বংসযজ্ঞে সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সমর্থন এবং যুদ্ধ চলাকালে ইসরাইলে তার সফরকে ভালোভাবে গ্রহণ করেনি আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ মুসলিমসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আগত ন্যাচারালাইজড আমেরিকান সিটিজেনরা। সে জন্য মামদানির পক্ষে সাধারণভাবে মুসলিম আমেরিকানদের সমর্থন অত্যন্ত দৃঢ়। বাংলাদেশি আমেরিকানসহ মুসলিম আমেরিকানদের অধিকাংশ মামদানির পক্ষে সক্রিয়। ডেমোক্রেটিক প্রাইমারিতে মামদানি জয়লাভ করলে তিনিই হবেন নিউইয়র্ক সিটির ইতিহাসে প্রথম মুসলিম মেয়র।
আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু : যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সিনিয়র সাংবাদিক ও অনুবাদক
