রাজনীতি সাংস্কৃতিক বিকাশকে প্রভাবিত করে?
এম এ হামিদ
প্রকাশ: ০৩ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি: সংগৃহীত
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
মানুষের জীবনধারা, মূল্যবোধ, রীতিনীতি, শিল্প-সাহিত্য প্রভৃতির সমষ্টি হলো সংস্কৃতি। এটি মানুষের সামাজিক জীবনের স্বাভাবিক বিকাশের ফলাফল। রাজনীতি হলো সমাজে ক্ষমতার বণ্টন ও পরিচালনার ব্যবস্থা-কীভাবে শাসন চলবে, কারা নেতৃত্ব দেবে প্রভৃতি। ঐতিহাসিকভাবে দেখলে, সংস্কৃতি আগে এসেছে, রাজনীতি এর পরে। অর্থাৎ, মানুষ যখন গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে বাঁচতে শুরু করে, তখনই ভাষা, শিল্প, ধর্মীয় আচার, গান, নাচ প্রভৃতির জন্ম হয়, যেগুলো সংস্কৃতির উপাদান। রাজনীতি, রাষ্ট্র এবং অর্থনৈতিক কাঠামো এসেছে অনেক পরের বিষয়।
ইসলাম ধর্মের আবির্ভাব সপ্তম শতকে হলেও মুসলিম সমাজে দ্রুত এবং বিস্তৃতভাবে সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছে। মহানবী মুহাম্মদ (সা.)-এর সময় থেকেই কুরআনের বাণীকে কেন্দ্র করে মৌখিক ও লিখিত সাহিত্যের বিকাশ শুরু হয়। অল্প সময়ের মধ্যেই মুসলিমবিশ্ব বিজ্ঞান, স্থাপত্য, সংগীত, সাহিত্য ও চিত্রকলায় অনন্য উচ্চতায় পৌঁছায়। আব্বাসীয় খিলাফতের (৮ম-১৩শ শতক) সময়কে মুসলিম সংস্কৃতির স্বর্ণযুগ বলা হয়। বাগদাদের বাইতুল হিকমা ছিল জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র, যেখানে গ্রিক, পার্সি ও ভারতীয় দর্শন ও বিজ্ঞানের অনুবাদ এবং বিশ্লেষণ চলত। এ সময়েই ফারাবি, আল-ফারাবি, ইবনে সিনা, ওমর খৈয়াম, আল-বেরুনি প্রমুখ মনীষী সংস্কৃতিকে বহু মাত্রায় সমৃদ্ধ করেন। অন্যদিকে, আন্দালুস (বর্তমান স্পেন) ছিল স্থাপত্য ও সংগীতের অন্যতম কেন্দ্র আলহামরা প্রাসাদ ও কর্ডোবার গ্র্যান্ড মসজিদ আজও মুসলিম সংস্কৃতির চমৎকার নিদর্শন। তৎকালীন মুসলিম সমাজে সংস্কৃতি কেবল ধর্মীয় অনুষঙ্গেই আবদ্ধ ছিল না, বরং বিজ্ঞান, শিল্প ও জ্ঞানচর্চাকে একই ধারায় প্রবাহিত করেছিল, যা ছিল এক অভূতপূর্ব মানবিক ঐতিহ্য।
উপমহাদেশে মুসলিম আগমন ঘটে ৮ম শতকে সিন্ধু বিজয়ের মাধ্যমে, তবে সাংস্কৃতিক দিক থেকে এর প্রকৃত বিস্তার ঘটে সুলতানি ও মোগল আমলে। মুসলিম শাসকরা শুধু রাজনৈতিক দিক থেকেই নয়, বরং সাহিত্য, সংগীত, স্থাপত্য ও ভাষার ক্ষেত্রে এক নতুন ধারার সূচনা করেন। ফারসি ও আরবি ভাষা শাসনব্যবস্থার ভাষা হলেও এ অঞ্চলেই গড়ে ওঠে উর্দু, যা হিন্দুস্তানি সংস্কৃতি ও মুসলিম চেতনার এক অনন্য মিশ্রণ। মোগল স্থাপত্য যেমন তাজমহল, লাল কেল্লা, হুমায়ুনের সমাধি-এসবই শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রতীক নয়, বরং নান্দনিকতা, কারুশিল্প ও ধর্মীয় আবেগের সংমিশ্রণ। অপরদিকে, সুফি-সাধকরা যেমন খাজা মইনুদ্দিন চিশতি, নিজামউদ্দিন আউলিয়া এবং বাংলাদেশে খানজাহান আলী ও শাহজালাল প্রমুখ ব্যক্তিত্ব ধর্মীয় চেতনার পাশাপাশি সংগীত, দর্শন ও মানবতাবাদের চর্চা করেন। তাদের দরগাগুলোই হয়ে ওঠে সাংস্কৃতিক মিলনের কেন্দ্র। এছাড়াও মুসলিম সাহিত্যিকদের হাত ধরে ফারসি কাব্যচর্চা, দাস্তান রচনার ধারা এবং পরবর্তীকালে বাংলা ভাষায় মুসলিম রচয়িতাদের অবদান উপমহাদেশীয় সংস্কৃতিকে বহুমাত্রিক করে তোলে। এ সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনই আজকের দক্ষিণ এশিয়ার ঐতিহ্য ও বৈচিত্র্যকে গড়ে তুলেছে।
সভ্যতার শুরু থেকেই সাংস্কৃতিক চর্চা মানুষের জীবনের কেন্দ্রস্থলে ছিল। আদিম সমাজ ছিল গোষ্ঠীকেন্দ্রিক, যেখানে মানুষ একত্রে বসবাস করত এবং পরস্পরের ওপর নির্ভর করত। সেই সময় রাজনৈতিক কাঠামো বা অর্থনৈতিক বিনিময়ের কোনো নির্দিষ্ট রূপ গড়ে ওঠেনি। কিন্তু মানুষ তখনই শুরু করেছিল ভাষার মাধ্যমে ভাব বিনিময়, গুহাচিত্র অঙ্কন, মৃত ব্যক্তিকে কবর দেওয়ার আচার এবং মৌখিক কাহিনি রচনার মতো কর্মকাণ্ড, যা সবই সংস্কৃতির উপাদান। উদাহরণস্বরূপ, ফ্রান্স ও স্পেনের বিভিন্ন গুহাচিত্র প্রমাণ করে যে হাজার হাজার বছর আগে মানুষ জীবজন্তুর ছবি এঁকে নিজেদের অনুভব ও চিন্তা প্রকাশ করত। আবার আফ্রিকার আদিম কবরস্থানে পাওয়া গেছে মৃতদেহের পাশে ফুল ও উপঢৌকন, যা ধর্মীয় বিশ্বাস বা আচার-সংস্কৃতির ইঙ্গিত দেয়।
হরপ্পা বা সিন্ধুসভ্যতা (খ্রিষ্টপূর্ব ২৬০০-১৯০০) ছিল দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রাচীন ও উন্নত নগরসভ্যতা। এ সভ্যতায় সুসংগঠিত নগর পরিকল্পনা, পয়ঃনিষ্কাশনব্যবস্থা এবং স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন পাওয়া যায়, যা সামাজিক সাংগঠনিক কাঠামোর পাশাপাশি সাংস্কৃতিক পরিপক্বতার ইঙ্গিত দেয়। মোহেঞ্জোদারো ও হরপ্পার খননকালে পাওয়া সিলমোহর, মৃৎপাত্রের অলংকরণ, নারীমূর্তি, পশুচিত্র, এবং নৃত্যরত নারীমূর্তি ইত্যাদি সাংস্কৃতিক চর্চার জোরালো সাক্ষ্য বহন করে। এসব নিদর্শন প্রমাণ করে যে হরপ্পার মানুষ শিল্প ও আচার-অনুষ্ঠানের গুরুত্ব অনুধাবন করত, যা স্পষ্টতই রাজনৈতিক কাঠামোর পূর্বে গঠিত এক সাংস্কৃতিক মননচর্চার নিদর্শন।
প্রাচীন গ্রিসে (খ্রিষ্টপূর্ব ৫ম-৪র্থ শতক) নাট্যচর্চা ছিল সাংস্কৃতিক জীবনের অন্যতম কেন্দ্র। দার্শনিক চিন্তাধারা, পৌরাণিক কাহিনি এবং নাগরিক জীবনের দ্বন্দ্ব নাটকের মাধ্যমে প্রকাশ পেত। সক্রেটিস, প্লেটো ও অ্যারিস্টটলের দর্শনের প্রভাব নাট্যকলা ও সাহিত্যেও পড়ে। এস্কাইলাস, সোফোক্লিস ও ইউরিপিডিসের ট্র্যাজেডি নাটকগুলো শুধু বিনোদন নয়, বরং নৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রশ্নের বিশ্লেষণ তুলে ধরে। এতে বোঝা যায়, সংস্কৃতি প্রাচীন গ্রিসের নাগরিক সমাজে চিন্তাচর্চা ও আত্মপরিচয়ের গুরুত্বপূর্ণ বাহন ছিল।
মানুষ যখন প্রথম সমাজবদ্ধ জীবন শুরু করে, তখন থেকেই গান, নৃত্য, ভাষা, ধর্মীয় বিশ্বাস প্রভৃতির মাধ্যমে তারা সাংস্কৃতিক প্রকাশ ঘটায়। এরপর সমাজ বড় ও জটিল হলে সংগঠন, নেতৃত্ব, আইনকানুনের প্রয়োজন হয়; তখন রাজনীতির উদ্ভব ঘটে। কিন্তু আজকের বাস্তবতায় রাজনীতি সাংস্কৃতিক বিকাশকে প্রভাবিত করে আবার সাংস্কৃতি রাজনীতিকেও প্রভাবিত করে। কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন নতুন জাতীয় পরিচয় বা সংস্কৃতি তৈরি করতে পারে যেমন, বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন। আবার সাংস্কৃতিক পরিবর্তনও রাজনীতিকে নতুন পথে নিতে পারে (যেমন: নবজাগরণ বা রেনেসাঁ যুগে ইউরোপে গণতন্ত্রের পথ তৈরি হওয়া)। মানব ইতিহাসে সাংস্কৃতি আগে, তবে বাস্তবতায় দুটোই একে অপরকে গঠন করে ও প্রভাবিত করে। যেমন বাংলাদেশ বা বিশ্ব ইতিহাস থেকে আরও গভীরে গেলে দেখা যায়, বাস্তব জীবনে সংস্কৃতি ও রাজনীতি একটা নিরবচ্ছিন্ন দ্বন্দ্ব ও সহাবস্থানের সম্পর্ক গড়ে তোলে।
সংস্কৃতি রাজনীতিকে গঠন করে; মানুষের বিশ্বাস, রীতিনীতি, ভাষা, শিল্প, জীবনদর্শন-এসব থেকে রাজনৈতিক চিন্তাধারা তৈরি হয়। যেমন: যদি কোনো সমাজে মুক্তচিন্তার সংস্কৃতি থাকে, তাহলে সেখানে গণতন্ত্র গড়ে ওঠার সম্ভাবনা বেশি। রাজনীতি সাংস্কৃতিক গতিধারাকে প্রভাবিত করে। যখন কোনো রাজনৈতিক শক্তি ক্ষমতায় আসে, তারা তাদের মতাদর্শ অনুযায়ী সাংস্কৃতিক নীতিনির্ধারণ করে। কোনো সরকার যদি এক ধরনের জাতীয়তাবাদ প্রচার করে, তবে তার শিক্ষা, সাহিত্য, চলচ্চিত্র, ইতিহাসচর্চাও সেই অনুযায়ী গড়ে ওঠে। আর এভাবেই ফ্যাসিজমের সৃষ্টি হয়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মাতৃভাষা বাংলার অধিকার মূলত সাংস্কৃতিক পরিচয়ের লড়াই ছিল। কিন্তু এটি একপর্যায়ে রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীনতাসংগ্রামের বীজ বপন করেছিল। আবার ইউরোপের রেনেসাঁ যুগেও (১৪শ-১৬শ শতক) সংস্কৃতি (বিজ্ঞান, শিল্প, মুক্তবুদ্ধি) নতুন করে বিকশিত হয়েছিল, যা পরে রাজনীতিতে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ইত্যাদির ধারণা জন্ম দিয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নে কমিউনিস্ট শাসনের সময়কালে উলটোটি ঘটেছিল, সেখানে রাজনীতি সাংস্কৃতিক জীবন নিয়ন্ত্রণ করেছিল। কী বই পড়বে, কী গান হবে, কী ছবি আঁকা যাবে-সবকিছুতে রাজনৈতিক মতাদর্শের ছাপ ছিল।
বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সংস্কৃতি ও রাজনীতির সম্পর্ক খুবই স্পষ্ট ও জটিল। দুটোই একে অপরকে গভীরভাবে প্রভাবিত করছে। বাংলাদেশের সংস্কৃতি (ভাষা, সাহিত্য, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, লোকসংস্কৃতি) জাতীয় পরিচয়ের মেরুদণ্ড, এটা যেমন সত্য, তেমনই ২৪-এর গণ-অভুত্থানও জাতির জন্য আরেকটি অধ্যায়। এখানে দেখা যায়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা একেক রাজনৈতিক দল একেকভাবে ব্যাখ্যা করে। ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতার ইতিহাস-এগুলো রাজনৈতিক বক্তব্যে নিয়মিত ব্যবহৃত হয়। ফলে সাংস্কৃতিক বিষয়গুলো (মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা) রাজনৈতিক বিতর্কেরও কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে। শিল্প-সাহিত্য, নাটক, সিনেমা, সংগীত-এগুলো সরকার বা রাজনীতির প্রভাবের বাইরে থাকে না। অনেক সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান (যেমন: বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি ইত্যাদি) নিয়োগ, পরিচালনা ইত্যাদিতে রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব দেখা যায়। এমনকি বিগত সময়ে দেখা গেছে, সাংস্কৃতিক পুরস্কার বা সম্মাননা দিতেও অনেক সময় রাজনৈতিক বিবেচনার প্রভাব পড়েছে। তাছাড়া বতর্মান ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক প্রভৃতিতে তরুণ প্রজন্ম নিজেদের নতুন সাংস্কৃতিক ভাষা তৈরি করছে। তবে এখানেও রাজনীতি ঢুকে পড়েছে। কারা কী ধরনের বিষয় প্রকাশ করবে, কারা ‘দেশবিরোধী’ বা ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ হিসাবে চিহ্নিত হবে-এসব নিয়ে সরকারি পর্যায়ে নজরদারি বেড়েছে।
অনেক সময় অনলাইন সাংস্কৃতিক আন্দোলন (যেমন: নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, কোটা সংস্কার) সরাসরি রাজনৈতিক সংঘাতে পরিণত হয়। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ভেতরে ধর্ম বড় একটি অংশ। এখন ধর্মীয় পরিচয়ও রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। কেউ ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে, কেউ ইসলামি মূল্যবোধের পক্ষে-দুই দিক থেকেই সাংস্কৃতিক আঙ্গিকে রাজনীতিতে ব্যবহৃত হচ্ছে। এ জায়গায় সাংস্কৃতি ও রাজনীতি খুবই স্পর্শকাতর হয়ে উঠেছে। পশ্চিমা সংস্কৃতি (পপ কালচার, ফ্যাশন, প্রযুক্তি) বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মকে প্রভাবিত করছে। আবার এ পরিবর্তনের বিরুদ্ধে কিছু রাজনীতিক ও সামাজিক গোষ্ঠী নিজস্ব সাংস্কৃতি রক্ষার নামে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে। ফলে একটি সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্বও তৈরি হয়েছে-‘আধুনিকতা বনাম ঐতিহ্য’। বাংলাদেশে সাংস্কৃতি ও রাজনীতি এখন এতটাই একে অপরের সঙ্গে জড়িত, একটিকে না ছুঁয়ে আরেকটিকে ব্যাখ্যা করা কঠিন। সাংস্কৃতি রাজনীতিকে রং দেয়, আবার রাজনীতি সাংস্কৃতিক ধারাকে রূপান্তর করে। এ সম্পর্ক কখনো ইতিবাচক, কখনো নেতিবাচক-এটি নির্ভর করে কারা ক্ষমতায় এবং সমাজ কোনদিকে যাচ্ছে তার ওপর।
বাংলাদেশ প্রশ্ন করতে পারে, আমার ভবিষ্যৎ সাংস্কৃতি-রাজনীতির ভারসাম্য হতে পারে? একমাত্র সাংস্কৃতিই (ভাষা, গান, কবিতা, ইতিহাস) পারে জাতির আবেগ ও অনুভূতিকে মনে জায়গা করে দিতে, সেই সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতি যদি সাংস্কৃতিক বিভাজন ঘটায় (মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে বিতর্ক, ধর্মীয় বিভাজন), তাহলে সঠিক সাংস্কৃতিক চর্চার মাধ্যমে সমাজের ভাঙনও রোধ করতে পারে। এখানে একপেশে ভূমিকা নয়, ভবিষ্যতে জাতীয় ঐক্য বজায় রাখতে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ওপর নিরপেক্ষ সম্মান বজায় রাখতে হবে, যা হতে হবে রাজনীতির দলগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে ওঠে। অর্থাৎ, সাংস্কৃতি হবে সমাজের সেতুবন্ধ, বিভাজনের হাতিয়ার নয়।
আগামী দিনে প্রযুক্তি, অর্থনীতি, কূটনীতি-সব জায়গায় টিকে থাকতে হলে সৃজনশীল মানুষের প্রয়োজন হবে। সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা (লেখা, গান, নাটক, গবেষণা) না থাকলে সমাজে সৃজনশীলতাও থাকবে না। আর যদি রাজনীতি বেশি দমনমূলক হয়, তাহলে সাহসী চিন্তা, নতুন ধারণা লুক্কায়িত থাকবে-যা ভবিষ্যতের জন্য ভয়ংকর রূপ ধারণ করতে পারে। তাই ভবিষ্যতে সাংস্কৃতিকমুক্ত পরিবেশ তৈরি না করলে, বাংলাদেশ প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে পিছিয়ে পড়বে। মনে রাখতে হবে, এ বাংলায় সংস্কৃতি আমাদের ভিন্নতা মেনে নেওয়ার শিক্ষা দেয়। যেমন: একসঙ্গে হিন্দু-মুসলিম-পাহাড়ি-বাঙালি সংস্কৃতি। রাজনীতি যদি সাংস্কৃতিক ভিন্নতাকে শ্রদ্ধা করতে না শেখে, তাহলে সহিংসতা, চরমপন্থা বাড়বে। সহনশীল সংস্কৃতি না থাকলে গণতন্ত্রও দুর্বল হয়ে পড়ে-কারণ গণতন্ত্র মানে ভিন্নমতের সহাবস্থান। ভবিষ্যতে সংস্কৃতি হওয়া উচিত সহনশীল গণতন্ত্রের চালিকাশক্তি।
আজকের বিশ্বে ‘সফট পাওয়ার’ অনেক বড় বিষয়-মানে, তোমার সংস্কৃতি দিয়ে তুমি বিশ্বে প্রভাব বিস্তার করো। যেমন: কোরিয়া করেছে (কে-পপ, কে-ড্রামা), ভারত করেছে (বলিউড, যোগ)। বাংলাদেশ যদি নিজস্ব সাংস্কৃতিক শক্তি তুলে ধরতে পারে (লোকসংগীত, সাহিত্য, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, খাদ্যসংস্কৃতি ইত্যাদি), তাহলে আমাদের সম্মান ও প্রভাব বাড়বে। তবে যদি রাজনীতি সাংস্কৃতিক বিকাশকে আটকে দেয় বা সংকীর্ণ করে ফেলে, তাহলে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দুর্বল হবে। বাংলার মানুষ অবশ্য আশা করছে, ভবিষ্যতের জন্য সাংস্কৃতি হবে বিশ্বে বাংলাদেশের সম্মানের বড় হাতিয়ার। সংস্কৃতি মানুষের ভেতর মানবিকতা, করুণা, সহানুভূতি তৈরি করে। রাজনীতি যদি একে ধ্বংস করে দেয় (হিংসা, ঘৃণা, বিভাজন সৃষ্টি করে), তাহলে ভবিষ্যতে সমাজ অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে। তরুণ প্রজন্ম যদি সাংস্কৃতিকচর্চা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়, তারা হতাশ, সহিংস, ভীতু হয়ে উঠবে, যা সমাজের জন্য মারাত্মক। তাই স্থায়ী শান্তি ও উন্নয়নের জন্য সাংস্কৃতিক বিকাশ অপরিহার্য।
পরিশেষে আমরা যেন অনুধাবন করতে পারি, ভবিষ্যতের বাংলাদেশে টেকসই উন্নয়ন, গণতন্ত্র, সামাজিক শান্তি, আন্তর্জাতিক সম্মান-সবকিছুর জন্য সংস্কৃতি ও রাজনীতির ভারসাম্য রক্ষা করা বাধ্যতামূলক। রাজনীতি যেন সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করে। সংস্কৃতি যেন রাজনীতির বিভাজনের হাতিয়ার না হয়। দুটো মিলে একটা মানবিক, সৃজনশীল ও স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ে উঠুক, এ প্রত্যাশা বিরাজ করুক সবার হৃদয়ে।
এম এ হামিদ : সাংস্কৃতিক ও মানবাধিকারকর্মী; সাধারণ সম্পাদক, সেন্টার ফর বাংলাদেশ থিয়েটার (সিবিটি)
