আমরা কি নিজস্ব সংস্কৃতিতে এগোতে পেরেছি
এম এ হামিদ
প্রকাশ: ১৩ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
এদেশের বাঙালি সংস্কৃতি বাংলাদেশের আত্মার অংশ-এটি বাঙালি জাতিসত্তার ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভাষা, সাহিত্য, সংগীত, পোশাক, উৎসব, আচার-অনুষ্ঠান এবং জীবনযাত্রার ধারার সমন্বয়ে গঠিত। ভাষা ও সাহিত্যের দিক থেকে বাংলাদেশের বাঙালি সংস্কৃতির মূল যে বিষয়টি, সেটি হলো ভাষা। এটি এমনই একটি ভাষা, যার জন্য আমাদের ছাত্র-জনতাকে প্রাণ বিলিয়ে দিতে হয়েছে। বাংলাদেশের নিজস্ব সংস্কৃতির কথা বলতে হলে, সর্বপ্রথম এ বঙ্গের সংস্কৃতির একটি দীর্ঘ ও বৈচিত্র্যময় ইতিহাসের দিকে কিছুটা আলোকপাত করতে হবে, যা বহু শতাব্দী ধরে বিবর্তিত হয়েছে। মহাজনপদ যুগে, বঙ্গ ছিল একটি স্বতন্ত্র জনপদ। এখানকার মানুষ কৃষিনির্ভর ছিল এবং হিন্দু ধর্ম ও লোকজ উপাসনা সমাজে চালু ছিল। ৩২২-১৮৫ খ্রিষ্টপূর্বে এ অঞ্চল মৌর্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এ সময়ে বৌদ্ধ ধর্ম বিস্তার লাভ করে। পরে ৩২০-৫৫০ খ্রিষ্টাব্দে গুপ্ত যুগে সংস্কৃতি, শিক্ষা ও শিল্পের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটে। বৌদ্ধ এবং হিন্দু মঠ ও বিশ্ববিদ্যালয় (যেমন পুণ্ড্রবর্ধন) গড়ে ওঠে।
সংস্কৃতির ইতিহাসের কিছু ধারণা থেকে পাওয়া যায়, ১২০০-১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে মুসলিম শাসকদের সময়ে বাংলাভাষায় সাহিত্যচর্চা জনপ্রিয়তা পায়। ঠিক সে সময়েই মঙ্গলকাব্যের (১৪০০-১৭০০) মতো ধর্মীয় ও পৌরাণিক কাহিনি কাব্যের সূচনা হয়। প্রখ্যাত কবি কৃত্তিবাস (রামায়ণ), মুকুন্দরামের (চণ্ডীমঙ্গল) পরিচিতির মাঝে মুসলিম কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে সাইকান্দার আলী, শাহ মুহম্মদ সগীর, আলাওল (পদ্মাবতী), ফকির-সন্ন্যাসী ধারার মনীষীদের আগমন ঘটে। এরই ধারাবাহিকতায় ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দে ইখতিয়ারউদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজির নদীয়া জয় ও মুসলিম শাসন শুরু হয়। সেই সময় থেকে ইসলামী সংস্কৃতি ও ইসলাম ধর্মের প্রভাব বাড়ে; বিশেষ করে সুফি সংস্কৃতি ও দরগাহভিত্তিক সমাজ গড়ে ওঠে। অপরদিকে বাংলাভাষায় সাহিত্য রচনার সূচনা হয়, যেমন- চণ্ডীদাস ও বিদ্যাপতি। ১৪৮৭-১৫৭৬ সালের দিকে হুসাইন শাহি শাসনামলে বাংলা সাহিত্য, চিত্রকলা ও মসজিদ স্থাপত্যে উত্থান ঘটে। ১৫৪০-১৫৫৭ সালে শের শাহের শাসনকালে প্রশাসনিক সংস্কার ও সড়ক নির্মাণ হয়। ১৫৭৬ সালে মুঘল শাসন শুরু হলে ঢাকা গুরুত্বপূর্ণ নগরীতে পরিণত হয়। ১৭৫৭-তে পলাশীর যুদ্ধের পর ব্রিটিশ শাসন শুরু। ইংরেজি শিক্ষা, প্রিন্টিং প্রেস, সংবাদপত্র চালু হয়। সুফি গানের প্রভাবে দেহতত্ত্ববাদের গান, কাওয়ালি; বৈষ্ণব পদাবলী সংগীত; চৈতন্যদেবের প্রভাবে কীর্তন ও সংগীতচর্চা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৮০০-১৯৪৭ সময়ে বাঙালি নবজাগরণ শুরু হলে রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো মনীষীদের আবির্ভাব ঘটে। এর সঙ্গে সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের উত্থান ঘটে, নাট্যচর্চা, চিত্রকলা ও সংগীতচর্চা বৃদ্ধি পায়। মুসলমান সমাজে সাহিত্যের পুনর্জাগরণ হয় মীর মশাররফ হোসেন, কায়কোবাদ প্রমুখ মনীষীদের মাধ্যমে। বাংলা ভাষা আন্দোলন (১৯৫২) থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক চেতনার উন্মেষ ঘটে এ বাংলায়। লোকগীতি, রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি, পালাগান, যাত্রাপালা ইত্যাদি জনপ্রিয় হয়। ঢাকাকেন্দ্রিক থিয়েটার ও চলচ্চিত্র সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে।
জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ১৯১৭ সালে ‘আমাদের ভাষা সমস্যা’ লেখায় উল্লেখ করেছেন, ‘মুহম্মদ-ই বখতিয়ারের বাংলা জয়ের পরে যখন হইতে মুসলমান বুঝিল এই চির-হরিতা ফলশস্য-পুরিতা নদ-নদী-ভূষিতা বঙ্গভূমি শুধু জয় করিয়া ফেলিয়া যাইবার জিনিস নহে; এ দেশ কর্ম্মের জন্য, এ দেশ ভোগের জন্য, এ দেশ জীবনের জন্য, এ দেশ মরণের জন্য, তখন হইতে মুসলমান জানিয়াছে বাংলা চাই-ই। তাই বাংলার পাঠান বাদশাহগণ বাংলা ভাষাকে আদর করিতে লাগিলেন। যে ভাষা দেশের উচ্চশ্রেণীর অবজ্ঞাত ছিল, তাহা বাদশাহের দরবারে ঠাঁই পাইল। নসরৎ শাহ, হোসেন শাহ, পরাগল খাঁ, ছুটি খাঁর নাম বাঙ্গালী ভুলিতে পারিবে না। বাদশাহের দেখাদেখি আমীর ওমরা বাংলার খাতির করিলেন। আমীর ওমরার দেখাদেখি সাধারণে বাংলার আদর করিল। গোঁড়া ব্রাহ্মণের অভিসম্পাত ও চোখরাঙ্গানিকে ভয় না করিয়া বাঙ্গালী নবীন উৎসাহে তাহার প্রিয় ধর্মপুস্তকগুলি বাংলায় অনুবাদ করিল, কত দেশ প্রচলিত ধর্মকথা বাংলায় প্রকাশ করিল, কত মর্মগাথা বাংলায় প্রচার করিল। মুসলমানও চুপ করিয়া থাকে নাই। হিন্দুর রামায়ণ আছে; মুসলমানের ‘জঙ্গনামা’ আছে। হিন্দুর মহাভারত আছে, মুসলমানের ‘কাসাসোল আম্বিয়া’ আছে। হিন্দুর মহাজন পদাবলী আছে; মুসলমানের মারফতী গান আছে। হিন্দুর বিদ্যাসুন্দর আছে; মুসলমানের ‘পদ্মাবতী’ আছে।’
বাঙালি সংস্কৃতির প্রধান বাহক ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন যেমন এ ভাষার গুরুত্বকে আরও দৃঢ় করেছে। তেমনি সাহিত্যে মাইকেল মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জসীমউদ্দীন থেকে শুরু করে শামসুর রাহমান, আল মাহমুদসহ অসংখ্য কবি-সাহিত্যিক বাঙালি সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছেন। গ্রামীণ জীবনধারার সংস্কৃতিতে পালাগান, কিস্সা, মরমি ইত্যাদির মাধ্যমে আনন্দ প্রাণের সমাবেশ ঘটিয়েছে। উৎসবের সময় রমণীরা বিশেষ সাজসজ্জায় শাড়ি, বিশেষ করে জামদানি, তাঁত এবং পুরুষরা লুঙ্গি, পাঞ্জাবি, ফতুয়া, পায়জামার মতো ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিধান করেন। পহেলা বৈশাখ, নবীনবরণ, নবান্ন, বসন্তের মতো সাংস্কৃতিক উৎসব তো আছেই, ঈদ, দুর্গাপূজা, বুদ্ধপূর্ণিমা, বড়দিনের মতো ধর্মীয় উৎসব এ অঞ্চলের ধর্মীয় বহুত্ববাদের প্রতিচ্ছবি। ভাত, ডাল, মাছ, ভর্তা, ভাজি, পান্তা-ইলিশ, পিঠা-এসব খাবার বাঙালি রসনার পরিচয় বহন করে, এমনকি উৎসব কিংবা অতিথি আপ্যায়নেও থাকে বিশেষ আয়োজন। এ বাঙালিই চিত্রকলা ও কারুশিল্পে; নকশিকাঁথা, পাটের কাজ, কাঁসার বাসন, জামদানি শাড়ি, হস্তশিল্পে নিজেদের নিপুণতা দেখিয়েছে। উৎসবে-পার্বণে গ্রামীণ দেওয়ালচিত্র কিংবা আলপনা আঁকার মাধ্যমে নিজেদের নৈপুণ্যতা প্রকাশ করেছে। এ সংস্কৃতিতেই ছিল পরিবারকেন্দ্রিক সমাজ, আতিথেয়তা, সহানুভূতি ও সামাজিক বন্ধন। সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি ছিল, সেটি হচ্ছে ধর্মীয় সহনশীলতা ও জাতিগত সম্প্রীতি। এ সবের বেশির ভাগই এখন অতীত, তাই প্রায়ই বিভিন্ন সভায় বলতে শুনতে পাই, বাংলাদেশ নিজস্ব সংস্কৃতিতে এগোতে পেরেছে কি?
সংস্কৃতিকে সর্বপ্রথম ১৯৫২ সালে পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর মতাদর্শ অনুযায়ী হস্তক্ষেপ করেছিল। পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) রাষ্ট্রভাষা হিসাবে উর্দুকে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা ছিল সংস্কৃতির ওপর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের প্রথম বড় এজেন্ডা। সেটাও ছাত্র-জনতার আন্দোলনের কাছে নতিস্বীকার করতে বাধ্য হয়। এ আন্দোলন প্রথমবারের মতো ‘বাঙালি জাতিসত্তা’কে ধর্মের চেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক অস্তিত্ব হিসাবে সামনে আনে। কোনো দেশ ও জাতিকে দমিয়ে রাখতে হলে তার প্রথমে সংস্কৃতির ওপর আঘাত করতে হয়, পাকিস্তানের এটিই ছিল প্রথম প্রয়াস। সে সময় এ অঞ্চলে প্রচলিত সংগীত, বাংলা সাহিত্য, বাঙালি পোশাক ও আচরণকে ‘হিন্দুয়ানি’ আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। এর ফলেই ভাষা আন্দোলন ও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ জন্ম নেয়, যার ভিত্তি ছিল সংস্কৃতি। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে শেখ মুজিবুর রহমান ‘বাঙালি’ জাতীয়তাবাদ গড়ে তোলেন ভাষা, সংস্কৃতি ও ভূখণ্ডের মিলনের ভিত্তিতে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান রাষ্ট্র-ক্ষমতায় আসেন এবং তিনি একটি স্বতন্ত্র ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’ ধারণা উপস্থাপন করেন।
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ভাষায় : আমরা শুধু বাঙালি নই, আমরা বাংলাদেশি। আমাদের পরিচয় আমাদের ভূখণ্ড, জাতি, ধর্ম ও ইতিহাসের সামগ্রিকতার মধ্যে নিহিত।’ একটি জাতির কিংবা ব্যক্তির পরিচয় শুধু একটি মাত্র উপাদানে নির্ভর করে না। বরং ভূখণ্ড, জাতিসত্তা, ধর্মীয় বিশ্বাস এবং ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা-এ চার উপাদানের সমন্বয়ে পরিচয়ের গভীর ভিত্তি গড়ে ওঠে। যে মাটিতে জন্ম, বেড়ে ওঠা-সেই ভূমি আমাদের ভাষা, জীবনাচার ও সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করে। বাংলাদেশিদের পরিচয়ে পদ্মা-মেঘনা-যমুনার ভূমিকা যেমন রয়েছে, তেমনি আবহাওয়া, নদীমাতৃকতা, কৃষিনির্ভরতা ইত্যাদিও সাংস্কৃতিক গঠন নির্ধারণ করে। জাতিগত বৈশিষ্ট্য, ভাষা, লোকসংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস-এসব মিলেই আমরা ‘বাঙালি’, বা ‘বাংলাদেশি’ হিসাবে নিজেদের চিহ্নিত করি। এ পরিচয় ধর্মভিত্তিক নয়; এটি জাতিগত ও সাংস্কৃতিক রূপ। ধর্ম ব্যক্তি ও সমাজের নৈতিকতা, উৎসব, চিন্তাপদ্ধতি ও রীতিনীতিতে প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশের জনসংখ্যার অধিকাংশ মুসলমান। তবে হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীরাও এখানে রয়েছেন-এ বহুধা ধর্মীয় চর্চা মিলেই পরিচয় পূর্ণতা পায়। আর এ ভূখণ্ডের ইতিহাস মানে শুধু অতীত নয়, বরং একটি জাতির সংগ্রাম, জয়-পরাজয়, আন্দোলন ও চেতনার ধারাবাহিকতা। যেমন-১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, এগুলো আমাদের পরিচয়ের কেন্দ্রে। এর সঙ্গে যুক্ত হলো ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান। শুধু ধর্মীয় পরিচয়ে কিংবা শুধু ভাষায় একটি জাতির পরিচয় নির্ধারণ হয় না। বরং ভূখণ্ড, জাতি, ধর্ম, ইতিহাস-এই চতুর্মাত্রিক সত্তার সম্মিলনে একটি জাতির পূর্ণ সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিচয় গড়ে ওঠে। নিজেদের যদি শুধু ‘মুসলমান’ বলি, তাহলে আফগানিস্তান, সৌদি আরব কিংবা তুরস্কের সঙ্গে আমাদের কী পার্থক্য? আবার শুধু ‘বাঙালি’ বললেও ভারতের বাঙালিদের সঙ্গে আমাদের ইতিহাসগত অভিজ্ঞতা তো আলাদা। তাই আমাদের পরিচয়-বাংলাদেশি বাঙালি, মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান ও অন্যান্য ধর্মালম্বী নাগরিক-সব মিলেই একটি জটিল ও সমন্বিত বাস্তবতা।
এক দল বলে, এখন আগের সেই সংস্কৃতি নেই, এটাকে রক্ষা করতে হবে। আবার অনেকে বলে, আংশিকভাবে নিজস্ব সংস্কৃতিতে এগোতে পেরেছে। আবার কিছু কিছু সংগঠন বলে, বহির্বিশ্বের প্রভাব এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক-সামাজিক টানাপোড়েনের কারণে সংস্কৃতি ধ্বংস হতে চলল। তরুণ প্রজন্মের একদল বলতে শুরু করেছে-সেকেলে হয়ে গেছে, এটা আর চলে না। এভাবেই নানা সময়ে নিজস্ব সংস্কৃতির অগ্রগতি বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে। বাংলা সংস্কৃতি বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক মতাদর্শগত হস্তক্ষেপের ফলে বিভাজনের মধ্যদিয়ে অগ্রসর হয়েছে, ঐক্যের নয়। বিশেষ করে মিডিয়া ও বিনোদন জগতে ভারতীয় হিন্দি ও পশ্চিমা সংস্কৃতির আগ্রাসন দেখা যায়। তাছাড়া বর্তমানে সংস্কৃতির অনেক ক্ষেত্রেই টিকটক, রিলস ও ইউটিউব লোকজ রুচিকে দুর্বল করেছে। বর্তমানে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বই পড়ার প্রবণতা কমেছেই, আবার পরিবারগুলোর মধ্যে বাংলা গান, সাহিত্য, নাটকের চর্চা দিন দিন কমছে। আবার অনেকেই ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’ ধারণার সঙ্গে তাল মিলিয়ে একটি ‘ইসলামি-জাতীয় সাংস্কৃতিক পরিচয়’ গড়ে তোলার চেষ্টা করে। একদিকে প্রগতিশীল, ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয়তাবাদপন্থি গোষ্ঠী-যারা রবীন্দ্র-নজরুল, লোকসংস্কৃতি ও আধুনিকতা জোর দিয়ে তুলে ধরে। অন্যদিকে, ইসলামি ঐতিহ্যনির্ভর ও ইসলামি মূল্যবোধে রাষ্ট্রকে পরিচালিত দেখতে ইচ্ছুক গোষ্ঠী-যারা ইসলামি সংস্কৃতি ও আরবি-ফারসি ঐতিহ্যকে জাতীয় সংস্কৃতির কেন্দ্রে আনতে চায়, তারা রবীন্দ্রনাথ বা শাস্ত্রীয় গানকে ‘হিন্দুয়ানি’ বা ‘অনৈসলামি’ মনে করে। ‘পহেলা বৈশাখ’, ‘বসন্ত উৎসব’, ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’ ইত্যাদিকে ‘বিদেশি/অনৈসলামি সংস্কৃতি’ বলে তারা সমালোচনা করে। তারা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে ‘অতীতের মুসলিম ঐতিহ্যের’ আলোকে দেখতে চায়। সাহিত্য-সংস্কৃতিকে ‘আখিরাতমুখী’ ও নৈতিকতাভিত্তিক করে তুলতে চায়। ইসলামি আদর্শভিত্তিক কবিতা, গজল, হামদ-নাতের চর্চা; পোশাকে পাঞ্জাবি-টুপি, বোরখা-হিজাবের সংস্কৃতি প্রচার চায়। আরবি ক্যালিগ্রাফি, ইসলামি স্থাপত্যরীতির প্রতি ঝোঁক রয়েছে তাদের। এর মধ্যেও নাটক, গান, কবিতা হয়ে ওঠে রাজনৈতিক প্রতিবাদের হাতিয়ার। এ সময় ‘সংস্কৃতি কর্মী’ ও ‘রাজনৈতিক কর্মী’ প্রায় এক হয়ে যান। ক্ষমতায় থাকা দলগুলোর দ্বারা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ‘নির্বাচিত সংস্কৃতির’ প্রমোশন হয়। একদল রবীন্দ্র-নজরুল-আধুনিক সংস্কৃতি তুলে ধরে। অন্যদল ইসলামি সংস্কৃতি ও আরবি-ফারসি ঐতিহ্য জোর দিয়ে তুলে ধরে। তবে সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো যখন দলীয়করণের আওতাভুক্ত হয়ে যায়, তখনই জাতীয় শিল্পকলা একাডেমি, বাংলা একাডেমি প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান কখনো কখনো পক্ষপাতমূলক আচরণ করে। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক চেতনায় এ ‘দ্বৈতপ্রবাহ’ এখন বাস্তবতা-একদিকে বাঙালি-ধর্মনিরপেক্ষ ঐতিহ্য; অন্যদিকে ইসলামি-আন্তর্জাতিক ধর্মীয় ঐতিহ্য। প্রশ্ন হলো, এ দুই ধারার মধ্যে সমন্বয় কি সম্ভব? নাকি আমাদের একক সংস্কৃতি রূপান্তরের নতুন ভাবনা দরকার?
এম এ হামিদ : সাংস্কৃতিক ও মানবাধিকারকর্মী; সাধারণ সম্পাদক, সেন্টার ফর বাংলাদেশ থিয়েটার
