Logo
Logo
×

বাতায়ন

বিচার চাই, শাস্তি কার্যকরও চাই

Icon

জিয়া আহমদ

প্রকাশ: ১৭ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বিচার চাই, শাস্তি কার্যকরও চাই

প্রতীকী ছবি

দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি গত এক সপ্তাহে হঠাৎ করে নাজুক হয়ে পড়েছে। গুপ্তহত্যা, ‘মব ভায়োলেন্সের’ মাধ্যমে মানুষ খুন, সংঘবদ্ধ চাঁদাবাজি ইত্যাদি ঘটনা ঘটেছে। সরকার ঘটনা ঘটার আগে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারছে না; অথচ অনেক ক্ষেত্রেই এ ঘটনাগুলো পূর্ব থেকেই অনুমান করা যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এ ঘটনাগুলো প্রতিরোধযোগ্য হলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুর্বলতার কারণে তা করা সম্ভব হচ্ছে না। এক্ষেত্রে সামাজিক প্রতিরোধ খুব কার্যকর হলেও জনগণের মধ্যকার অন্তর্দ্বন্দ্ব ও বিভেদ এবং তাদের নিস্প্রহতার কারণে তাও করা সম্ভব হচ্ছে না। অনেকে আশঙ্কা করছেন, সামনের দিনগুলোয় এ নিরাপত্তাহীনতা আরও বেড়ে যেতে পারে।

সম্প্রতি ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনের রাস্তায় সোহাগ নামের এক তরুণকে প্রথমে কুপিয়ে এবং পরে মাথা ও শরীরের ওপর বড় কংক্রিটের টুকরা ফেলে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার বীভৎসতা মানুষকে আওয়ামী দুঃশাসনের কথাই মনে করিয়ে দিয়েছে। বিবমিষা উদ্রেককারী এ দৃশ্যে দেশের মানুষ হতভম্ব হয়ে পড়েছে। ঘটনার সময় অকুস্থলে অনেক মানুষ উপস্থিত থাকলেও সোহাগকে বাঁচাতে কেউ এগিয়ে যায়নি, বরং তারা ভিডিও করতে ব্যস্ত থেকেছে। গত ১০ জুলাই খুলনায় জাতীয়তাবাদী যুবদলের এক সাবেক নেতা মাহবুব মোল্লাকে তার বাসার সামনে প্রথমে গুলি করে এবং পরে তার পায়ের ‘রগ কেটে’ হত্যা করা হয়। এছাড়াও চাঁদপুরে একটি মসজিদের খতিব নূর রহমান মাদানির ওপর তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা চালানো হয়। কিন্তু ভাগ্য সহায় থাকায় তিনি প্রাণে বেঁচে গেছেন। ঢাকার পল্লবী থানায় এক ব্যবসায়ীর কাছে চাঁদার জন্য ৩০-৪০ জনের একটি সংঘবদ্ধ সন্ত্রাসী দল আক্রমণ করে। তারা পাঁচ কোটি টাকা চাঁদার দাবিতে এ ‘মব সন্ত্রাস’ সংঘটিত করে। এছাড়াও একটি নীরব সন্ত্রাসের ভিডিও ফুটেজ প্রকাশিত হয়েছে সম্প্রতি। গত মে মাসে রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকায় এক ভদ্রমহিলার কাছ থেকে নবগঠিত একটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা দলের অপর একজন কেন্দ্রীয় নেতার মাধ্যমে সাত লাখ টাকা চাঁদা নেওয়ার ভিডিও সম্প্রতি সেই ভদ্রমহিলার পক্ষ থেকে প্রকাশ করা হয়েছে। ভুক্তভোগী ভদ্রমহিলা জানান, তাকে ‘সরকারি টেন্ডার’ ও ‘প্রজেক্ট’ প্রদানের লোভ দেখিয়ে এ পর্যন্ত ৪৮ লাখ টাকা গ্রহণ করা হলেও তাকে কোনো কাজ বা প্রজেক্ট দেওয়া হয়নি। সম্প্রতি চট্টগ্রামের পটিয়া থানায় আক্রান্ত এক সাবেক ছাত্রলীগ নেতা প্রাণভয়ে থানায় আশ্রয় নিলে বিক্ষুব্ধ লোকজন সাবেক ওই ছাত্রলীগ নেতাকে গ্রেফতার করতে বলে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা না থাকায় পুলিশ তা প্রতিপালনে অপারগতা প্রকাশ করলে তারা পুলিশের ওপরই চড়াও হয়। আক্রান্ত হয় থানাও। কিন্তু এ সন্ত্রাসের কোনো বিচার না হলেও ‘চাপের’ মুখে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে পরদিনই প্রত্যাহার করা হয়। তাছাড়া গত ১৫ জুলাই কক্সবাজার জেলায় অন্য একটি রাজনৈতিক দলের এক নেতার হামলায় বিএনপির স্থানীয় নেতা রহিমুদ্দিন শিকদার নিহত হয়েছেন।

এক সপ্তাহের মধ্যে হওয়া এ ঘটনাগুলো একটি দেশের বাস্তব অবস্থা বোঝানোর জন্য যথেষ্ট। কিন্তু সমস্যা হলো এ ঘটনাবহুল সপ্তাহের দায় চাপানোর চেষ্টা করা হলো ঘটনাগুলোর সঙ্গে কোনো ধরনের সম্পর্কহীন বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে ‘ভিক্টিম’ রাজনৈতিক দল বিএনপির ওপর। মিটফোর্ড এলাকায় নিহত সোহাগ ছিলেন ‘ভাঙারি’ ব্যবসায়ী। তার হত্যাকারী মহীনও (বা মইন) ভাঙারি ব্যবসায়ী ও চিহ্নিত সন্ত্রাসী। এ দুজন আগে একসঙ্গে ব্যবসা করলেও বর্তমানে আলাদাভাবে ব্যবসা করতেন। তারা উভয়ই গত স্বৈরাচারের আমলে এলাকার এমপি সন্ত্রাসী হাজী সেলিমের ‘ফুট সোলজার’ ছিলেন। গত জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর তারা বিএনপির ছত্রছায়ায় আসার চেষ্টা করেন (যে ধরনের ঘটনা দেশের বহুস্থানেই দেখা গেছে; সাবেক আওয়ামী সন্ত্রাসীরা বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ নানা দলে ভিড়ে গেছে)। এরই মধ্যে ব্যবসার দ্বন্দ্বে সোহাগ খুন হন। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপি খুনি মহীনসহ চারজনকে দল থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করেছে এবং পুলিশ মহীনসহ ৮ জন আসামিকে ইতোমধ্যেই গ্রেফতার করেছে এবং অন্যদেরও গ্রেফতারের চেষ্টা চালাচ্ছে। পুলিশের কাছে আসামিরা যে জবানবন্দি দিয়েছে তার ভিত্তিতে পুলিশ জানিয়েছে, এ হত্যাকাণ্ড সম্পূর্ণ ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের কারণে ঘটেছে। এখানে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কোনো বিষয় ছিল না। বর্তমানে খুনি মহীনের নানা অপকর্মসহ তার পূর্ব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের তথ্য বের হয়ে আসছে, যার সঙ্গে বিএনপির দূরতম কোনো সংযোগ দেখা যাচ্ছে না।

অন্যদিকে খুলনার সাবেক যুবদল নেতা মাহবুব মোল্লার হত্যাকাণ্ডের জটটি পুলিশ এখনো খুলতে পারেনি। তাছাড়া চাঁদপুরের খতিবের ওপর আক্রমণের বিষয়টিও কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় বলে মনে হচ্ছে। তবে কারা দায়ী এবং এসব ঘটনার উদ্দেশ্য কী সে ব্যাপারে মন্তব্য করার আগে পুলিশের তদন্ত শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করাই যৌক্তিক হবে।

কিন্তু তদন্ত শেষ হওয়ার আগেই কয়েকটি রাজনৈতিক দল এ ঘটনাগুলো, বিশেষত মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে খুন হওয়া সোহাগ হত্যাকাণ্ডের দায় বিএনপির ওপর চাপিয়ে মিটিং-মিছিলসহ নানা কর্মকাণ্ড শুরু করে দেয়; অথচ মূল খুনিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ওইসব দলের নেতৃত্ব রাজনৈতিক ফায়দা লাভের জন্য বিএনপির নির্বাসিত শীর্ষ নেতা তারেক রহমানের ওপর বিষোদ্গার ও তাকে নিয়ে অশ্লীল স্লোগান দেওয়া শুরু করে, যা সব পর্যায়ের বিএনপি নেতাকর্মীদের ক্ষুব্ধ ও ব্যথিত করেছে। তারা শুধু তারেক রহমানই নয়, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা এবং স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে নিয়েও নোংরা স্লোগান দিয়েছে, তার ছবির অবমাননা করেছে। ‘ইউটিউবে’ প্রচারিত ভিডিও দেখে দেশের সাধারণ মানুষ অত্যন্ত বিক্ষুব্ধ হয়েছে, যা সামাজিক মাধ্যমে তাদের প্রতিক্রিয়া হতে দেখা যাচ্ছে।

৫ আগস্ট ২০২৪ স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পতনের পর একাধিক রাজনৈতিক দল ক্ষমতার অংশ পাওয়ার জন্য উন্মত্ত হয়ে পড়েছে। তাদের সাংগঠনিক অবস্থা বা মাঠের জনসমর্থন উচ্চাশার সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন হলেও তারা রাজনীতির মাঠের দখল নিতে উদ্যোগী হয়েছে এ ধরনের ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে। তাদের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতে জড়িত হয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন কর্তৃক তদন্তাধীন থাকা সত্ত্বেও তাদের কাউকেই কিন্তু দল থেকে বহিষ্কার করা হয়নি এখনো। দুদক এ দুর্বৃত্তদের কারও কারও ব্যাংক হিসাব জব্দ ও দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিলেও এখনো তারা দলের সমর্থন উপভোগ করছেন। অপরদিকে বিএনপির কোনো নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে বিএনপি দ্রুততম সময়ের মধ্যে অভ্যন্তরীণ তদন্তের মাধ্যমে সত্য অনুসন্ধান করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে প্রথম থেকেই। গত ১০ মাসে বিএনপি দলের তিন হাজারেরও বেশি নেতাকর্মীকে চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসে জড়িত থাকার অপরাধে দল থেকে বহিষ্কার করেছে। দলীয় সিদ্ধান্ত ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে একটি রাজনৈতিক দলের এর চেয়ে আর বেশি কি কিছু করণীয় থাকে? তারপরও দুই-তিনটি দল একজোট হয়ে বিএনপির ভাবমূর্তিকে নস্যাৎ করার লক্ষ্যে অপপ্রচারে লিপ্ত হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।

খুব অল্পসময়ে এতগুলো প্রাণঘাতী ঘটনা ঘটাকে অনেকেই সন্দেহের চোখে দেখছেন। অভিজ্ঞ মহল মনে করছে, এগুলো দেশের আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার অশুভ পরিকল্পনার অংশ হতে পারে। এ ঘটনাগুলো তার ধারাবাহিকতা কি না, তাও ভেবে দেখা দরকার। বস্তুত দেশের ভোট সংখ্যার ১০-১২ শতাংশের দাবিদার দলগুলো আগামী নির্বাচনে কী ধরনের ফলাফল করতে পারে, তা ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে আসছে। সম্প্রতি SANEM পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, বিএনপির রাজনীতির প্রতি দেশের নবীন মানুষের প্রচুর আস্থা রয়েছে। সাধারণত ফেসবুকে বা ইউটিউবের মাধ্যমে পরিচালিত ভুয়া জরিপে বিজয়ী হয়ে এতদিন আত্মতৃপ্তিতে ভোগা এ দলগুলো দেশের প্রকৃত জনসমর্থনের অবস্থা দেখে হকচকিত হয়ে গেছে। সে কারণে তারা এ মুহূর্তে নির্বাচন পরিহার করতে চাইবে, এটা প্রত্যাশিত। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে পতিত স্বৈরাচার ও ঔপনিবেশিক শক্তির ষড়যন্ত্র।

এ প্রেক্ষাপটে দেশের অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব আরও কঠিন হয়ে যাচ্ছে। তাদের যেমন দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় আরও জোর দিতে হবে, তেমনই এ ধরনের অন্তর্ঘাতমূলক ঘটনাগুলোর বিষয়ে দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে তাকে দ্রুত বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। আর বিচারের রায় শুধু কাগজে-কলমে দৃশ্যমান করলে চলবে না, তাকে কার্যকরও করতে হবে। সব প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পরও এখনো অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহার হত্যাকারী ওসি প্রদীপের ফাঁসির রায় কার্যকর না হওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। তাছাড়া নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের মামলার আসামিদের জনগণের পয়সায় জেলে রেখে খাওয়ানো বন্ধ করে অবিলম্বে তাদের প্রাপ্য শাস্তি বুঝিয়ে দিতে হবে। মাগুরার কিশোরী আসিয়ার ধর্ষক ও খুনির ফাঁসির রায় বাস্তবায়ন করতে হবে। বিচারের রায় কার্যকর করার ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা অন্যান্য অপরাধীর অপরাধ করতে উৎসাহিত করে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

বিএনপি ও অন্যান্য রাজনৈতিক দল সন্ত্রাস প্রতিরোধে সরকারকে সমর্থন করতে পারে (যা তারা গত বছরের আগস্ট থেকেই করে আসছে), কিন্তু আইনের প্রয়োগ সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে। পতিত স্বৈরাচার ও তার প্রভুরা এদেশকে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্র করছে সারাক্ষণ। সে কারণে দেশে যাতে কোনো ধরনের অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ড না ঘটে, সেজন্য সরকারের গোয়েন্দা বাহিনীগুলোকেও আরও সক্রিয় করতে হবে। দেশের অনেক অভিজ্ঞ ও জ্ঞানী ব্যক্তি মনে করেন, দেশে নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু হলে এ ধরনের ষড়যন্ত্রমূলক কর্মকাণ্ডও কমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যা সরকারের নীতিনির্ধারকরা ভেবে দেখবেন মর্মে আশা করাই যায়। অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য এ ধরনের অপতৎপরতার ক্ষেত্রে দ্রুত ও সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতার ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল, তা ভুললে চলবে না।

জিয়া আহমদ, এনডিসি : সাবেক সরকারি কর্মচারী ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম