বৈধ-অবৈধ বিদেশি নাগরিক ও বেকার সমস্যা
ড. মাহবুব হাসান
প্রকাশ: ২৮ আগস্ট ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
প্রতীকী ছবি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিপুলসংখ্যক বিদেশি নাগরিক অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থান করেছিলেন। তাদের মধ্যে ভারতীয় নাগরিকই বেশি। গত বছরের আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিদেশি নাগরিকদের অনেকেই সরকারকে জরিমানা দিয়ে বাংলাদেশ ত্যাগ করছেন। অবৈধভাবে বাংলাদেশে বসবাসকারী ৭ হাজারের মধ্যে ৫ হাজার ভারতীয়। আর বৈধভাবে দেশে অবস্থান করা ৮০ হাজার বিদেশি নাগরিকের মধ্যে সাড়ে ১৩ হাজার ভারতীয়। বৈধ-অবৈধ ভারতীয়রা কাজ করছেন রামপাল তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র, রাস্তা উন্নয়ন, আইটি সেক্টর, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি খাত এবং বিদ্যুৎ প্রকল্পসহ নানা প্রকল্পে (যুগান্তর, ১৬.০৮.২৫)।
এ রিপোর্টকে যদি পুরোপুরি সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ ধরি, তাহলে এটাই মনে হয়, আমরা ভাড়াটিয়া শ্রমিক দিয়ে জাতীয় কাজ করতে উৎসাহী। এটা কেবল বিগত স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার আমলেই যে সূচিত হয়েছে তা নয়, এর সূচনা আরও বহু আগে থেকেই। বিশেষ করে প্রযুক্তি খাতে বিদেশি দক্ষ শ্রমিক ও কারিগরি বিশেষজ্ঞ এনে উৎপাদন বাড়ানো বা এক্সপোর্ট অরিয়েনটেড ইন্ডাস্ট্রিতে বিদেশি লোক নিয়োগের যে প্রবণতা, এর হোতা হচ্ছে বেক্সিমকো। এ গ্রুপটি একবারও এটা ভাবেনি যে, যেসব সেক্টরে বিদেশি দক্ষ লোক নিয়োগ করেছেন তারা, সেসব ক্ষেত্রে দেশের মানুষকে শিক্ষিত ও প্রশিক্ষণ দিয়ে ওই বিদেশিদের জায়গায় নিয়োগ করা যায় বা যেত। কেন করেনি? কারণ ‘পণ্য আমদানি করো আর বিক্রি করো’-কাঁচা পয়সা আয়ের এ মানসিকতা নিয়েই এদের শিল্প সেক্টরে ঢোকা। ফলে কর্মী দেশের না বিদেশের, তা তাদের বিবেচ্য নয়, তারা সময়মতো পণ্য উৎপাদন ও বিক্রি করতে পারল কিনা, সেটাই মুখ্য উদ্দেশ্য। ফলে তাদের মনে-মননে, চেতনায় দেশপ্রেম নেই। বিদেশি জনবল যে পরিমাণ অর্থ নিয়ে যাচ্ছে, তা শিল্প খাতে উন্নয়নের চেয়ে ক্ষতিকেই প্রলম্বিত করছে, এ ভাবনাটি তাদের মধ্যে নেই। দেশপ্রেম থাকলে, ওই রকম ভিশনারি মানুষ হলে তারা নিজেরাই প্রয়োজনীয় দক্ষ লোকবল তৈরির আয়োজন করত।
একবার ভাবুন, দেশে বৈধভাবেই শিল্প সেক্টরের বিভিন্ন খাতে ৮০ হাজার বিদেশি কাজ করছে। ওই ৮০ হাজার লোক আমাদের শিক্ষিত বেকার চাকরিপ্রার্থীদের জন্য প্রতিবন্ধক। ওই ৮০ হাজার কর্মীর জন্য যদি এক লাখ শ্রমিক এবং দক্ষ কারিগর ও প্রযুক্তি শিক্ষায় শিক্ষিত জনশক্তি আমরা তৈরি করতে পারতাম, তাহলে তাদের জন্য যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আমাদের ব্যয় করতে হচ্ছে, তা দেশেই রাখা যেত। এতে যে অর্থনীতির উপকার হতো, তাতে কোনো ভুল নেই।
আজ যারা বিদেশি জনশক্তি নিয়োগ দিচ্ছে, তাদের মানসিকভাবে দেশের প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্যের বিষয়টি জোর দিয়ে বলা হয়নি। কেবল কর্মসংস্থানের বিষয়ে সরকারি তরফে বলা হলেও মানসিকভাবে তাদের মনন ও মেধা বিকাশের আয়োজন করা হয়নি। কারণ, আমলাতন্ত্র এ ব্যাপারে নিস্পৃহ। তারা সেবা দেওয়ার চেয়ে মানসিকভাবে ক্ষমতাটাকেই বড় করে দেখতে শেখে।
এর কারণ কী? কারণ রাজনৈতিক ও লুটেরা মানসিকতা। বিগত আওয়ামী সরকারের আমলে শিল্পপতিদের ঋণ নিয়ে তা ফেরত না দিয়ে খেলাপি হওয়ার সুযোগকে উৎসাহিত করা হয়েছে। আবার আমাদের বিদ্যুৎ ঘাটতি মোকাবিলায় রাতারাতি রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল ব্যবস্থা নেওয়াটাও লুটেরা মানসিকতার উদাহরণ হয়ে রয়েছে। তারা বিদ্যুৎ উৎপাদন না করলেও, পণ্য সরবরাহ না করলেও মাসে মাসে তাদের উচ্চমূল্যের বিল পরিশোধ করা হতো। এ নিয়ে বহুবার লেখালেখি হয়েছে, হাসিনার বশংবদগণকে এজন্য কোনো জবাব দিতে হয়নি। ওই খাতে কত লক্ষ-কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে, তার হিসাবও দেওয়া হয়নি। আবার এ বিদ্যুতের ঘাটতি কমাতে ইন্ডিয়ার একটি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করেছেন হাসিনা। আমাদের গ্যাসের ঘাটতি মোকাবিলায় তেল ও গ্যাস খুঁজে নেওয়ার আয়োজনও সীমিত। পেট্রোবাংলার বাপেক্সকে দিয়ে সামান্যই কূপ খনন করা হয়। সেসব কূপে তেল বা গ্যাস পাওয়া গেলেও তা উৎপাদনে আনার গরজ তেমন একটা নেই। আবার বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে অনুসন্ধান কূপ খননের চুক্তি করার আগে তাদের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা আছে কী নেই, তা নিরূপণ করে দেখার যোগ্য বিশেষজ্ঞ দেশে কি নেই? কোন সেক্টরে আমাদের বিনিয়োগ জরুরি, সেটা নির্ধারণ করার জন্য খুব বেশি দক্ষ লোকের প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু মনমানসিকতায় লোভ ভর করলে তারা অনেক কিছুই করতে পারেন। যেমন বাংলাদেশ ব্যাংকের তিনজন গভর্নর হাসিনার আমলে যে লুটের দরোজা খুলে দিয়েছিলেন, তাদের প্রথমজন ড. আতিয়ার রহমান। এস আলম গ্রুপ এ কারণেই সাতটি ব্যাংক গ্রাস করতে পারে সহজেই। নিয়ন্ত্রক বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ তো দূরের কথা, সব প্রতিবন্ধকতাই উঠিয়ে দেয়, যাতে হাসিনার লোকরা ব্যাংকের টাকা ঋণের নামে লুট করে সেই অর্থ পাচার করতে পারে।
কথায় বলে না, কান টানলে মাথা আসে, এ লুটেরা কাহিনির মূল এসে যায় হাসিনার রাজনৈতিক দেশবিরোধী সিদ্ধান্তের মাধ্যমে।
২.
শুরু করেছি বিদেশি বৈধ ও অবৈধ লোকরা আমাদের দেশে কেমন করে কাজ করে চলেছে প্রশাসনের নাকের ডগায়, তা নিয়ে। আমাদের রাজনৈতিক প্রশাসনের কর্মকর্তারা সেসব চোখে দেখেন না। আমাদের শিল্প খাতের প্রয়োজনেই কিছু দক্ষ কারিগর বা প্রযুক্তিগত খাতের জন্য বিদেশি লোক এসেছে। তারা কাজ করছে। বিশেষ করে ইন্ডিয়ান আইটি সেক্টরের কিছু যোগ্য মানুষ চাকরি করছে, যাদের কেউ না কেউ যে আমাদের দেশের তথ্য সুকৌশলে পাচার করছে না, এ গ্যারান্টি কি কেউ দিতে পারবেন? এরা যে ‘র’-এর হয়ে কাজ করছে না, সেই গ্যারান্টি কেউ দিতে পারবে না। ইদানীং বাংলাদেশের বেসরকারি চ্যানেলগুলোতে দেদার চলছে ইন্ডিয়ান চলচ্চিত্র। অধিকাংশই কেরালার ছবি। এ খাতের অপারেটররা কী করে বিদেশি ছবি চালায়? বিশেষ করে ইন্ডিয়ান, যাদের কালচারাল আধিপত্য যে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে, আমাদের মাথায় ও মগজে যে এর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ছাপ পড়ছে, তা কি অস্বীকার করতে পারবেন? আবার কিছু চীনা মানুষও একইরকম কাজে নিয়োজিত, তারাও যে তাদের দেশের হয়ে তথ্য পাচার করছে না, সেটা কি হলফ করে বলা যায়?
কী পরিমাণ বিদেশি লোক আমাদের শিল্প সেক্টরের বিভিন্ন খাতে কাজ করছে তা দেখা যাক। বিশ্বস্ত সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও এ মুহূর্তে দেশে অবস্থান করছেন ৭ হাজার ৩০৯ জন বিদেশি নাগরিক। এদের মধ্যে ভারতীয় নাগরিক ৪ হাজার ৯৯৭ জন। এছাড়া ৬০৯ জন চীনা, ৩৭৬ জন নেপালি, ১৪০ জন পাকিস্তানি, ফিলিপাইনের ১২৭, শ্রীলংকার ১২০ এবং অন্যান্য দেশের ৯৪০ জন নাগরিক রয়েছেন। বৈধভাবে অবস্থান করা বিদেশিদের মধ্যে ভারতীয় নাগরিক ১৩ হাজার ৫৩৬ জন (যুগান্তর, ১৬.০৮.২৫)।
এসব অবৈধ লোক কিন্তু কাজ করছে। কোথায় কোথায়, কোন কোন শিল্পের কর্মী তারা, সরকারের উচিত তাদের খুঁজে বের করে দেশ থেকে ডিপোর্ট করা। ওই অবৈধদের স্থলে দেশের বেকারদের কর্মসংস্থান করা যাবে। আর যারা অবৈধ জনবলকে কাজে লাগাচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।
অবৈধদের ব্যাপারে সতর্ক এবং কাজ শুরু করেছেন, এ কথা জানালেন ডিএমপি কমিশনার। প্রশ্ন হচ্ছে, আগে যারা কমিশনার ছিলেন, তারা অবৈধ বিদেশি নাগরিকদের ব্যাপারে কেন আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়নি? বর্তমান কমিশনারও তো ওই বাহিনীতেই গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল ছিলেন তখনো। জুলাই বিপ্লবের পর এক বছর কেটে গেছে, তারপরও কেন তারা অবৈধদের বিরুদ্ধে আইনি পথ নিতে এত সময় ব্যয় করলেন? আমি জানি, তারা বলবেন, আমাদের লোকবল কম, ফলে ঠিক সময়ে পদক্ষেপ নেওয়া যায়নি। লোকবল কম হলে এখন কী করে ব্যবস্থা নেবেন? আরও অনেক প্রশ্নই উঠে আসতে পারে। ৭ হাজার অবৈধ লোকের মধ্যে ৫ হাজারই ভারতীয়। এত বিপুলসংখ্যক অবৈধ ভারতীয় আমাদের দেশে থাকছে, অথচ সরকার নিশ্চুপ।
আরও জানা গেছে, গত সাত মাসে (জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত) বিদেশি নাগরিকদের কাছ থেকে জরিমানা আদায় করা হয়েছে প্রায় ৪০ কোটি টাকা। ৩১ জুলাই থেকে ৬ আগস্ট পর্যন্ত তাদের কাছ থেকে জরিমানা আদায় করা হয় ৩৯ লাখ ২ হাজার টাকা। এর মধ্যে আয়কর ১০ লাখ এবং অতিবাসের ঘটনায় বাকি টাকা আদায় করা হয়েছে। এদিকে জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত অতিবাসের ক্ষেত্রে ৭৬৭ জন বিদেশি নাগরিক জরিমানা দিয়েছেন ২১ কোটি ২ লাখ ৭১ হাজার ৪০০ টাকা। একই সময়ে আয়কর বাবদ বিদেশি নাগরিকদের কাছ থেকে জরিমানা আদায় করা হয়েছে ১৮ কোটি ৩২ লাখ ৩৩ হাজার টাকা। আয়কর বেশি দিয়েছেন চীনা নাগরিকরা।
এতেই কি আমরা, আমাদের সরকার খুশি? নাকি আরও দায়িত্বশীল হয়ে দেশের জন্য, দেশের বেকারদের জন্য চাকরির ব্যবস্থা নেবেন?
আমাদের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জোর গলায় দাবি করছেন, দেশের আইনশৃঙ্খলা বেশ উন্নত হয়েছে। সেই দাবি কতটা সত্য, সেটা যাচাই করা জরুরি। আমরা মনে করি, ১৮ কোটি মানুষের দেশে কমপক্ষে চার-পাঁচ লাখ পুলিশ প্রয়োজন। বিভিন্ন খাতকেন্দ্রিক পুলিশের সাইনবোর্ড থাকলেই হবে না, তাদের কার্যকরভাবে পরিচালনা করাও প্রয়োজন। গত এক বছরে পুলিশের রাজনৈতিক ব্যবহার কমে শূন্যের কোঠায় নেমেছে। এখন আর এটা বলা যাবে না যে, পুলিশ ট্রমাটাইজ্ড। আমরা আশা করতে চাই, বৈধ ও অবৈধ উভয় তরফের দক্ষ-অদক্ষ বিদেশি কর্মী পর্যায়ক্রমে বিদায় করে দেশের শিক্ষিত ও কারিগরিভাবে দক্ষ ও প্রযুক্তিগতভাবে উপযুক্ত বেকারদের জন্য চাকরির সুযোগ করে দিতে পারে সরকার। আমি মনে করি, শিক্ষিত বেকারদের কারিগরি প্রশিক্ষণের পর কাজে নিয়োগ করার ব্যবস্থা সরকার নেবে। নিয়োগ কর্তৃপক্ষ অদক্ষ জনবলকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে চাকরিতে সচল করতে পারে। বিদেশে অদক্ষ জনবলকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কাজের উপযুক্ত বা দক্ষ করে তোলার নিয়ম ও আইন চালু আছে। দয়া করে দেশের জন্য এ কাজগুলো করেন। তাতে দেশপ্রেমও দেখানো যাবে, দেশের বেকার সমস্যারও কিছুটা হলেও সমাধান হবে। তবে তা রাতারাতি হবে না। আগামী এক বছরের জন্য এ প্রকল্প নেওয়া হোক-এ দাবি করছি।
সামনে নির্বাচন। অবৈধরা যে নাশকতার পরিকল্পনা করেনি বা করছে না, তা কেউ হলফ করে বলতে পারবেন? বিশেষ করে ভারতীয় অবৈধরা? শেখ হাসিনা ও তার লেসপেন্সারগণ এদেরই ব্যবহার করতে পারেন, তাই সতর্কতা দরকার।
ড. মাহবুব হাসান : কবি, সিনিয়র সাংবাদিক
