Logo
Logo
×

ঘরে বাইরে

ভ্রমণ

মন হারিয়ে মনপুরায়

Icon

মুহাম্মদ জাভেদ হাকিম

প্রকাশ: ২২ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মন হারিয়ে মনপুরায়

হুট করেই মাথায় এলো মনপুরা যাব। এরপরও একে একে দে-ছুট ভ্রমণ সংঘের চারজন দামাল জুটে গেল। ভর সন্ধ্যায় সদরঘাট থেকে জাহাজ ছাড়ল। যেতে যেতে জাহাজ মেঘনার বুকে। রাতের আকাশে জ্বলজ্বল করছিল ভরাট আকৃতির চাঁদ। পূর্ণিমার আলোয় চারপাশ ছিল ফকফকা। জোছনার বিকিরণে মেঘনার বুকে আগুন লেগেছিল। থইথই পানিতে আলোর চমৎকার প্রতিচ্ছবি। দূরের মাছধরা ডিঙি নৌকাগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। চাঁদ মামা এতটাই মুগ্ধ করল যে, জাহাজের ছাদে উঠতে বাধ্য করাল। অসাধারণ একটি জোছনা রাত। অনেকটা সময় চুটিয়ে আড্ডা মেরে মাঝ রাতে কেবিনে ফিরিয়াই একঘুমে রাত পার। মনপুরা তুলাতুলী ঘাটে জাহাজ নোঙর ফেলে। কেবিন বয়দের ডাকাডাকি। ব্যাগ গুছিয়ে নেমে যাই। পন্টুন থেকেই চোখ যায় তীরে। বাহ কাকডাকা ভোরে ঘাটের চারপাশটার প্রকৃতি বেশ লাগছে। মাটিতে পা রাখতেই ভাড়ায়চালিত মোটরসাইকেল চালকরা ঘিরে ধরল। মনপুরা ঘুরব মন খুলে। তাই মাথায় ছিল না কোনো ছকবাঁধা জায়গার নাম। বাইকারদের সঙ্গে আলাপ করেই চেপে বসলাম। যেতে যেতে ফকিরের দোন নদীর ঘাট পর্যন্ত গেলাম। জায়গাটা খুবই সুন্দর। পরিপক্ব খাটো খাটো খেজুরগাছে সয়লাব মেঘনার তীরের ফকিরের দোন। বাইক ছেড়ে ফটো তোলায় ব্যস্ত সবাই। এর মধ্যেই স্থানীয় বাসিন্দা সামসুদ্দিনের সঙ্গে পরিচয়। সেই সূত্রে তার পরিচিত এক জেলে নৌকায় চড়ে বসলাম। জানি না ভাগ্য মনপুরার কোথায় কোথায় ঘুরায়। জোয়ার আসতেই নৌকা ছাড়ল। মাঝি সর্দার হারুন বিরাট ভাব নিয়া জাল সাইজ করায় ব্যস্ত। নদীর গভীরে যেতেই জাল ফেলতে শুরু করল। দিনব্যাপী সারাক্ষণের জন্য কখনো জেলে নৌকায় চড়া হয়নি। পুরাই নতুন অভিজ্ঞতা। কিন্ত সর্দারের ভয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে পারতেছি না। এরপর যারে ডাকুলা ভাবলাম তার সঙ্গেই একটু আধুটু ভাব জমাতে জমাতে পুরাই কাইত কইরা ফেলাইলাম। এবার সর্দার মশাইর ভাব যায় কই। ঘণ্টা দুই পর জাল টানতে শুরু করল। মাছ খুব বেশি পেল না। যা-ই পাইছে তাতেই দে-ছুট বন্ধুরা নিজ হাতে জ্যান্ত ইলিশসহ অচেনা অনেক মাছ জাল থেকে ছাড়াতে পেরে বেজায় খুশি। এমনিভাবে কয়েকবার জাল ফেলে মাছ মারল। মাছ ধরতে ধরতে নৌকা মেঘনার শেষ প্রান্তে। দুপুর গড়াল। আশানুরূপ মাছ জালে না আটকায় নৌকা ফিরতি পথ ধরল। নামার সময় আমরা বেশ কিছু মাছ কিনে সামসু ভাইকে বুঝিয়ে দিলাম। রিজিকে থাকলে দুপুরে আহার হবে এ মাছ দিয়েই। ঘাটের পাশে তার বাড়ি। আমাদেরও করল তার সঙ্গী। এরপরের ইতিহাস ভিন্ন। এক সামসুদ্দিনই পুরো মনপুরা ও এর অধিবাসীদের মুখ উজ্জ্বল করেছে। কথায় আছে না গুষ্টিতে বজ্জাত কিংবা ভালো মানুষ থাকার মতো একটা থাকলেই হয়। যা হোক মোটা লাল চালের ভাত, ইলিশ ভাজা আর গুঁড়া মাছের ঝোল দিয়ে উদোর পূর্তি হলো। বিকালটা ছবির মতো সুন্দর ঈশ্বরগঞ্জ গ্রাম ঘুরে, রাতে মহিষের দই চাখতে চলে গেলাম চৌমুহনী বাজারে। গ্রামের বাজার মানেই, বেকার ও বয়স্কদের আড্ডার মিলনমেলা। ভ্রমণকালীন এসব আড্ডা থেকেও অনেক বিষয় শেখার থাকে। সুন্দর একটি সময় কাটিয়ে ঈশ্বরগঞ্জর শামীমদের বাড়ি চলে এলাম। বাড়িত নয় যেন একটি আদর্শমানের কটেজ। উঠোনেই চলল ক্যাম্পফায়ার আর বারবিকিউ। নানা গাছের ফাঁক গলে চাঁদের আলো শরীরে আছড়ে পড়ে। চুটিয়ে খোশগল্প জমল। রাতের গভীরতা বাড়তেই ঘুমানোর প্রস্তুতি নিই। টিনের চালের ঘর। ঝরা পাতা পড়ার টুপটাপ শব্দ। মৌসুমের প্রথম অপ্রত্যাশিত বৃষ্টি। সব মিলিয়ে বেঘোরে ঘুম। ফজরের আজানের ধ্বনিতে ঘুম ভাঙে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ডাইনিংজুড়ে চিতই পিঠা, ঝোলা গুড় ও নারিকেল কুচি। সকালের নাশতায় এ এক ইউনিক পরিবেশনা। ঘুরতে যাওয়া অঞ্চলের বিশেষ খাবারদাবার সম্পর্কে ধারণা পাওয়াটাও ভ্রমণের ঝুলি সমবৃদ্ধ করে। খেতে খেতে মেঘনার বুকে জোয়ার। ছুটলাম নদীর ঘাটে।

আজকের গন্তব্য কলাতলীচর, ঢালচর ও বদনারচর। প্রথমেই ঢালচর চলল ট্রলার। ঘণ্টাখানেক চলার পরই বোট নোঙর ফেলল। ফাঁকা ময়দান। এগোতে থাকলাম। চোখ আটকাল বিদেশি ফল সাম্মাম খেতে। আরেকটু এগোতেই দেখি প্রচুর হরমুজ ও বাহারি জাতের তরমুজ খেত। এর ফাঁকফোকর দিয়েই আবার মাথা বের করে জানান দিয়েছে ক্ষীরাই। নিজ হাতে ক্ষীরাই ছিঁড়ে খাওয়ার মজাই আলাদা। ধীরে ধীরে আরও এগোনোর পর চোখ পড়ল বিশাল কেওড়া বনে। বন দেখতে পেয়েই যেন প্রাণ ফিরে পেলাম। ঢুকে গেলাম বনে। ওয়াও! প্রচুর ম্যানগ্রোভ। শ্বাসমূল মাড়িয়ে গভীরে ঢুকতে থাকি। এ যেন এক টুকরো সুন্দরবন। যেতে যেতে বনের গহিনে। হরিণের অস্তিত্ব টের পেতেই বাদসাধল নিঃশব্দে সঙ্গী হওয়া শেয়ালের ক্রস কুকুরটা। ওর আক্রমণাত্মক ভূমিকায় হরিণের পাল ভোঁদৌড়। বুঝতে বাকি রইল না এটা সঙ্গে থাকলে, আর যাই হোক হরিণের দেখা পাব না। এদিকে পেটেও টান পড়েছে। যাই ট্রলারে ফিরে। এসে দেখি দুপুরের জন্য, টিনের চুলায় টগবগ করছে খিচুড়ি। নদীর ধারে খোলা আকাশের নিচে সুনসান নীরবতায়, গরম গরম খিচুড়ি খাওয়ার স্বাদ! ওহ কি যে মজার। তা শুধু অব্যক্ত অনুভবই করা যায়। খেয়েদেয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই পৌঁছি কলাতলীচর। তৃণভূমি চরটাতে মহিষের পালসহ অন্যান্য গবাদিপশুর অবাধ বিচরণ। এ রকম দৃশ্য চোখের প্রশান্তি এনে দেয়। কলাতলী দেরি না করে ট্রলার ছুটল বদনার চরের দিকে। যেতে যেতে পড়ন্ত বিকাল। দূর থেকেই চোখে পড়ল হেলে পড়া সূর্যের আলোয়, কেওড়া গাছের বনটা যেন আস্ত একটা আগুনের ফুলকি। নদী পেরিয়ে সরু খালের ভেতর দিয়ে ট্রলার ধীরগতিতে ভেসে চলে। বদনারচর যেন একখণ্ড সবুজ ভূমি। কানে ভেসে আসে বার্কিং ডিয়ারে ডাক। খেকশিয়ালের হুক্কাহুয়া হাকডাক। এখনো জনবসতিহীন বদনারচর। বিচ্ছিন্ন দ্বীপ মনপুরা। সেই মনপুরারই অংশ এ বদনারচর। মুগ্ধ নয়নে ঘুরতে থাকি। ঘুরতে ঘুরতে ভর সন্ধ্যায় হরিণের দেখা পাই। সব মিলিয়ে মাত্র দুদিনের ভ্রমণে মনপুরায় মোর মন হারিয়েছে।

যাতায়াত : ঢাকার সদরঘাট নৌটার্মিনাল থেকে প্রতিদিন বিকালে দুটো জাহাজ মনপুরার উদ্দেশে ছেড়ে যায়।

থাকা খাওয়া : মনপুরার তুলাতুলী ও হাজীরহাট মানভেদে বেশ কিছু আবাসিক ও খাবারদাবারের হোটেল রয়েছে।

ছবি : দে-ছুট ভ্রমণ সংঘ

মনপুরা

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম