Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

আলতাফ

আমি কি ভুলিতে পারি

Icon

প্রকাশ: ২৮ ডিসেম্বর ২০১৭, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি

আমি কি ভুলিতে পারি

ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু ঝরা এ ফেব্রুয়ারি

আমি কি ভুলিতে পারি’

কিংবা,

‘আমরা দেখেছি রক্ত দ্বীপের নিশানা/ আমরা জেনেছি সূর্যের ঠিকানা/ আমরা চলি অবিরাম/ অগ্নি আঁখরে লিখি মোদেরই নাম’

বড় হয়ে নিশ্চয়ই অনেক বড় ক্বারি হবেন, শৈশবে তার দরাজ গলায় মধুর সুরে কোরআন তেলাওয়াত শুনে সবাই এমনটাই ভাবত। গানের সুরে কোরআন তেলাওয়াত করার দায়ে শিক্ষকের বেত্রাঘাত খেয়েছিলেন একদা মক্তবে। হ্যাঁ, সুর। সুরও যে কতটা ভয়ংকর অস্ত্র হতে পারে তা তিনি দেখিয়েছেন আমৃত্যু। উপরের লাইনগুলোর অন্তরালে যে সুর কানে বাজছে সে সুরের অমর স্রষ্টা আলতাফ মাহমুদ। শহিদ আলতাফ মাহমুদ। সুর যার অন্তরে বাসা বেঁধেছিল বাল্যকালের বেঞ্চিতে বসে। ভাটিয়ালি থেকে শুরু করে নানা গীতের ধারায় শৈশবেই মানুষের মন জয় করেছিল যে বালক ঝিলু, সুরের ঐন্দ্রজালিক মায়ায় আর বিদ্রোহের রণ তরঙ্গে একদা তিনিই হয়ে উঠলেন আমাদের আলতাফ মাহমুদ।

শহিদ আলতাফ মাহমুদের জীবনভিত্তিক উপন্যাস ‘আলতাফ’ এর নায়ক আলতাফ মাহমুদকে অনেকটা এমনভাবেই উপস্থাপন করতে চেয়েছেন লেখক অমিত গোস্বামী। আলতাফ মাহমুদের জন্ম ১৯৩৩ সালে বরিশালের মুলাদি উপজেলার পাতারচর গ্রামে। অমর এই জাদুকরের শৈশব সম্পর্কে যতটুকু জানা যায় তার সারসংক্ষেপে শুধু গান পাওয়া যাবে, শিল্পসম্মত এক পরিমণ্ডলে ছুটে বেড়ানো বালক ঝিলুকে পাওয়া যাবে। আর তার পরের গল্প তো আমাদের ইতিহাসে প্রেরণার অনন্য এক আলোকবর্তিকা। ‘আলতাফ’ পড়ে এর লেখকের সঙ্গে আমিও একমত হতে পেরেছি যে, আলতাফ মাহমুদের মতো কোনো মহান চরিত্র নিয়ে উপন্যাস লেখা সত্যিই খুব কঠিন কাজ। কারণ আলতাফ নিজেই এক জীবন্ত উপন্যাস। সে উপন্যাসে গান আছে, সুর আছে, অস্ত্র আছে, যুদ্ধ আছে। আছে নানা শ্রেণীর চরিত্র আর তাদের প্রেম-ভালোবাসা এবং বিশ্বাসঘাতকতার গল্প।

শুধু সুর নয়, গান নয়, আলতাফ মাহমুদ ছিলেন বাঙালির মুক্তির সব আন্দোলন-সংগ্রামে সম্মুখ মিছিলে হেঁটে চলা এক সাহসী যোদ্ধা। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। বাঙালির অধিকার আদায়ের প্রতিটি লড়াইয়ে বীরের মেধায় আর বিচক্ষণ বুদ্ধিমত্তায় সর্বাগ্রে দাঁড়িয়ে ছিলেন যে নায়ক আলতাফ মাহমুদ; ১৯৬ পৃষ্ঠা তার গল্প লিখতে যথেষ্ট কি? উপন্যাস ‘আলতাফ’ দুই মলাটে শহিদ আলতাফ মাহমুদকে ধারণের যে প্রয়াস দেখিয়েছে তাকে সাধুবাদ জানিয়েই বলব- যতটা সত্যিকার আলতাফ এখানে আছেন, একজন আলতাফ মাহমুদ এর চেয়ে অনেক গুণ শক্তিশালী আমাদের বাংলার ইতিহাসে। তবু ‘আলতাফ’-এর এই কাহিনীজুড়ে আমি শহিদ আলতাফ মাহমুদকে চলাফেরা করতে দেখেছি অনেকটাই স্পষ্ট পায়ে। বরিশাল থেকে গানের টানে ঢাকায়। ঢাকা থেকে করাচি সেও গানের টানে। কিংবা দেখতে পেয়েছি আলতাফ মাহমুদের নেতৃত্বে-নির্দেশনায় এইমাত্র বাসা থেকে বেড়িয়ে গেল বিচ্ছুবাহিনী, গেরিলার দল। আর যেটুকু অস্পষ্ট, লেখকের ভাষায়- ‘সেখানে অবশ্যই শোনা কথা ও কল্পনার আশ্রয় নিতে হয়েছে। কারণ আমি ইতিহাসবিদ নই। জীবনী লিখিনি। উপন্যাস লিখেছি। ঔপন্যাসিক কিছু স্বাধীনতা নেবেই।’

রাজারবাগ পুলিশ লাইনের উল্টোদিকে আউটার সার্কুলার রোডের ৩৭০ নম্বর বাসায় ছিল আলতাফ মাহমুদের বাস। ২৫ মার্চ, ১৯৭১। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের পাকসেনারা বেঙ্গল রেজিমেন্টের সব বাঙালি অফিসারদের গ্রেফতার করে নিরস্ত্র করেছে। কিছু অফিসারকে মেরে ফেলা হয়েছে। সুতরাং পরিস্থিতি ভালো না তাই আলতাফ মাহমুদদের নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে বললেন পুলিশ লাইনের পুলিশ। আলতাফ মাহমুদ ঘরের অন্য সদস্যদের নিরাপদ জায়গায় পাঠিয়ে দেন কিন্তু নিজে বাসা ছেড়ে যাননি কোথাও। নিজ চোখে দেখেছেন সেই বীভৎস রাতের ঘটনা। একদা শুধু গানই ছিল যার ধ্যান-জ্ঞান তিনি হয়ে উঠলেন মুক্তিকামী মানুষের আশার কেন্দ্রবিন্দু। ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে নিজ বাসায় গোপন ক্যাম্প গড়ে তুলেছিলেন আলতাফ মাহমুদ। কিন্তু ক্যাম্পের কিছু গেরিলা যোদ্ধা ধরা পড়ায় ফাঁস হয়ে যায় এ গোপন আস্তানার খবর। অস্ত্র আর গোলাবারুদের সন্ধান চালায় পাকিস্তান বাহিনী। আলতাফ মাহমুদকে দিয়ে মাটি খুঁড়ে উদ্ধার করে গোলাবারুদ। সঙ্গীদের সঙ্গে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় বাঙালির সূর্য সন্তান আলতাফ মাহমুদকে। অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয় তাদের। এরপর শুধু প্রতীক্ষা...। শিশু শাওনকে কোলে নিয়ে ঝিনুর প্রতীক্ষা। কথায়-ছন্দে সুরের প্রতীক্ষা, গানের প্রতীক্ষা। এ প্রতীক্ষা কখনওই শেষ হবে না। কখনওই শেষ হবে না একজন আলতাফ মাহমুদের জন্য আমাদের অনন্ত প্রতীক্ষার প্রহর।

আগামীর প্রতিটি সুরে-সংগ্রামে আমাদের অন্তরে চির জাগরুক থাকবেন আলতাফ মাহমুদ। কবীর সুমনের সুরে আমরাও সুর মিলিয়ে বলব- ‘মনে রাখাটাই হয় ইতিহাস একুশে ফেব্রুয়ারি,/বাংলা গানের কসম বলছি আমিই কি ভুলতে পারি?’ হ স ইকবাল মাহফুজ

আলতাফ অমিত গোস্বামী

প্রচ্ছদ ধ্রুব এষ

প্রকাশক বাংলাপ্রকাশ

মূল্য ৩০০ টাকা

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম