Logo
Logo
×

দৃষ্টিপাত

ডাকসু নির্বাচন: নিরাবেগ পর্যালোচনা

নাসির মাহমুদ

নাসির মাহমুদ

প্রকাশ: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৪:৩৫ পিএম

ডাকসু নির্বাচন: নিরাবেগ পর্যালোচনা

নির্বাচনে ভিপি, জিএস, এজিএসসহ ২৮টি পদের মধ্যে ২৩টিতেই বিজয়ী হয়েছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট। ছবি: সংগৃহীত

অবশেষে সকল জল্পনা-কল্পনার ইতি ঘটলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে বিজয় লাভ করলো ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট প্যানেল। আমি বিজয়ীদের অভিনন্দন জানাই এবং যারা এবার বিজয়ী হতে পারে নি তাদেরকেও ভবিষ্যত বিজয়ের আগাম শুভেচ্ছা জানাই। তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক, সৌহার্দ্য আগের মতোই অটুট থাকুক-এই প্রত্যাশা করি। এ বিজয়কে ‘ঐতিহাসিক’ বললে অতিশয়োক্তি হবে না হয়তো। 

তবে ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট প্যানেলের প্রতিন্দ্বন্দ্বী ছাত্রদলের জন্য এই ফলাফল ভাববার অবকাশ রাখে। কে না জানে এই জোট ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত। বলাবাহুল্য! শিবিরের তরুণ নেতারা যে কৌশলে, যে পন্থায় নির্বাচনকে সামনে রেখে ছাত্রসচেতনতামূলক সৃষ্টিশীল ক্যাম্পেইন বা প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছে তা মেধাবি ছাত্রদের পাশাপাশি পুরো দেশবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। ছাত্রদলের সন্তানতুল্য অনুজেরা আশা করি এই পর্যালোচনাকে ইতিবাচকভাবে নিয়ে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত হবে।

কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অপরিহার্য বলে মনে করি। আমরা সবাই জানি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ শিরস্ত্রাণধারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। শিক্ষার পাশাপাশি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে দেশের সকল ক্রান্তিলগ্নে মোড় ঘুরানো অনন্য সাধারণ ঐতিহাসিক ভূমিকা। বাংলাদেশের অভ্যুদয় থেকে শুরু করে নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী সফল আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষাব্যবস্থাসহ জাতীয় রাজনীতির নেতৃত্বে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি। 

এই ভূমিকার বিষয়টি অবশ্য বাংলাদেশের মানুষ কমবেশি জানে। সাম্প্রতিককালে মানে চব্বিশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানও সংঘটিত হয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের প্রাগ্রসর ভূমিকার কারণে। ডাকসু নির্বাচনে ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট প্যানেলের বিজয় প্রসঙ্গে এই অভ্যুত্থান প্রাণ সঞ্চারী ভূমিকা রেখেছে। ডাকসু নির্বাচনের ফলাফল আবারও জানিয়ে দিয়েছে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের প্রেরণা এখনও আগের মতোই যোদ্ধাদের শিরায় শিরায় রক্তের মতোই প্রবহমান।

চব্বিশে কী ঘটেছিল-সেটা সবারই জানা। শাসকগোষ্ঠিকে স্বৈরাচার তকমা দিয়েছে আন্দোলনকারীরা। তাদের সঙ্গে সুর মিলিয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষ। দল-মত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আপামর জনগোষ্ঠি ওই আন্দোলনে প্রাণবাজি রেখে যুক্ত হয়েছে এবং বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানের উত্তরসূরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনরোষের মুখে দেশত্যাগ করেছেন। বাংলাদেশের শান্তিকামী  মানুষ বিজয় উল্লাসে সারাদেশের হাটে-ঘাটে-মাঠে রাজপথে নেমে এসেছে। এক অক্টোপাসি শৃংখল থেকে হাঁফ ছেড়ে বাঁচার আনন্দ প্রকাশ করেছে জনগণ। 

ওই বিজয়ের পাশাপাশি শাসকদল আওয়ামী লীগের চিহ্নিত নেতা-কর্মীরা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে, অনেক নেতা গ্রেফতার হয়ে কারাগারে গেছেন এবং আরও অনেকেই গা ঢাকা দিয়ে আছেন। আওয়ামীলীগের গুণকীর্তন কিংবা সমালোচনা করা আমার উদ্দেশ্য নয়। বরং যেসব কারণে সর্বস্তরের জনগণ শেখ হাসিনার শাসনের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছিল সেই কারণগুলো ডাকসু নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের সমীকরণ তৈরি করেছে নি:সন্দেহে-এই বাস্তব সত্য তুলে ধরাই লক্ষ্য। 

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গিয়ে যা যা করেছে তার ফিরিস্তি অনেক লম্বা। প্রতিবেশি একটি দেশের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত সেই শাসনকালকে কেউ ইতিবাচকভাবে দেখে নি, দেখছে না এবং দেখবেও না কোনোদিন। কেননা আমাদের দেশ অনেকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং ক্ষতির সেই ক্ষত সারতে প্রচুর সময় লাগবে। দুর্নীতি, রাজনৈতিক স্বজনপ্রীতি, লুটপাট, অর্থপাচার, নীতি-নৈতিকতাহীনতা, দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দেওয়া, সার্বভৗমত্ব ধ্বংস করা, সামরিক এবং নিরাপত্তা কাঠামোসহ সকল ক্ষেত্রেই দেশের স্বার্থ বিনষ্ট করার মতো দু:খজনক পরিস্থিতি সৃষ্টির কথা সবারই জানা। আয়নাঘরের মতো চমৎকার একটি পরিভাষা এখন এক আতঙ্কের উদাহরণ। নিরাপত্তা পরিস্থিতির কথা কী আর বলবো। বিরোধী দল-মত নিধনের বিষয়টি তো আপনারা আমার চেয়েও ভালো জানেন। বিজ্ঞজনেরা তো আইয়্যামে জাহেলিয়াতের মতো বলতে শুরু করেছিল আওয়ামি জাহেলিয়াত। ডাকসু নির্বাচনের ফলাফলের সঙ্গে এই বর্ণনার যোগসূত্র কী? নিশ্চয়ই এরকম প্রশ্ন আপনাদের মনে জাগছে। হ্যাঁ! যোগসূত্র আছে।

দেশকে বিভক্ত করে রেখে দুর্বল কাঠামোর সুযোগ নিয়ে প্রতিবেশি রাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে স্বার্থ হাসিল করেছে। আওয়ামী লীগ সেই সুযোগ করে দিয়েছে। কীভাবে? যেহেতু তারা নির্বাচিত সরকার ছিল না, সুতরাং তারা জানতো জনগণ তাদের সঙ্গে নেই। সে কারণে তাদের নেপথ্য শক্তি জুগিয়েছে প্রতিবেশি রাষ্ট্র ভারত। বিনিময়ে তাদেরকে যা দিয়েছেন শেখ হাসিনা 'চিরকাল ভারত তা স্মরণ রাখবে' বলে মন্তব্য করেছেন স্বয়ং তিনিই। আমার দেশ ভারতের মাধ্যমে স্বাধীন হওয়ার খেসারত পঞ্চান্ন বছর ধরে দিয়ে এসেছে। তারা আরও চায়। তাদের চাওয়া চরিতার্থ করার জন্য আমাদের দেশটাকে অস্থির এবং বিভক্ত করে রেখেছে ভারত। 

এই বিভাজন সৃষ্টির সুযোগ তারা পেয়েছে আমাদেরই কতিপয় রাজনৈতিক দল এবং তাদের আদর্শের পরিবর্তে ক্ষমতারোহনের লোভের সুযোগে। যেসব দল সেই লোভ সংবরণ করতে পারে  নি তাদের শীর্ষে ছিল আওয়ামী লীগ। দেশের মানুষের ভালোবাসার পরিবর্তে বিদেশি শক্তির ওপর ভরসা করে নিজের দেশের যে পরিমাণ ক্ষতি করা হয়েছে তা ইতিহাসে বিরল। তারা দেশের মানুষের মাঝে বিভাজন সৃষ্টির জন্য যেসব কৌশল অবলম্বন করেছে, একটা সময় জনসাধারণ ওই কৌশলটাকে অগ্রাহ্য করে ফুঁসে উঠেছে। 

ক্ষমতার লোভে অন্ধ হয়ে সন্তানতুল্য নিরস্ত্র ছাত্রদের ওপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চালানো হয়েছে। অতিষ্ঠ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শীর্ষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা শ্লোগান দিয়েছে: ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার‘। ‘কে বলেছে কে বলেছে স্বৈরাচার, স্বৈরাচার’। ওই ঘৃণিত শ্লোগান সারা দেশের মানুষ গ্রহণ করেছে। বিভাজনের ‘রাজাকার আর পাকিস্তানী’ ট্যাগ দেওয়ার ভারতীয় টোটকা সেদিনই যে অকার্যকর হয়ে গেছে সেটা বুঝতে পারে নি সেদিনের স্বৈরাচার। পেশিশক্তি এবং ট্যাগের রাজনীতির কবরও সেদিন রচিত হয়ে গেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ বা ডাকসু নির্বাচনে যারা মেয়াদোত্তীর্ণ তারিখের জনপরিত্যক্ত সেই অগ্রহণযোগ্য টোটকা সেবন করেছে তারা আপামর জনতার হৃদস্পন্দন বুঝে উঠতে পারে নি।

শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মতো এতো জনপ্রিয় নেতা বাংলাদেশে এখনও আসে নি। সেই জিয়াউর রহমানের গড়া দলের ছাত্র সংগঠনের এরকম পরাজয় কেউ প্রত্যাশা করেনি। মুখে কিছু প্রকাশ না করলেও নীরবে ভোট দিয়ে দেশের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্ররা তাদের হৃদস্পন্দন বুঝে না ওঠার পরম সত্যই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। ভবিষ্যতেও জাতীয় রাজনীতিতে বিশেষ করে আসন্ন সংসদ নির্বাচনে এই সত্য যারা উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে না-তাদের পরিণতিও অভিন্ন হতে বাধ্য। 

এখন থেকে আর কে পাকিস্তানী আর কে ভারতীয়-এই বিভাজনের রাজনীতি নয়, আসুন আমরা সবাই বাংলাদেশি হয়ে উঠি। দেশকে ভালোবাসি। ক্ষমতার দাপটে ন্যায়-অন্যায় ভুলে না যাই। মিনিস্টার শব্দের অর্থ ছিল ভৃত্য। কিন্তু মিনিস্টারদের কার্যক্রমে এখন সেই অর্থ পাল্টে যেতে বসেছে। দায়িত্ব পেয়ে মানুষের সেবায় এগিয়ে আসার মানসিকতা তৈরি হোক নেতৃবৃন্দের মাঝে। ভালোবেসে ভালোবাসা পাবার যোগ্যতা সৃষ্টি করাই হবে দেশ ও জাতির কল্যাণের নেপথ্য প্রেরণা।

বিজয়ী প্যানেলকে বলবো: তোমরা এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ছাত্র-ছাত্রীর দায়িত্বশীল। সুতরাং উল্লাস-উচ্ছ্বাসের পরিবর্তে সবাইকে সাথে নিয়ে প্রতিশ্রুতি পূরণে কাজে লেগে পড়ো। অন্যান্য প্যানেলের মেধাবীদেরকেও সসম্মানে কাজে লাগাও। তোমাদের আচরণ হোক অন্যদের জন্য আদর্শ স্থানীয়। প্রতিষ্ঠিত সব অপবাদের শেকড় উপড়ে যাক, সত্য প্রতিষ্ঠিত হোক তোমাদের আচরণে। মনে রেখো! দায়িত্ব কোনো উপভোগের বিষয় নয় বরং একটি পরীক্ষার বোঝা। বহন করতে না পারলে জবাবদিহিতা করতে হবে নিশ্চিত। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে আল্লাহর সাহায্য কামনা করো। ‌

‘মুই কি হনু রে’ ভাব যেন তোমাদের মাঝে না আসে-তাহলে ধ্বংস নিশ্চিত। যারা এবার আশানুরূপ জয় পাওনি তোমরা ভবিষ্যতে জয়ের লক্ষ্যে বিজয়ী বন্ধুদের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দাও। তোমাদের বিজয়ে তারাও যেন এগিয়ে যাবার প্রেরণা পায়। এভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আরেকবার হয়ে উঠুক সারা দেশের জন্য আদর্শ দৃষ্টান্ত। প্রতিশোধ কিংবা প্রতিহিংসা নয়, দেশ ও জাতি গঠনের মতো ভালো কাজে প্রতিযোগিতার মানসিকতা গড়ে তোলো নিজেদের ভেতর। 

নাসির মাহমুদ

চ্যানেল তেহরান, ইরান।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম