সবুজ অর্থনীতি গড়ার পথে এগ্রি-পিভি: সম্ভাবনা ও করণীয়
প্রকাশ: ২০ অক্টোবর ২০২৫, ০৩:৩০ এএম
প্রতীকী ছবি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের বর্তমান প্রেক্ষাপটে “সবুজ অর্থনীতি” একটি সময়োপযোগী ধারণা হয়ে উঠেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত, ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদা এবং কৃষিজমির উপর চাপ, সব মিলিয়ে এখন এমন একটি মডেল প্রয়োজন যা একসঙ্গে শক্তি উৎপাদন, কৃষি উৎপাদন এবং পরিবেশ রক্ষা নিশ্চিত করতে পারে। এই ত্রিমাত্রিক সমাধানের একটি নবীন ধারণা হলো এগ্রি-পিভি (Agri-PV) মডেল, অর্থাৎ কৃষি ও সৌর শক্তির সমন্বিত ব্যবহার।
এগ্রি-পিভি কী?
এগ্রি-পিভি বা Agrivoltaics হচ্ছে এমন একটি প্রযুক্তি ও উন্নয়ন মডেল যেখানে একই জমিতে ফসল উৎপাদন এবং সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন একসাথে করা যায়। সহজভাবে বললে, কৃষিজমির উপরে সৌর প্যানেল স্থাপন করা হয় এমনভাবে যাতে সূর্যের আলো দুই জায়গায়ই, ফসল ও প্যানেলে পৌঁছায়। এটি “Dual Land Use” বা দ্বৈত জমি ব্যবহার মডেল হিসেবে বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় হচ্ছে।
চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়ায় এবং সম্প্রতি ভারতে এই মডেলের সফল প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে। এখন বাংলাদেশেও কয়েকটি পাইলট প্রকল্প যেমন জামালপুর, পাবনা ও কক্সবাজারে শুরু হয়েছে।
বাংলাদেশে কেন এগ্রি-পিভি গুরুত্বপূর্ণ:
১. কৃষিজমির সংকট
বাংলাদেশের মোট ভূমির প্রায় ৬০ শতাংশ কৃষি কাজে ব্যবহৃত হলেও প্রতি বছর প্রায় ১ শতাংশ জমি নগরায়ণ ও শিল্পায়নের কারণে হারিয়ে যাচ্ছে। নবায়নযোগ্য শক্তি স্থাপনের জন্য আলাদা জমি নেওয়া হলে খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়বে। এগ্রি-পিভি মডেল সেই দ্বন্দ্বের সমাধান দিতে পারে, একই জমি থেকে শক্তি ও খাদ্য দুটোই পাওয়া যাবে।
২. জ্বালানি আমদানি নির্ভরতা কমানো
বাংলাদেশ বর্তমানে প্রাকৃতিক গ্যাস ও আমদানি করা বিদ্যুৎ নির্ভর। সৌর শক্তির ব্যবহার বাড়ালে বৈদেশিক মুদ্রার চাপ কমবে। এগ্রি-পিভি প্রকল্পগুলো স্থানীয়ভাবে শক্তি উৎপাদনে সহায়তা করতে পারে, বিশেষ করে গ্রামীণ অঞ্চলে।
৩. গ্রামীণ অর্থনীতির পুনর্জাগরণ
এগ্রি-পিভি মডেল স্থানীয় কৃষক ও উদ্যোক্তাদের জন্য নতুন আয়ের উৎস তৈরি করতে পারে। কৃষকরা জমি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ বিক্রি করতে পারবেন, পাশাপাশি ফসল চাষও চালিয়ে যেতে পারবেন।
৪. জলবায়ু সহনশীল উন্নয়ন
এই মডেল কৃষি ও শক্তি, উভয় ক্ষেত্রেই কার্বন নির্গমন হ্রাস করে। একই সঙ্গে প্যানেলের ছায়ায় কিছু ফসল যেমন টমেটো, আদা, মরিচ, ফুল বা পাতা জাতীয় সবজি ভালোভাবে উৎপন্ন হয়, যা গরম মৌসুমে কৃষকদের জন্য বাড়তি লাভের সুযোগ এনে দেয়।
চীনের অভিজ্ঞতা: শেখার উপকরণ
চীন এগ্রি-পিভি মডেলকে “স্মার্ট গ্রিন এগ্রিকালচার” হিসেবে রূপ দিয়েছে। শানডং, আনহুই, হাইনান ও গানসু প্রদেশে হাজার হাজার একর জমিতে সৌর প্যানেলের নিচে আঙুর, গম, শাকসবজি ও ঔষধি গাছ চাষ করা হচ্ছে।
চীনে এখন প্রায় ২ গিগাওয়াটের বেশি সৌর কৃষি প্রকল্প চলমান। শুধু বিদ্যুৎ নয়, সেখানে প্রযুক্তি ব্যবহার করে পানি ব্যবস্থাপনা, ড্রিপ সেচ ও ডিজিটাল মনিটরিংও হচ্ছে।
বাংলাদেশ এই অভিজ্ঞতা থেকে নীতি, প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ কাঠামো নিতে পারে, বিশেষ করে কৃষকদের অংশগ্রহণমূলক মডেল গড়ে তুলতে।
অর্থনৈতিক সম্ভাবনা:
একটি ১ মেগাওয়াট ক্ষমতার এগ্রি-পিভি প্রকল্প বছরে প্রায় ১৪–১৫ লক্ষ ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে, যা স্থানীয় গ্রিড বা মাইক্রো-গ্রিডে সংযুক্ত করা সম্ভব। এতে প্রতি ইউনিটে ৯–১০ টাকা আয় ধরা হলে বছরে প্রায় ১.৩–১.৫ কোটি টাকা রাজস্ব আসতে পারে। ফসল উৎপাদনের অতিরিক্ত আয় কৃষকের হাতে যাবে। জমির মালিক, স্থানীয় কমিউনিটি ও বিনিয়োগকারীরা লাভ ভাগাভাগি করতে পারে, যাকে বলা হয় Energy Sharing Model.
ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা:
-জাতীয় নবায়নযোগ্য শক্তি নীতিতে এগ্রি-পিভি অন্তর্ভুক্ত করা।
-BRAC, BARI ও BUET-এর মতো প্রতিষ্ঠানের গবেষণার সঙ্গে পাইলট প্রকল্প যুক্ত করা।
-কৃষক-বিনিয়োগকারী অংশীদারিত্ব (PPP Model) গড়ে তোলা।
-কারিগরি প্রশিক্ষণ ও স্থানীয় উদ্ভাবন কেন্দ্র (Agri-Solar Lab) স্থাপন করা।
-নারী কৃষক ও যুব উদ্যোক্তাদের এই খাতে অন্তর্ভুক্ত করা।
এগ্রি-পিভি কোনো কল্পনাভিত্তিক ধারণা নয়, এটি এমন এক বাস্তব সমাধান যা বাংলাদেশের কৃষি, জ্বালানি ও পরিবেশ, তিন ক্ষেত্রেই পরিবর্তন আনতে পারে। এটি শুধু নবায়নযোগ্য শক্তির নয়, বরং সবুজ অর্থনীতির ভিত্তি গড়ার পথ।
যদি এখন থেকেই নীতিগত সহায়তা, বিনিয়োগ উৎসাহ এবং কৃষক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যায়, তাহলে এক দশকের মধ্যেই বাংলাদেশ নিজস্ব ‘Green Growth Model’ হিসেবে এগ্রি-পিভিকে বিশ্বের সামনে উপস্থাপন করতে পারবে। এই মডেলই হতে পারে “এক জমি, দুই ফসল: খাদ্য ও বিদ্যুৎ” বাংলাদেশের টেকসই অর্থনীতির প্রতীক।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (সিজিডি) ও পিএইচডি গবেষক

