দোলাচলে বিশ্ব অর্থনীতি, স্থিতিশীলতার আড়ালে আসন্ন ঝড়
প্রকাশ: ২১ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:৫২ পিএম
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ওয়াশিংটনের শরৎচঞ্চল আকাশে যখন পত্রমর্মর বাজছে, তখন বিশ্বের অর্থনীতিও যেন এক অনিশ্চিত হাওয়ার দোলায় টালমাটাল। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (IMF) প্রধান ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা সম্প্রতি সতর্ক করেছেন ‘বাকল আপ (Buckle up)!’
তার কণ্ঠে সতর্কতার সঙ্গে লুকিয়ে ছিল এক ভবিষ্যদ্বাণী ‘অনিশ্চয়তাই এখন নতুন স্বাভাবিক’, এবং এই অনিশ্চয়তা সাময়িক নয়, দীর্ঘস্থায়ী হতে চলেছে।
বিশ্ব অর্থনীতি আপাতদৃষ্টিতে এখনো টিকে আছে অথচ এই স্থিতিশীলতার ভিত কতটা ভঙ্গুর, তা পরিমাপ করা যাচ্ছে না।
ট্রাম্প প্রশাসনের একের পর এক শুল্কযুদ্ধ, জ্বালানি বাজারের উথালপাথাল, বৈশ্বিক ঋণের ক্রমবর্ধমান চাপ সব মিলিয়ে অর্থনৈতিক দিগন্তে জমেছে কালো মেঘ। তবুও, আশ্চর্যভাবে, প্রবৃদ্ধির হার এখনো প্রায় তিন শতাংশে টিকে আছে।
এই দৃশ্য যেন এক দাউদাউ জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের পাশে স্থির বসে থাকা শান্ত জলের পাত্র শান্ত, কিন্তু সম্ভাব্য বিস্ফোরণমুখর। জর্জিয়েভার ভাষায়, ‘গ্লোবাল রেজিলিয়েন্স এখনো পুরোপুরি পরীক্ষিত হয়নি।’
হয়তো সেই পরীক্ষা ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে যখন সোনার দাম ইতিহাসের সর্বোচ্চে পৌঁছে যায়, বিনিয়োগকারীরা নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে বেড়ায়, আর ডলার হারায় তার দৃঢ়তা।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘আমদানি শুল্ক যুদ্ধ’ এখন আর শুধুই অর্থনৈতিক নীতি নয়; এটি একধরনের ভূ-রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শন। কানাডা থেকে চীন, মেক্সিকো থেকে ব্রাজিল কেউই রেহাই পায়নি।
এমনকি ক্ষুদ্র আফ্রিকান দেশ লেসোথোও এই বাণিজ্যবাজির বলি। ট্রাম্পের নিজস্ব সংলাপ ‘আমরাই সবচেয়ে বেশি শুল্কে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার রাজা’ যেন বিশ্বের বাকি অংশের জন্য এক বিদ্রুপের প্রতিধ্বনি।
এদিকে মার্কিন ঋণ আজ ৩৭ ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি, যা এক শতাব্দীতে প্রায় একশো গুণ বেড়েছে। কংগ্রেসনাল বাজেট অফিস ইতিমধ্যে সতর্ক করেছে, নতুন কর ও ব্যয়ের নীতির কারণে আগামী দশকে এই বোঝা আরও ৩.৪ ট্রিলিয়ন ডলার বাড়বে।
এমন এক অর্থনৈতিক দানবকে নিয়ন্ত্রণে আনাই এখন আমেরিকার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ, কিন্তু নির্বাচনমুখী রাজনীতির চাপে এই ঋণ নীতিকে কেউই ছুঁতে চায় না।
তরুণ প্রজন্মের হতাশা আজ বৈশ্বিক। লিমা থেকে রাবাত, প্যারিস থেকে নাইরোবি, কাঠমান্ডু থেকে জাকার্তা যেখানেই চোখ যায়, তরুণেরা রাস্তায় নেমেছে, তাদের কণ্ঠে এক যৌথ আর্তি ‘আমাদের ভবিষ্যৎ কোথায়?’
জর্জিয়েভা যথার্থই বলেছেন, ‘আজকের তরুণেরা জানে তারা হয়তো আর তাদের পিতামাতার চেয়ে বেশি আয় করতে পারবে না।’ এই অর্থনৈতিক স্থবিরতা শুধু সংখ্যা বা সূচকের সমস্যা নয়, এটি এক প্রজন্মের ভাঙা স্বপ্নের প্রতীক।
আইএমএফ প্রধানের ভাষণ যেন বিশ্ব রাজনীতির এক আয়না যেখানে অর্থনীতি, সমাজ, রাজনীতি ও মনোবিজ্ঞান একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। তিনি আহ্বান জানিয়েছেন এশিয়াকে তার ভেতরের বাণিজ্য জোরদার করতে, আফ্রিকাকে ব্যবসাবান্ধব সংস্কার আনতে এবং ইউরোপকে প্রতিযোগিতায় ফিরে যেতে। আর যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি তাঁর বার্তা আরও স্পষ্ট ঋণ কমাও, সঞ্চয় বাড়াও, নইলে তোমার অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য কাগজের দুর্গে পরিণত হবে।
তবে এই সব পরামর্শের পেছনে লুকিয়ে আছে এক মৌলিক প্রশ্ন বিশ্ব অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ এখনো কি মানুষের হাতে, নাকি আমরা কেবল বাজারের অদৃশ্য স্রোতে ভেসে চলেছি? ডলার, স্বর্ণ, বাণিজ্য, ঋণ সবই যেন এক বিশাল নাট্যমঞ্চের চরিত্র, যেখানে প্রত্যেকে নিজের ভূমিকায় বন্দী, কিন্তু কোনো পরিচালক নেই।
জর্জিয়েভার “Uncertainty is the new normal” উচ্চারণ তাই কেবল একটি অর্থনৈতিক মন্তব্য নয়; এটি সময়ের প্রতি এক ভবিষ্যদ্বাণী। হয়তো আমরা এমন এক যুগে প্রবেশ করছি যেখানে স্থিতিশীলতা মানেই মায়া, আর অনিশ্চয়তাই একমাত্র বাস্তব।
লেখক: শিক্ষার্থী, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, কায়রো, মিশর।
তথ্যসূত্র: আল জাজিরা

