শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিং : বর্তমান চ্যালেঞ্জ ও করণীয়
তাইফুর রহমান
প্রকাশ: ০৩ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বাংলাদেশে ইসলামিক বা শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক ব্যবস্থার উত্থান আশাব্যঞ্জক। প্রথাগত সুদভিত্তিক ব্যাংক ব্যবস্থার বিকল্প হিসাবে এটি মানুষের আস্থা অর্জন করেছে। তবে এ খাতের বিকাশে এখনো কিছু উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ রয়েছে; যেগুলো নিরসন না হলে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো কঠিন হবে।
বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে মানবসম্পদের ঘাটতি উল্লেখযোগ্য। শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিং-সম্পর্কিত বিশেষজ্ঞ, শরিয়াহ পরামর্শক এবং ইসলামিক ফিন্যান্সে দক্ষ কর্মী সংখ্যা এখনো অপ্রতুল। শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিং চালাতে হলে শুধু ব্যাংকিং বিষয়ে ধারণা থাকলেই হয় না, এর পাশাপাশি ইসলামিক শরিয়াহ, বিশেষ করে মুআমালাত (আর্থিক লেনদেন) বিষয়েও গভীর জ্ঞান থাকতে হয়। কিন্তু আমাদের দেশে ইসলামিক ফিন্যান্স নিয়ে উচ্চশিক্ষার সুযোগ সীমিত। বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম খুব কম এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ইসলামি ব্যাংকিংয়ের ওপর গবেষণাও সীমিত। ফলে ব্যাংকগুলো প্রায়ই দক্ষ জনবল পেতে হিমশিম খায়। অনেক সময় দেখা যায়, ব্যাংকের ‘শরিয়াহ পরামর্শক’ হিসাবে নিযুক্ত ব্যক্তিরা শুধু ধর্মীয় দিকটা জানেন। অথচ আধুনিক ব্যাংকিং কাঠামো সম্পর্কে ধারণা নেই; ফলে বাস্তবায়নে দ্বিধা তৈরি হয়।
সম্ভাব্য সমাধান হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসা পর্যায়ে সমন্বিত কোর্স চালু করা যেতে পারে। ইসলামি আর্থিক ব্যবস্থার ওপর বিশেষ ডিপ্লোমা, স্নাতক ও মাস্টার্স প্রোগ্রাম শুরু করলে বাস্তবায়ন সহজ হবে। ব্যাংকগুলোর নিজস্ব প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটগুলো শরিয়াহ পরিপালন, প্রোডাক্ট ডিজাইন ও রিস্ক ম্যানেজমেন্টে দক্ষতা তৈরির লক্ষ্যে ঢেলে সাজানো যেতে পারে। আন্তর্জাতিক ইসলামি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অংশীদারত্ব-AAOIFI, IIFM, IRTI ইত্যাদির সহযোগিতায় প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম চালু করা যেতে পারে। শরিয়াহ বোর্ডের সদস্যদের জন্য নিয়মিত আপডেট কোর্স করানো, যেন তারা ব্যাংকিংয়ের চলমান পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারেন।
গ্রাহকসেবার মানোন্নয়ন ও কাস্টমাইজড সার্ভিসের ক্ষেত্রে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিংয়ে শুধু ধর্মীয় দিক নয়, গ্রাহক অভিজ্ঞতাকেও গুরুত্ব দিতে হবে। বহু মানুষ এখনো ইসলামি ব্যাংকিং সম্পর্কে সঠিক ধারণা রাখে না। ফলে তারা আগ্রহ হারিয়ে ফেলে বা ভুল ধারণা পোষণ করে। অনেক মানুষ এখনো মনে করেন, ইসলামি ব্যাংক মানে শুধু নাম পালটানো-মূলত সুদই নেওয়া হয়, শুধু অন্য নামে। এ ধরনের ভুল ধারণা ইসলামি ব্যাংকিং সিস্টেমকে অবমূল্যায়িত করে।
গ্রাহকের বড় অংশ জানেই না মুরাবাহা, ইজারা, মুদারাবা বা মুশারাকা কীভাবে কাজ করে এবং এগুলো প্রথাগত ব্যাংকিং থেকে কীভাবে আলাদা। স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ইসলামি অর্থনীতি ও ব্যাংকিং-সম্পর্কিত শিক্ষা সীমিত। ফলে নতুন প্রজন্ম এ খাত সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে উঠতে পারে না। প্রথাগত ব্যাংকিং যেখানে ব্যাপক মিডিয়া প্রচার, বিজ্ঞাপন ও ডিজিটাল ক্যাম্পেইনে সক্রিয়, সেখানে ইসলামি ব্যাংকিংয়ের পক্ষ থেকে সচেতনতামূলক কার্যক্রম অনেকটাই কম। টিভি, রেডিও, সোশ্যাল মিডিয়া, ইউটিউব, ওয়েবসাইটের মাধ্যমে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিং সম্পর্কে তথ্য ছড়িয়ে দিতে হবে। গ্রাহক অভিজ্ঞতাভিত্তিক কনটেন্ট তৈরি করে বাস্তব উদাহরণ দেখানো যেতে পারে। ব্যাংকের উদ্যোগে মসজিদ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয় এবং পেশাজীবী মহলে ইসলামিক ফিন্যান্সবিষয়ক ওয়ার্কশপ, সেমিনার ও করপোরেট সেশন পরিচালনা করতে হবে। মাধ্যমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত স্তরে ইসলামিক অর্থনীতি ও ব্যাংকিংবিষয়ক অধ্যায় সংযোজন করতে হবে। সহজ ও আকর্ষণীয় ভিডিও, ইনফোগ্রাফিক্স ও কোর্সের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মকে আকৃষ্ট করা যেতে পারে। শরিয়াহভিত্তিক তহবিল বিনিয়োগের ক্ষেত্র সীমিত হওয়ায় অতিরিক্ত তারল্য ব্যবস্থাপনা কঠিন হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিং একটি সম্ভাবনাময় খাত। বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলো যথাযথভাবে মোকাবিলা করে এবং কার্যকর করণীয় বাস্তবায়নের মাধ্যমে এ খাত দেশের আর্থিক খাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে। ইসলামি মূল্যবোধ ও আধুনিক ব্যবস্থাপনার সমন্বয় ঘটিয়ে এ ব্যাংকিং ব্যবস্থা আরও টেকসই ও জনপ্রিয় করে তোলা সম্ভব।
বর্তমানে ইসলামি ব্যাংক খাতে যে আর্থিক অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাট হয়েছে, তা দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার জন্য এক মারাত্মক সংকেত। বিভিন্ন রিপোর্টে প্রকাশ পেয়েছে, হাজার হাজার কোটি টাকা অবৈধভাবে ঋণ হিসাবে তুলে নেওয়া হয়েছে। এর ফলে ব্যাংকের তারল্য সংকট ও সাধারণ গ্রাহকের আস্থার মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে সরকারের উচিত দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা : ১. দায়ীদের শনাক্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ ২. ব্যাংক পুনর্গঠনে জরুরি আর্থিক সহায়তা ৩. স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা।
ইসলামি ব্যাংক শুধু একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান নয়, বরং এটি ইসলামি মূল্যবোধে পরিচালিত একটি জনগণের আস্থাভিত্তিক সেবা। তাই এ খাতে আঘাত মানে হলো, জনগণের বিশ্বাসে আঘাত। সরকারের পক্ষ থেকে দায়িত্বশীল পদক্ষেপ এবং প্রয়োজনে আর্থিক সহায়তা প্রদান করে এ ক্ষতি থেকে ব্যাংকগুলোকে উদ্ধার করাই হবে সময়োচিত ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ।
তাইফুর রহমান : ব্যাংকার ও কলামিস্ট
