Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

মামদানির জয় থেকে জায়নবাদের ভবিষ্যৎ : এক রাষ্ট্রের সমতার শিক্ষা

Icon

রঞ্জন সলোমন

প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মামদানির জয় থেকে জায়নবাদের ভবিষ্যৎ : এক রাষ্ট্রের সমতার শিক্ষা

যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জোহরান মামদানির মেয়র নির্বাচনে জয় কেবল একটি স্থানীয় রাজনৈতিক চমক নয়; এটি বিশ্বজুড়ে ভীতিভিত্তিক রাজনীতির ধীর পতনেরও এক সংকেত। উগান্ডা-ভারতীয় বংশোদ্ভূত এ তরুণ মুসলিম সমাজতান্ত্রিক নেতা ফিলিস্তিনি অধিকারের প্রতি তার অকুতোভয় সমর্থনের কারণে তাকে চরমপন্থি হিসাবে চিহ্নিত করার জন্য ইসরাইলপন্থি লবি যে পূর্ণাঙ্গ প্রচারণা চালিয়েছিল, তিনি তাকেও পরাজিত করেছেন। তার নির্বাচনি এলাকার ভোটাররা পিছু না হটে, সমতা, ভাড়াটেদের ন্যায়বিচার, ধর্ম ও জাতি নির্বিশেষে সংহতির ওপর প্রতিষ্ঠিত রাজনীতির পক্ষে সমবেত হন। তার এ জয়ের নৈতিক প্রতিধ্বনি কুইন্সের বাইরেও প্রসারিত হয়েছে। এটি সেই জায়নবাদীদের প্রতি প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছে, যারা অপর পক্ষের প্রতি বৈরিতার মাধ্যমে নিজেদের পরিচয় নির্ধারণ করেন: পশ্চিমে যদি বহুত্ববাদী, ধর্মনিরপেক্ষ নাগরিক রাজনীতি জয়ী হতে পারে, তবে যে ভূমিতে তিনটি ধর্মের জন্ম হয়েছিল, সেখানে কেন এটি শিকড় গাড়তে পারবে না?

জায়নবাদের দুর্বল ভিত্তি : দশকের পর দশক ধরে, জায়নবাদ এ বিভ্রমের ওপর টিকে আছে যে, ইহুদি নিরাপত্তা স্থায়ী আধিপত্যের ওপর নির্ভরশীল। ইসরাইলি ডানপন্থিরা-যারা আজ লিকুদ এবং তাদের চরমপন্থি অংশীদারদের মধ্যে বসতি সম্প্রসারণ, সম্মিলিত শাস্তি এবং ধর্মীয় আধিপত্যকে নিরাপত্তা মতবাদ হিসাবে পবিত্র করার মতো বাস্তব রূপায়িত বিভ্রমকে নীতিতে পরিণত করেছে। তবুও, হান্না আরেন্ডট ১৯৪৮ সালে যেমনটা সতর্ক করেছিলেন-ন্যায়বিচারের পরিবর্তে ভয়ের ওপর নির্মিত জাতীয়তাবাদ পরিশেষে ‘নিরাপত্তাহীনতা থেকে পালাতে চায়’, সেটিকেই যেন সত্যে পরিণত করছে। অর্থনৈতিক পতন, অভ্যন্তরীণ মেরুকরণ ও অবিরাম দখলদারত্বের নৈতিক দেউলিয়াপনার মতো সমস্যাগুলো এখন এমন আন্দোলনকে উন্মোচিত করছে, যা এর নিজস্ব ভিত্তিকে গ্রাস করছে।

মামদানির মতো রাজনীতিবিদদের উত্থান, সেইসঙ্গে প্রবাসের ইহুদি কণ্ঠস্বর, নাওমি ক্লেইন, ইলান পাপ্পে, পিটার বেইনার্ট ও অন্যরা জায়নবাদের ঊর্ধ্বে ইহুদি ধর্মের একটি নৈতিক নবজাগরণের ইঙ্গিত দেয়। তারা বিশ্বকে স্মরণ করিয়ে দেন, নির্বাসন ও নিপীড়নে গঠিত ইহুদি নীতিশাস্ত্র একসময় বিশ্বজনীনতা, আতিথেয়তা এবং আগন্তুকের সুরক্ষার সমার্থক ছিল। যাকে কেউ কেউ ‘জায়নবাদের পতন’ বলে অভিহিত করেন, তার জন্য প্রস্তুত হওয়া মানে ইহুদি ধ্বংস কামনা করা নয়, বরং ইহুদি নবায়ন কামনা করা: একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে ইহুদিদের পুনরুজ্জীবন, যারা মুসলিম এবং খ্রিষ্টানদের পাশাপাশি সমান অধিকার এবং যৌথ নিরাপত্তা নিয়ে বসবাস করবে।

মামদানির জয়ের নৈতিক ও রাজনৈতিক শিক্ষা : মামদানির প্রচারণা উত্তর-জায়নবাদী রূপান্তরের জন্য তিনটি প্রাসঙ্গিক শিক্ষা দেয়। প্রথমত, ভয় দেখানোরও সীমাবদ্ধতা আছে। তার বিরোধীরা গাজায় কেবল যুদ্ধবিরতির দাবি জানানোর জন্য তাকে ইহুদিবিদ্বেষী হিসাবে চিত্রিত করতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করেছে। তবুও ভোটাররা ভাড়া মওকুফ, স্বাস্থ্যসেবা এবং মর্যাদার জন্য তার এজেন্ডাগুলো বেছে নিয়েছেন। দ্বিতীয়ত, বহুত্ববাদী নেতৃত্ব শুধু পরিচয়ের প্রতীকী ব্যবহার নিয়ে নয়, বরং নৈতিক স্বচ্ছতা নিয়ে নিরাপত্তার ওপর তার এই জোর যে অবশ্যই বিশ্বজনীন হতে হবে, উপজাতীয় নয়, তা ছিল ফ্যানন এবং সাইদের নীতিশাস্ত্রের প্রতিধ্বনি। তৃতীয়ত, বস্তুগত ন্যায়বিচারের ওপর ভিত্তি করে জোটের রাজনীতি হলো জাতি-ধর্মীয় উগ্রবাদের একমাত্র প্রতিষেধক। যখন মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ হয়, তখন উসকানিমূলক পক্ষগুলো আকর্ষণ হারায়। এ নীতিগুলো যদি কুইন্সে ভয়কে পরাজিত করতে পারে, তবে তারা জেরুজালেমেও এটিকে ক্ষয় করতে শুরু করতে পারে। সামনের প্রকল্পটি ইউটোপিয়ান নয়; এটি রাজনৈতিক, আইনি এবং নৈতিক। আহ্বানটি হলো, একটি ইহুদি আধিপত্যবাদী রাষ্ট্র থেকে একটি সাংবিধানিক গণতন্ত্রের দিকে নাগরিক রূপান্তরের, যা ইহুদিদের একটি সুবিধাপ্রাপ্ত জাতি হিসাবে নয়, বরং একটি সম্প্রদায় হিসাবে রক্ষা করবে।

রূপান্তরের দিকে মৌলিক পদক্ষেপ : দখলদারত্ব থেকে সমতার পথে অবিলম্বে মানবিক পদক্ষেপ ছাড়া শুরু হতে পারে না: একটি স্থায়ী যুদ্ধবিরতি, গাজা অবরোধ তুলে নেওয়া এবং বসতি নির্মাণ বন্ধ করা। এগুলো সংলাপের জন্য শ্বাস ফেলার সুযোগ তৈরি করবে। এরপর, একটি সংবিধান রচনার সভা ইসরাইলি ও ফিলিস্তিনি নাগরিক সমাজ, নারী গোষ্ঠী, স্থানীয় পরিষদ, ধর্মীয় নেতা এবং প্রবাসের ইহুদিদের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত-আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধানে একটি ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের খসড়া তৈরি করা উচিত। সেই সভাকে অবশ্যই মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্রকে তার মূল আইনি রেফারেন্স হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

একটি পর্যায়ক্রমিক সময়সূচি অনুসরণ করা যেতে পারে:

* প্রথম বছর: যুদ্ধবিরতি এবং সমতার নীতির পারস্পরিক স্বীকৃতি।

* দ্বিতীয়-তৃতীয় বছর: রূপান্তরকালীন সরকার এবং যৌথ নিরাপত্তা কাঠামো।

* চতুর্থ বছর: সাংবিধানিক গণভোট এবং প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচন।

* পঞ্চম-দশম বছর: পুনর্গঠন, ক্ষতিপূরণ এবং পূর্ণ নাগরিকত্বের সুসংহতকরণ।

যদিও এ ধরনের বিন্যাস হবে অগোছালো এবং ঝুঁকিপূর্ণ। চরমপন্থি পক্ষগুলো সহিংসতার মাধ্যমে এটিকে ব্যাহত করার চেষ্টা করবে। এ কারণেই রূপান্তরের সময় জাতিসংঘ, আফ্রিকান ইউনিয়ন এবং নিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলোর কাছ থেকে আন্তর্জাতিক গ্যারান্টি অপরিহার্য।

ঘৃণার অবসান : এ রূপান্তরের নৈতিক মূল নিহিত ‘ঘৃণার অবসানের’ মধ্যে। লিকুদ এবং এর কট্টর ডানপন্থি মিত্ররা চিরন্তন শত্রুদের ওপর নির্ভরশীল একটি পরিচয় তৈরি করেছে। তারা হলোকাস্টের স্মৃতিকে রাজনৈতিক পুঁজি এবং ধর্মীয় পৌরাণিক কাহিনিকে বিজয়ের ন্যায্যতা হিসাবে পরিণত করেছে। কিন্তু ইতিহাস প্রমাণ করে, ঘৃণা একটি জাতির জন্য দুর্বল ভিত্তি। এটি নৈতিক বৈধতাকে নিঃশেষ করে এবং অত্যাচারীকে বিচ্ছিন্ন করে। ইসরাইলি দায়মুক্তির বিরুদ্ধে বর্তমান বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া, যা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, ট্রেড ইউনিয়ন এমনকি পশ্চিমা পার্লামেন্টগুলোতেও ছড়িয়ে পড়েছে-সেই ঘৃণার সমাপ্তির শুরুকে চিহ্নিত করে। ইহুদি হিসাবে শান্তিতে বসবাস করা আর জায়নবাদী হিসাবে বসবাস করা এক নয়।

উপসংহার: ভয়ের পরের রাজনীতি

জোহরান মামদানির বিজয় আমাদের শেখায়, সংহতির ওপর নির্মিত পরিচয় ভয়ের ওপর নির্মিত পরিচয়কে অতিক্রম করতে পারে। এটি একটি ছোট রাজনৈতিক ঘটনা, যার প্রতীকী পরিণতি বিশাল। এটি জায়নবাদীদের এবং প্রকৃতপক্ষে সব একচেটিয়া জাতীয়তাবাদীদের এ বার্তাই দেয় যে, তারা যে প্রাচীর তৈরি করেছে, তা চিরন্তন নয়। ভয় হয়তো মানুষকে একত্রিত করতে পারে; কিন্তু তা টেকসই হতে পারে না। যখন নাগরিকরা তাদের ভাগ করা মানবতা এবং অর্থনৈতিক নির্ভরতা আবিষ্কার করে, তখন ঘৃণার রাজনীতি তার নিজস্ব অর্থহীনতার নিচে ভেঙে পড়ে।

এক রাষ্ট্রের ধারণা, যাকে দীর্ঘদিন ধরে অলীক কল্পনা বলে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তা এখন ন্যায়বিচার এবং জনসংখ্যার বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ একমাত্র পথ। ভবিষ্যতের ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ইহুদি, মুসলিম, খ্রিষ্টান এবং ধর্মনিরপেক্ষ পরিচয়গুলোকে মুছে ফেলবে না, বরং সেগুলোকে আধিপত্যের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করবে।

রঞ্জন সলোমন : ভারতের রাজনৈতিক ভাষ্যকার এবং মানবাধিকার কর্মী

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম