আজকের দিনটি হোক ‘উপকূল দিবস’
এম আমীরুল হক পারভেজ চৌধুরী
প্রকাশ: ১২ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি: সংগৃহীত
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
‘মনপুরা ৭০’ শিল্পকর্ম এবং ‘সীমানা পেরিয়ে’ চলচ্চিত্র উপকূলীয় জীবন-ইতিহাসের একটি ভয়াবহ বেদনার গল্প। প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ভয়াবহতার প্রতিচ্ছবি এ গল্প। এ গল্পের পেছনে রয়েছে আরেক নির্মম ইতিহাস।
১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ১০ লাখ মানুষের প্রাণহানির ইতিহাস। ভোলা, তৎকালীন নোয়াখালী (নোয়াখালী-লক্ষ্মীপুর) এবং পটুয়াখালী পরিণত হয়েছিল ধ্বংসস্তূপে। তজুমুদ্দিন উপজেলায় ১ লাখ ৬৭ হাজার মানুষের মধ্যে বেঁচে ছিল মাত্র ৭৭ হাজার। মনপুরা দ্বীপের ৩২ হাজার মানুষের মধ্যে ২০ হাজার মানুষ এ ভয়াল রাতে প্রাণ হারায়। সাগর, নদী, খাল-বিলে ভেসেছিল অসংখ্য লাশ আর ১ কোটি মৃত গবাদি পশু। ঘরবাড়ি, স্বজন হারিয়ে পথে বসে উপকূলের লাখ লাখ মানুষ। উপকূলীয় দ্বীপচরসহ বহু এলাকার ঘরবাড়ি নিশ্চিহ্ন হয়ে বিরান জনপদে পরিণত হয়। সাগর-নদী-খাল-বিলে ভেসে ছিল অসংখ্য মৃতদেহ। এসব মৃতদেহের সৎকার করাও সম্ভব হয়নি।
১২ নভেম্বর সন্ধ্যা থেকে ১৩ নভেম্বর ভোর পর্যন্ত বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) উপকূল অঞ্চলে সর্বকালের প্রাণঘাতী ঘূর্ণিঝড়টি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১৮৫ কিলোমিটার গতিবেগে আঘাত হানে। ১৫ থেকে ২৫ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসে দক্ষিণ উপকূলীয় অঞ্চল ও দ্বীপগুলো প্লাবিত হয়। এ পর্যন্ত রেকর্ডকৃত ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে এটি সবচেয়ে ভয়াবহ। এ ঘূর্ণিঝড় লন্ডভন্ড করে দেয় উপকূল। এ ঘূর্ণিঝড় গোটা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। উপকূলের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়কে ‘ভোলা সাইক্লোন’ও বলা হয়। এছাড়াও দেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের একটি পরোক্ষ কারণও এই প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়।
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন মনপুরা ঘুরে ঘূর্ণিঝড়ের বিধ্বংসী ও ধ্বংসাত্মক প্রভাবকে ২৮ ফুট লম্বা একটি শিল্পকর্মে চিত্রিত করেন ‘মনপুরা ৭০’ নামে। জয়নুল আবেদিন বলেন, ‘মনপুরায় আমরা যখন থার্ড ডে-তে নামলাম, সি-প্লেনে আমি আর আমার বন্ধু একা ঘুরতাছি সারা দিন। কয়টা লোক বাঁইচা আছে। দেখলাম। দৌড়ায় আসল। দেখলাম জখমওয়ালা। তারা কানতে আরম্ভ করল। আমরাও কানতে আরম্ভ করলাম। আপনারা বিশ্বাস করেন, আমার পেছনে...সমুদ্র...ঠিক সমুদ্র না, সমুদ্রের খাঁড়ি, যেখানে যান, খালি গরু-মানুষ শুইয়া রইছে।’ প্রবীণেরা বর্ণনা দিতে গিয়ে জয়নুল আবেদিনের মতোই হুহু করে কেঁদে ওঠেন।
১৯৭০-এর ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসের ধ্বংসলীলার প্রায় তিন মাস পর একজোড়া মানব-মানবিকে বরিশালের দক্ষিণের একটি সামুদ্রিক চরে আদিম পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকতে দেখা গিয়েছিল; তৎকালীন ঢাকার সংবাদপত্রে এমন খবর প্রকাশিত হয়। চরে একজোড়া নারী-পুরুষের বেঁচে থাকা ও বসবাসের বিষয়টি পরিচালক আলমগীর কবিরের দৃষ্টিতে একটি বিশেষ ঘটনা বলে মনে হয়। তিনি এ ঘটনা নিয়ে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করার কথা ভাবেন এবং ১৯৭৫ সালে এটির নির্মাণ কাজ শুরু করেন। এ রকম হাজারো বেদনার মর্মস্পর্শী ইতিহাস রয়েছে উপকূলের এ প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ঘিরে।
ইতিহাস থেকে মানুষ শিক্ষা নেয়, দিবস থেকে মানুষ অভিজ্ঞতা অর্জন করে এবং দিবসের ইতিকথা স্মরণে রাখে। ঠিক তেমনই মনে রাখার মতো একটি দিন ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর। ঝড়-ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ জনপদের নামই ‘উপকূল’। বৈরী প্রতিকূলতা, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙন, লবণাক্ততার প্রভাবের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে চলেছে উপকূলের প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ। দেশের ৭১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূলীয় অঞ্চলের মোট ১৯টি জেলা ও ১৪৭টি উপজেলা উপকূলের অংশ। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৩৬ শতাংশ বাস করে উপকূলীয় অঞ্চলে। তাদের জীবন-জীবিকা প্রাথমিকভাবে নির্ভর করে মাছ, কৃষি, বন, স্থানীয় পরিবহণ, লবণ ইত্যাদির ওপর। এ দেশের উপকূলের জনগোষ্ঠী প্রতিবছর নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেমন: সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা ইত্যাদির মুখোমুখি হয়। বন্যা, খরা, ঝড় এবং তাপপ্রবাহের কারণে প্রতিবছর প্রায় ৩০০ কোটি মার্কিন ডলারের (প্রায় ৩৩ হাজার কোটি টাকা) আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে।
উপকূলের সংকট, সমস্যা, সম্ভাবনা এবং জলবায়ুর ঝুঁকিতে থাকা মানুষের অধিকার ও ন্যায্যতার দাবি আদায়ে উপকূলের জন্য একটি বিশেষ দিন অপরিহার্য। প্রাথমিকভাবে ২০১৫ সালে উপকূল ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ১২ নভেম্বরকে ‘উপকূল দিবসের’ দাবি ওঠে। পরবর্তীকালে সাংবাদিক, পেশাজীবী ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনসহ নানা মানুষ এ দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে কর্মসূচি পালন করেন। জাতিসংঘের বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউএমও) এই ঘূর্ণিঝড়কে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণঘাতী ঘূর্ণিঝড় হিসাবে উল্লেখ করেছে। শুধু বাংলাদেশের নয়, গোটা বিশ্বের জন্যই দিনটি ‘ওয়ার্ল্ড কোস্টাল ডে’ তথা ‘বিশ্ব উপকূল দিবস’ হওয়া উচিত।
খাদ্য চাহিদার উল্লেখযোগ্য অংশ বর্তমানে উৎপাদিত হচ্ছে দেশে; যার সিংহভাগই উপকূলে। জাতীয় অর্থনীতিতে উপকূলীয় অঞ্চল জিডিপির কমবেশি ২৫ শতাংশ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। সমুদ্রের মৎস্য সেক্টর পুরোপুরি উপকূলকেন্দ্রিক। বাংলাদেশের কলকারখানার পাশাপাশি উপকূলের মৎস্য সেক্টর এবং উপকূলের জনশক্তি দেশের অর্থনীতিতে বিশাল ভূমিকা রাখছে। উপকূলীয় এলাকার মানুষ দেশের উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। গণতন্ত্র, অর্থনীতি ও দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতিকে আরও সামনের দিকে এগিয়ে নিতে উপকূলীয় অঞ্চলের খেটে খাওয়া মানুষের ভূমিকাও কম নয়। আর এসব খেটে খাওয়া মানুষের কথা বিবেচনা করে সরকারের এগিয়ে আসা উচিত। সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা, এনজিও, গণমাধ্যমসহ সবাই উপকূলের জন্য একটি দিবস প্রত্যাশা করবেন নিশ্চয়ই। মনে রাখার মতো একটি দিন ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর। উপকূলে যে ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে, তা এ প্রজন্মের মানুষ জানে না। এদিন দিবস হিসাবে পালন করলে হয়তো এ প্রজন্মের মানুষ মনে রাখবে। তাই আমরাও চাই একটি দিবস, যার নাম হবে ‘উপকূল দিবস’।
গত ২০ বছরে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে প্রায় ৪ কোটি ২০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২০৫০ সালের মধ্যে এ প্রভাব মোকাবিলা না করা হলে জিডিপির প্রায় ২ শতাংশ কমে যেতে পারে এবং কোটি কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হতে পারে। ‘সীমানা পেরিয়ে’ ছবির গান : ‘মেঘ থম থম করে কেউ নেই নেই; জল থইথই তীরে কিছু নেই নেই; ভাঙনের যে নেই পারাপার; তুমি আমি সব একাকার।’ এ পরিস্থিতির অবসান হোক প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের ৫৬ বছর পর ‘উপকূল দিবসের’ রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির মাধ্যমে। আমাদের দৃঢ়বিশ্বাস, ’৭০-এর ভয়াল ঘূর্ণিঝড়ের বিষয়টি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে।
এম আমীরুল হক পারভেজ চৌধুরী : উপকূল গবেষক; চেয়ারম্যান, উপকূল ফাউন্ডেশন
ahcparvezdu@gmail.com
