Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

নতুন অর্থনৈতিক দিগন্ত

Icon

সাইফুল খান

প্রকাশ: ১৩ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

নতুন অর্থনৈতিক দিগন্ত

ফাইল ছবি

বাংলাদেশ এক সময় ছিল শুধু কৃষিনির্ভর রাষ্ট্র। তারপর শিল্পবিপ্লবের ঢেউ এসে তৈরি পোশাক, রেমিট্যান্স ও নির্মাণশিল্পকে সামনে এনে অর্থনীতিকে টেনে তোলে। কিন্তু ২১ শতকের বাস্তবতা বদলে দিয়েছে ‘সম্পদ’ নামের ধারণাকেই। এখন সম্পদ কেবল তেল, গ্যাস বা স্বর্ণ নয়। এখন সম্পদ হলো তথ্য, গবেষণা ও জ্ঞান। এ জ্ঞান আহরণ ও প্রয়োগের মধ্য দিয়েই আজ বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রগুলো নতুন করে নিজেদের ভাগ্য গড়ছে। বাংলাদেশেরও এখন দরকার সে মানসিকতা, ‘জ্ঞানকে পণ্য’ এবং ‘বিশ্ববিদ্যালয়কে গবেষণা-অর্থনীতির কেন্দ্র’ বানানোর সাহস।

দক্ষিণমুখে দিগন্ত : বাংলাদেশের সম্ভাবনা

বাংলাদেশ থেকে যদি কেউ সোজা দক্ষিণমুখে যাত্রা শুরু করে। তবে চোখের সামনে বিস্তৃত বঙ্গোপসাগর, তারপর ভারত মহাসাগরের বিশাল জলরাশি এবং সে সমুদ্রপথের শেষ প্রান্তে বরফে ঢাকা এক মহাদেশ অ্যান্টার্কটিকা। এ পথের মাঝে পৃথিবীর এক অমিত সম্ভাবনার অঞ্চল লুকিয়ে আছে। ভারত মহাসাগর ও দক্ষিণ মেরু-সংলগ্ন সামুদ্রিক অঞ্চল।

আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইনের অধীনে, প্রতিটি উপকূলীয় রাষ্ট্রের ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত সমুদ্রসীমা ‘অর্থনৈতিক অঞ্চল’ হিসাবে স্বীকৃত। বাংলাদেশও ২০১২ সালের রায় অনুযায়ী মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সীমানা নির্ধারণ করে প্রায় ১,১৮,৮১৩ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র এলাকা পেয়েছে।

এ এলাকাতেই রয়েছে সমুদ্রতলীয় খনিজ, প্রাকৃতিক গ্যাস, জীববৈচিত্র্য, শৈবাল, গভীর সাগরের মাছ, এমনকি চিকিৎসাবিজ্ঞানে ব্যবহৃত অণুজীব পর্যন্ত। কিন্তু আজও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা প্রতিষ্ঠান বা অর্থনৈতিক নীতি এ মহাসম্পদের দিকে পুরোপুরি মনোযোগ দেয়নি। দক্ষিণমুখে যাত্রা কেবল ভৌগোলিক নয়, এটি হতে পারে অর্থনৈতিক পুনর্জাগরণের এক রূপরেখা।

আহরণ মানে কেবলই খনিজ নয়, জ্ঞানের আহরণ

আমরা ‘আহরণ’ শব্দটি শুনলে গ্যাস বা কয়লা বুঝি। কিন্তু আধুনিক বিশ্বে ‘সম্পদ আহরণের’ পাশাপাশি একটি নতুন ধারণা এসেছে ‘জ্ঞান আহরণ’। এটি হচ্ছে গবেষণার মাধ্যমে জ্ঞান আহরণ, বিশ্লেষণ এবং সেটিকে বাণিজ্যিক সম্পদে রূপান্তর করা। যেমন-সমুদ্রের অণুজীব নিয়ে বায়োটেকনোলজির গবেষণা থেকে ওষুধ তৈরি হতে পারে। সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের জেনেটিক তথ্য আন্তর্জাতিক ওষুধ কোম্পানির কাছে লাইসেন্স করা যায়। এমনকি সমুদ্র ও দক্ষিণ মেরু অভিযানের তথ্যচিত্র ও ডেটা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও বিক্রি হয়। অর্থাৎ, ‘আহরণ’ এখন শুধু খনিজ নয়। এটি হচ্ছে জ্ঞানের আহরণ, তথ্যের আহরণ এবং ভবিষ্যতের পুঁজির আহরণ।

গবেষণাভিত্তিক অর্থনীতি : বিশ্বের পথচলা

উন্নত দেশগুলো ইতোমধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়কে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ইঞ্জিনে পরিণত করেছে। জাপানের টোকিও ইউনিভার্সিটি বছরে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার আয় করে গবেষণা ও পেটেন্ট থেকে। সুইডেনের উপসালা ইউনিভার্সিটি বায়োমেডিকেল গবেষণায় বছরে ৩০০ মিলিয়ন ইউরো আয় করে। দক্ষিণ কোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণার ফলকে প্রযুক্তি ও ব্র্যান্ডে রূপ দিয়েছে ইতোমধ্যেই। স্যামসাং ও হুন্দাইয়ের অনেক প্রযুক্তির জন্ম হয়েছিল একাডেমিক ল্যাব থেকে। বাংলাদেশ যদি গবেষণাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল চালিকাশক্তি করে তুলতে পারে, তবে এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও রেমিট্যান্সের মতো আয় তৈরি করতে সক্ষম হবে।

বিশ্ববিদ্যালয় পুনর্গঠন : জ্ঞাননির্ভর অর্থনীতি ও গবেষণার জন্য নতুন অধ্যায়

বাংলাদেশের বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয় কাঠামো মূলত ডিগ্রিনির্ভর। বাস্তবতা হলো, শুধু পাঠ্যক্রমের সীমানার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যতের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে পারেন না। এখন সময় এসেছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পুনর্গঠন করে গবেষণাভিত্তিক অর্থনৈতিক বিভাগ স্থাপন করার।

উদাহরণস্বরূপ, সমুদ্র ও পরিবেশ বিভাগে শিক্ষার্থীরা শিখতে পারবে সমুদ্র সম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং সামুদ্রিক গবেষণা। এটি শুধু মাছ ধরার দক্ষতা নয়, বরং গভীর সমুদ্রের খনিজ ও সামুদ্রিক পেটেন্ট অনুসন্ধান, সমুদ্র সংরক্ষণ এবং আন্তর্জাতিক গবেষণা সহযোগিতার মাধ্যমে বৈদেশিক আয় বাড়ানোর সম্ভাবনা তৈরি করবে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই বিস্তৃত ইইজেড অঞ্চলের মালিক। তাই এ গবেষণা দেশের অর্থনীতিতে নতুন প্রবাহ আনতে পারে।

ইতিহাস ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে কালচারাল হেরিটেজ অ্যান্ড মিউজিয়াম স্টাডিজ দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ, গবেষণা, পর্যটন, বই, ফিল্ম ও রয়্যালটির মাধ্যমে অর্থনৈতিক মূল্য সৃষ্টিতে সহায়ক হবে। একাডেমিক গবেষণা শুধু অধ্যাপক ও শিক্ষার্থীর সীমিত ক্ষেত্রেই থাকবে না; বরং দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বৈশ্বিক মানচিত্রে অবস্থান সুদৃঢ় হবে।

চিকিৎসা ও জীববিজ্ঞান বিভাগের অন্তর্ভুক্ত বায়োমেডিকেল রিসার্চ এবং মেরিন ফার্মাসি শিক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমে নতুন ওষুধ, বায়োটেক পণ্য ও মেডিকেল ট্যুরিজমের সুযোগ বাড়বে। সমুদ্রের জীববৈচিত্র্য ও উদ্ভাবনী গবেষণা একদিকে আন্তর্জাতিক পেটেন্ট এবং শিল্পের গুণগত মান বাড়াবে, অন্যদিকে বাংলাদেশকে মেডিকেল ট্যুরিজমে প্রতিযোগিতামূলক দেশ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করবে।

সমাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে গ্লোবাল পলিসি অ্যান্ড গভার্নমেন্স বিভাগ প্রতিষ্ঠা করলে শিক্ষার্থীরা বিশ্বের বিভিন্ন থিংক ট্যাংক, গবেষণা তহবিল এবং আন্তর্জাতিক নীতি প্রণয়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত হতে পারবে। এটি কেবল শিক্ষার জন্য নয়; দেশের কূটনীতি, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং নীতি প্রণয়নে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলবে।

এ পুনর্গঠন শুধু শিক্ষাগত কাঠামো পরিবর্তন করবে না; বরং দেশের জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তুলবে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠবে গবেষণা, উদ্ভাবন, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বাংলাদেশের উপস্থিতির কেন্দ্র। নতুন বিভাগগুলোর মাধ্যমে শিক্ষার্থী, গবেষক এবং শিল্পের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি হবে, যা দেশে দীর্ঘমেয়াদি বৈজ্ঞানিক ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিশ্চিত করবে।

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি গবেষণাভিত্তিক মডেলে এগোয়, তাহলে ৫-১০ বছরের মধ্যে তারা যে পরিমাণ আয় করতে পারে, তা হবে বিশাল।

গবেষণায় বিনিয়োগ মানে ভবিষ্যতে বিনিয়োগ

আজকের তরুণ প্রজন্ম যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে কেবল চাকরির চিন্তা না করে, বরং গবেষণায় উদ্যোক্তা হিসাবে অংশ নেয়, তাহলে তারা দেশের জন্য নতুন পুঁজির উৎস হয়ে উঠতে পারে। একজন গবেষক এখন কেবল ‘লেখক’ নন, তিনি হতে পারেন জলবায়ু ডেটার মালিক, প্রযুক্তির পেটেন্টধারী, ইতিহাসের ডিজিটাল আর্কাইভ নির্মাতা, অথবা সমুদ্রবিজ্ঞানী-যিনি অ্যান্টার্কটিকা অভিযানের নেতৃত্ব দেবেন।

উপসংহার : বাংলাদেশের উন্নয়নের পরবর্তী ধাপ ‘শ্রমনির্ভর’ থেকে ‘জ্ঞাননির্ভর’ অর্থনীতিতে রূপান্তরিত হলে জ্ঞানই হবে নতুন স্বর্ণ। এ রূপান্তরের কেন্দ্র হবে বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং মুক্তচিন্তা। যে রাষ্ট্র জ্ঞানে বিনিয়োগ করে, সে রাষ্ট্রই ভবিষ্যৎকে নিয়ন্ত্রণ করে। আজ যদি আমরা ‘জ্ঞান আহরণ’-কে জাতীয় নীতিতে পরিণত করতে পারি, তবে বঙ্গোপসাগর থেকে অ্যান্টার্কটিকা পর্যন্ত সমুদ্রপথ শুধু ভৌগোলিক নয়, এটি হয়ে উঠবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক নবজাগরণের মহাপথ।

সাইফুল খান : ইতিহাস, রাজনীতি ও আন্তর্জাতিকবিষয়ক বিশ্লেষক

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম