মাদুরোকে কি গাজাকে সমর্থন দেওয়ার মূল্য দিতে হচ্ছে
ইমান আবু সিদু
প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো। ফাইল ছবি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
আমেরিকান জনগণের প্রতি সরাসরি বার্তায় ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো সতর্ক করে দিয়েছেন, ‘আপনি কি দক্ষিণ আমেরিকায় একটি নতুন গাজা চান?’ তার বিবৃতিটি এসেছে ক্যারিবীয় অঞ্চলে মার্কিন সামরিক সঞ্চালনের প্রতিক্রিয়ায়। ওয়াশিংটনের পদক্ষেপগুলো একটি বৃহত্তর সংঘাতের পথ প্রশস্ত করতে পারে ভেবে ভেনিজুয়েলা উদ্বিগ্ন।
মাদকের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অজুহাত অনেকেই বিশ্বাস করতে পারেনি, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরেও। আমেরিকান সামরিক কর্মকর্তারা বলেছেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প ভেনিজুয়েলাকে তার দেশে ‘ফেন্টানাইল’ পাচারের অভিযোগ আনা সত্ত্বেও টার্গেট করা নৌকাগুলোতে ওই পদার্থটি পাওয়া যায়নি। মাদুরো যুক্তি দিয়েছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র শুধু ভেনিজুয়েলাকেই টার্গেট করছে না, বরং ‘সমগ্র লাতিন আমেরিকাকে, এবং সামগ্রিকভাবে মানবতাকে’ টার্গেট করছে। তিনি সতর্ক করে দেন, যে কোনো সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপ তার দেশকে সেই ধরনের ধ্বংসযজ্ঞের মুখোমুখি করতে পারে, যা ইসরাইলি সেনাবাহিনী গাজা উপত্যকায় ঘটিয়েছে।
বিশ্লেষকরা যুক্তি দেন, এই উত্তেজনা সৃষ্টির পেছনের প্রাথমিক কারণ কাঠামোগত এবং এর মূলে রয়েছে এ অঞ্চলে কয়েক দশকের মার্কিন ডকট্রিন। তবুও গাজা ও ফিলিস্তিনের প্রতি মাদুরোর সোচ্চার সমর্থন একটি নতুন রাজনৈতিক উত্তেজনার জন্ম দিয়েছে এবং তা উত্তাপ বাড়িয়েছে। লাতিন আমেরিকাবিষয়ক বিশেষজ্ঞ আলী ফারহাত ব্যাখ্যা করেছেন, যে কোনো মার্কিন সামরিক পদক্ষেপের ‘রাজনৈতিক ও সামরিক উদ্দেশ্য’ রয়েছে। তিনি উল্লেখ করেছেন, এ উদ্দেশ্যটি হলো ‘উগ্র মার্কিন প্রতিপক্ষ, বিশেষ করে ভেনিজুয়েলার সরকারকে উচ্ছেদ করা, কারণ দেশটির সঙ্গে চীন ও রাশিয়ার দৃঢ় সম্পর্ক ভেনিজুয়েলাকে লাতিন আমেরিকায় রুশ, চীনা ও ইরানি প্রভাবের প্রবেশদ্বারে পরিণত করছে।
ফারহাত বলেন, প্রাকৃতিক সম্পদের বিষয়টি একটি মৌলিক উদ্দেশ্য। ভেনিজুয়েলা বিশ্বের বৃহত্তম তেলের মজুত এবং উল্লেখযোগ্য খনিজসম্পদ ধারণ করে। এবং তিনি যুক্তি দেন, ‘মাদক এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ে আলোচনা প্রায়ই এই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক লক্ষ্যগুলোকে ঢেকে রাখে।
গাজা যুদ্ধ মার্কিন-লাতিন আমেরিকান সম্পর্ককে আরও জটিল করে তুলেছে। ব্রাজিল, কলম্বিয়া ও ভেনিজুয়েলাসহ বেশ কয়েকটি সরকার প্রকাশ্যে ইসরাইলি কর্মকাণ্ডের নিন্দা করেছে; গুস্তাভো পেট্রো এবং লুলা দা সিলভার মতো নেতারা একে গণহত্যা হিসাবে বর্ণনা করেছেন। ফারহাত যুক্তি দেন, তাদের এ অবস্থান ‘মার্কিন প্রকল্প ও পররাষ্ট্রনীতির বিপরীত’।
যদিও গাজার প্রতি ভেনিজুয়েলার সমর্থন ওয়াশিংটনের জন্য সরাসরি নিরাপত্তা হুমকি সৃষ্টি করে না, তবে এটি মার্কিন বার্তা ও প্রভাবের বিষয়টিকে অবমূল্যায়ন করে, মার্কিন ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। যদি ব্রাজিল, কলম্বিয়া ও ভেনিজুয়েলার মতো দেশগুলো বৈশ্বিক সংঘাতের বিষয়ে স্বাধীন অবস্থানের দাবি অব্যাহত রাখে, তাহলে এটি একটি বৃহত্তর পুনর্বিন্যাসের ইঙ্গিত দেয়, যা ওয়াশিংটন প্রতিরোধ করতে বদ্ধপরিকর।
ফারহাত আরও সতর্ক করেছেন যে, ভেনিজুয়েলা হলো প্রথম ডমিনো। লাতিন আমেরিকার বৃহত্তম অর্থনীতি ব্রাজিল আমেরিকান রাডারের পরবর্তী টার্গেট-যদি ওয়াশিংটন ভেনিজুয়েলাকে দুর্বল করতে সফল হয়। ‘এটি নিছক ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষণ নয়; এটি হস্তক্ষেপ করার পুরোনো নিদর্শন।’ ফারহাত বিশ্বাস করেন, বিকল্প পন্থা হিসাবে কূটনীতি অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। তিনি ব্যাখ্যা করেন, ‘আমেরিকানরা যা চাইছে তা এমন কিছু, যাতে ভেনিজুয়েলার নেতৃত্ব সম্মত হবে না।’ তার কথাগুলো কেবল ওয়াশিংটনে নয়, কারাকাসেও অবস্থানের কঠোরতার পরামর্শ দেয়, যেখানে ‘নেতারা মনে করেন, তারা জাতীয় মর্যাদা রক্ষা করছেন, শুধু রাজনৈতিক শর্তাবলি নিয়ে আলোচনা করছেন না।’
ফিলিস্তিনি-ভেনিজুয়েলান লেখক ও বিশ্লেষক জেহাদ ইউসেফ এ বিষয়ে একটি দীর্ঘ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরেছেন। তার দৃষ্টিতে বর্তমান মুহূর্তটি কয়েক দশকের ধারাবাহিকতা, যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র লাতিন আমেরিকাকে তার ‘বাড়ির উঠোন’ হিসাবে বিবেচনা করে। যুক্তরাষ্ট্র লাতিন আমেরিকার যেসব নেতার অপসারণে ভূমিকা রেখেছে, ইউসেফ এমন নেতাদের তালিকার দিকে ইঙ্গিত করেছেন। আলেন্দে, মোরালেস, শাভেজ, কাস্ত্রো এবং এখন মাদুরোর ওপর চাপ প্রমাণ করে যে, কোনো সরকার মার্কিন প্রভাবের বাইরে নিজের পথ বেছে নিলে তাকে এর পরিণতি ভোগ করতে হয়। ইউসেফ জোর দিয়ে বলেছেন, কিউবা, ইরান, রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে ভেনিজুয়েলার জোট কৌশলগত সিদ্ধান্ত নয়, বরং সার্বভৌমত্ব ও প্রতিরোধের মূলে থাকা একটি রাজনৈতিক পরিচয়ের অংশ। এই পরিচয় যুক্তরাষ্ট্রকে বিরক্ত করে, কারণ এটি স্নায়ুযুদ্ধের পর থেকে স্থির একটি শ্রেণিবিন্যাসকে চ্যালেঞ্জ করে।
ইউসেফ যুক্তি দেন, গাজা, ইরান ও লেবাননের প্রতিরোধ আন্দোলনের প্রতি মাদুরোর সমর্থন সরাসরি আমেরিকান শত্রুতাকে আরও গভীর করেছে; কারণ তা প্রকাশ্যে মার্কিন অগ্রাধিকারের বিষয়গুলোর বিরোধিতা করে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত ভেনিজুয়েলায় তার উদ্দেশ্যগুলো চরিতার্থ করতে পারবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। ওয়াশিংটন লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে সরকারের পতন ঘটাতে বা অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে সক্ষম হতে পারে, তবে যা কখনই নিশ্চিত নয় তা হলো, সংঘর্ষ-পরবর্তী রাষ্ট্রটি সহজেই মার্কিন নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। লাতিন আমেরিকাবিষয়ক বিশেষজ্ঞ আলী ফারহাত মনে করেন, সামরিক হামলা সিস্টেমটিকে ভেঙে ফেলতে সফল হতে পারে, যদিও এটি নিশ্চিত নয়; কিন্তু যা সমানভাবে অনিশ্চিত তা হলো, এ ধরনের হামলার ফলাফল মার্কিন স্বার্থে কাজ করবে কিনা।
চাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভেনিজুয়েলা সামনে একটি কঠিন পথের মুখোমুখি হবে। এবং এই উচ্চ ভূরাজনৈতিক আবহাওয়ায় ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্টকে গাজার সমর্থনে প্রকাশ্যে ও দৃঢ়ভাবে দাঁড়ানোর জন্য সত্যিই একটি মূল্য দিতে হতে পারে।
মিডল ইস্ট মনিটর থেকে ভাষান্তরিত
ইমান আবুসিদু : মিডল ইস্ট মনিটরের ব্রাজিল সংবাদদাতা
