ভেনিজুয়েলার বিরুদ্ধে আমেরিকার যুদ্ধ চলছে
বেলান ফার্নান্দেজ
প্রকাশ: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
গত বুধবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভেনিজুয়েলার উপকূলের কাছ থেকে একটি তেল ট্যাঙ্কার জব্দ করে নিয়ে যায়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন দক্ষিণ আমেরিকার এই দেশটির ওপর যে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে, এটি সেই আক্রমণেরই নতুন একটি পদক্ষেপ। গত কয়েক মাসে যুক্তরাষ্ট্র ক্যারিবীয় সাগরে ইচ্ছামতো ছোট নৌকা ডুবিয়ে দিয়েছে। তাদের সঙ্গে থাকা যাত্রীদের ট্রাম্প মনগড়াভাবে মাদক পাচারকারী বলে ধরে নিয়ে গিয়েছিলেন।
বুধবার ট্রাম্প দাবি করেন, জব্দ করা জাহাজটি ছিল ‘একটি বিশাল ট্যাঙ্কার, খুব বড়, আসলে এতদিন ধরে জব্দ হওয়াগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড়।’ ট্যাঙ্কারটির গন্তব্য কেন পালটানো হলো, এমন প্রশ্নের জবাবে ট্রাম্প সাংবাদিকদের উপদেশ দেন, ‘একটা হেলিকপ্টার নিয়ে ট্যাঙ্কারটার পিছু নিন।’ তবে ভেনিজুয়েলার আকাশসীমা গত নভেম্বরে ট্রাম্প ‘সম্পূর্ণ বন্ধ’ ঘোষণা করায় ওই অঞ্চলের আকাশ ব্যবহারে মানুষ ভয় পেতেই পারে। অবশ্য আকাশসীমা বন্ধ থাকলেও যুক্তরাষ্ট্র ভেনিজুয়েলায় মানুষকে ফেরত পাঠানোর ফ্লাইট ঠিকই চালু রেখেছে।
ট্যাঙ্কারের দামি তেলের কী হবে জানতে চাইলে ট্রাম্প বলেন, ‘আমার মনে হয় আমরা তেলটা রেখে দেব।’ এ মন্তব্যের পর আমেরিকার এই দাবি দুর্বল হয়ে যায় যে, তারা ভেনিজুয়েলার বিশাল তেলের সন্ধানে নেই, তারা শুধু চাইছে মাদকের ভয়ংকর কারবারিদের হাত থেকে এই এলাকাকে বাঁচাতে, যারা যুক্তরাষ্ট্রসহ এ অঞ্চলে ফেন্টানিল-জাতীয় মারাত্মক মাদক ছড়াতে চাইছে।
ট্রাম্পের কাল্পনিক গল্প অনুযায়ী, এই মাদকচক্রের প্রধান হলেন ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো। অথচ বাস্তবে যুক্তরাষ্ট্রে মাদক ঢোকার সঙ্গে ভেনিজুয়েলার প্রায় কোনো সম্পর্কই নেই, এমনকি তারা ফেন্টানিল তৈরিও করে না।
এসব দেখে ২০০০ সালের দিকে আরেক তেলসমৃদ্ধ দেশ ইরাকের কথা মনে পড়ে যায়। তখন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ মিথ্যা অভিযোগের ভিত্তিতে সেখানে গণহত্যা চালিয়েছিলেন।
যদিও সবাই ভেনিজুয়েলায় যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য যুদ্ধের কথা বলছে, যা নিয়ে ট্রাম্প অনেক মাস ধরে হুমকি দিচ্ছেন, আসলে যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যেই ভেনিজুয়েলার বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ, যাকে আজকাল ‘যুদ্ধ সচিব’ বলা হচ্ছে, তিনিও সম্প্রতি এ কথা স্বীকার করেছেন। ক্যারিবীয় অঞ্চলের জেলেদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধাপরাধের ঘটনাকে তিনি ‘যুদ্ধের ভুল বোঝাবুঝি’ বলে পাশ কাটিয়ে যান। আসলে ভেনিজুয়েলার ওপর আমেরিকার যুদ্ধ এ বছর জেলেদের হত্যা এবং ভয় দেখানোর ঘটনার অনেক আগেই শুরু হয়েছে।
মাদুরোর পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্ট হুগো শাভেজ ছিলেন সমাজতন্ত্রের একজন আইকন এবং আমেরিকার চক্ষুশূল। ২০০২ সালে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার একটি ব্যর্থ অভ্যুত্থানে মদদ দেওয়ার পর ২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র ভেনিজুয়েলার ওপর কঠিন নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেয়। ওয়াশিংটন ডিসির সেন্টার ফর ইকোনমিক অ্যান্ড পলিসি রিসার্চের মতে, ওই নিষেধাজ্ঞার কারণে শুধু ২০১৭-১৮ সালেই দেশটিতে ৪০ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা গেছে। অর্থনৈতিক চাপ কতটা ভয়ংকর হতে পারে, তা জানতে চাইলে ১৯৯৬ সালে জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত ম্যাডেলিন অলব্রাইটের কথা স্মরণ করুন। তাকে যখন বলা হয়, মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরাকের প্রায় ৫ লাখ শিশু মারা গেছে, তখন তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা মনে করি এই ক্ষতি মেনে নেওয়া যায়।’
২০১৯ সালে ট্রাম্প সেই নিষেধাজ্ঞা আরও কঠোর করেন। এর উদ্দেশ্য ছিল জুয়ান গুয়াইদোকে সাহায্য করা। এই সামান্য পরিচিত ডানপন্থী নেতা নিজেকে ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করে মাদুরোকে সরাতে চেয়েছিলেন। সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং গুয়াইদো মায়ামিতে চলে যান। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে থাকে। ২০১৯ সালের মার্চ মাসে ট্রাম্পের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পিও অর্থনৈতিক যুদ্ধের কার্যকারিতা নিয়ে সাংবাদিকদের কাছে গর্বের সঙ্গে বলেছিলেন, ‘চাপ বাড়ছে। মানবিক সংকট প্রতিমুহূর্তে বাড়ছে...ভেনিজুয়েলার মানুষ যে কষ্ট ও যন্ত্রণা ভোগ করছে, তা আপনারা দেখতে পাচ্ছেন।’
সাধারণভাবে বলা হয়, এই নিষেধাজ্ঞাগুলো ক্ষমতাশালীদের জন্য, কিন্তু আসলে সাধারণ মানুষকেই এর চরম মূল্য দিতে হয়। গুয়াইদোর ব্যর্থতার পরের বছরগুলোতে ভেনিজুয়েলার মানুষের ‘দুঃখ-কষ্ট’ আরও বাড়তে থাকে। ২০২০ সালের মধ্যে জাতিসংঘের সাবেক বিশেষ প্রতিবেদক আলফ্রেড ডি জাইয়াস অনুমান করেন, নিষেধাজ্ঞার কারণে ১ লাখ ভেনিজুয়েলান মারা গেছেন। ২০২১ সালে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ অ্যালেনা দুহান জানান, এই অর্থনৈতিক অবরোধের কারণে ২৫ লাখেরও বেশি ভেনিজুয়েলান খাদ্যের তীব্র অভাবে ভুগছেন। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে আগে নিয়ন্ত্রণ করা রোগগুলো আবার ফিরে আসা, শিশুদের শারীরিক বিকাশ কমে যাওয়া এবং পানি ও বিদ্যুতের অভাব।
এদিকে, একটি বিষয় অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, ভেনিজুয়েলার কথিত মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে যখন ট্রাম্প ব্যবস্থা নিচ্ছেন, ঠিক তখনই তিনি হন্ডুরাসের ডানপন্থি সাবেক প্রেসিডেন্ট জুয়ান অরল্যান্ডো হার্নান্দেজকে ক্ষমা করে দেন, যিনি গত বছর আমেরিকার একটি ফেডারেল আদালতে মাদক ব্যবসার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন।
অক্টোবরে ট্রাম্প সিআইএকে ভেনিজুয়েলার ভেতরে গোপন সামরিক অভিযান চালানোর অনুমতি দেন-সেই সিআইএ, মনে রাখবেন, যারা অনেক আগে থেকেই মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এখন ট্যাঙ্কার ছিনিয়ে নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসন স্পষ্ট করে দিল যে তারা ভদ্র ও সভ্য আলোচনাকে একেবারেই পাত্তা দেয় না।
কয়েকদিন আগে আমি এক ভেনিজুয়েলান যুবকের সঙ্গে কথা বলছিলাম, যার সঙ্গে ২০২৩ সালে ডারিয়েন গ্যাপে দেখা হয়েছিল। তিনি তখন যুক্তরাষ্ট্রে অর্থনৈতিকভাবে একটি ভালো জীবনের সন্ধানে যাচ্ছিলেন। তিনি লাখ লাখ ভেনেজুয়েলানের একজন, যারা দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন।
মেক্সিকো থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ঢোকার সময় নদীতে তার ডুবে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। এরপর তিনি এক মাস জেলে ছিলেন, তারপর শর্তসাপেক্ষে ছাড়া পান। দুই বছর পর ক্যালিফোর্নিয়ায় তাকে আবার ধরে ফেলা হয়, আরও কয়েক মাস জেলে থাকার পর তাকে কারাকাসে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
ভেনিজুয়েলা নিয়ে ট্রাম্পের বর্তমান কৌশলগুলো সম্পর্কে তার মতামত জানতে চাইলে তিনি শুধু বলেন : ‘আমার বলার কোনো ভাষা নেই।’ আর যুক্তরাষ্ট্র যখন সরাসরি মিথ্যা নিয়ে আরেকটি অবাস্তব যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন সত্যি বলতে কী, কথা খুঁজে পাওয়া আসলেই কঠিন।
আল জাজিরা থেকে ভাষান্তরিত
বেলান ফার্নান্দেজ : লেখক ও আল জাজিরার কলামিস্ট
