দাসত্ব থেকে অভিবাসন : দায় নিতে হবে সবাইকেই
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
চার শিকারির হাতে বন্দি হয়ে মাটিতে পড়ে থাকা কুন্ত কিন্তে যখন মরিয়া হয়ে নিজের জন্মভূমির মাটি আঁকড়ে ধরেছিল, তখন সে কেবল একজন মানুষের শেষ প্রতিরোধই দেখায়নি-সে মানব ইতিহাসের এক চিরন্তন সত্য উচ্চারণ করেছিল : মানুষকে তার শিকড় থেকে আলাদা করা যায়, কিন্তু শিকড়কে মানুষ থেকে আলাদা করা যায় না। এক মুঠো মাটি মুখে পুরে নেওয়া ছিল তার অসহায়ত্বের পাশাপাশি আত্মমর্যাদার ঘোষণা। দাস ব্যবসায়ীরা তার নাম বদলে দিয়েছিল, শরীর শৃঙ্খলে বেঁধেছিল, কিন্তু পরিচয় ও স্মৃতিকে বন্দি করতে পারেনি।
আলেক্স হেলির রুটস প্রকাশের পর বহু দশক কেটে গেছে। দাসপ্রথা আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত হয়েছে, শিকল আর নিলামের মঞ্চ নেই। অথচ আজকের পৃথিবীতে তাকালে প্রশ্ন জাগে-মানুষের সেই জোরপূর্বক উৎখাত কি সত্যিই শেষ হয়েছে? নাকি তা কেবল রূপ বদলেছে?
অষ্টাদশ শতকে মানুষকে জোর করে জাহাজে তোলা হতো আর একুশ শতকে মানুষ নিজেই জমানো সব অর্থ দালালের হাতে তুলে দিয়ে মৃত্যুর জাহাজে চড়ছে। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম)-এর তথ্যমতে, প্রতিবছর তৃতীয় বিশ্বের লাখ লাখ মানুষ পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে পাড়ি জমাচ্ছে। কেবল ২০২৩ সালেই বিশ্বজুড়ে প্রায় তিন কোটি মানুষ নতুন করে আন্তর্জাতিক অভিবাসীতে পরিণত হয়েছে। এ যাত্রা স্বেচ্ছায় হলেও এর পেছনে রয়েছে দারিদ্র্য, যুদ্ধ, রাজনৈতিক নিপীড়ন, জলবায়ু বিপর্যয় এবং বৈশ্বিক বৈষম্যের নির্মম বাস্তবতা। ফলে এ ‘স্বেচ্ছাযাত্রা’ অনেক ক্ষেত্রেই প্রকৃতপক্ষে বাধ্যতামূলক।
কেউ বৈধ পথে ভিসা পড়াশোনার নামে, কাজের অনুমতি নিয়ে বা আশ্রয়প্রার্থী হিসাবে। এর পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক মানুষ অবৈধ পথে ঝুঁকি নেয়, কারণ বৈধ দরজা তাদের জন্য প্রায় বন্ধ। এ অবৈধ পথের সবচেয়ে ভয়াবহ অধ্যায় ভূমধ্যসাগর। একে আজ অনেকে বলেন ‘অভিবাসীদের কবরস্থান’। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর হিসাব অনুযায়ী, গত এক দশকে কেবল ভূমধ্যসাগরেই ডুবে মারা গেছে ১০ হাজার মানুষ। প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি; কারণ অনেক মৃত্যুই নথিভুক্ত হয় না।
ভূমধ্যসাগর ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্ত, সাহারা মরুভূমি, বলকান রুট-সবখানেই অভিবাসীদের লাশ পড়ে থাকে নামহীন, ইতিহাসহীন। পথে অনাহারে, পানিশূন্যতায়, মানব পাচারকারীদের নির্যাতনে, সীমান্তরক্ষীদের গুলিতে বা ঠান্ডায় মারা যায় অসংখ্য মানুষ। তারা কেউই জন্মগতভাবে ‘অবৈধ’ ছিল না; অবৈধ করে তোলা হয়েছে তাদের জীবনকে।
এ সংকটের শিকড় কোথায়? একে কেবল মানব পাচারকারী চক্র বা সীমান্ত নিরাপত্তার সমস্যা হিসাবে দেখলে প্রকৃত সত্য আড়াল হয়ে যায়। মূলত এটি বৈশ্বিক বৈষম্যের ফল। যেসব দেশ একসময় উপনিবেশ শোষণ করে সম্পদ কুক্ষিগত করেছে, আজ তারাই সবচেয়ে শক্তিশালী। পাশ্চাত্যের দেশগুলো যেখানে বিলাসিতায় মগ্ন, সেখানে গ্লোবাল সাউথ বা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো আজও ঔপনিবেশিক শোষণের ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে। এখানকার যুবসমাজ দেখছে তাদের দেশের সম্পদ পাচার হয়ে যাচ্ছে উন্নত বিশ্বে, অথচ তাদের জন্য নেই কর্মসংস্থান, নেই জীবনের নিরাপত্তা। ফলে তারা মনে করে, নিজের দেশে মর্যাদা না পাওয়া, ভীতিকর পরিস্থিতিতে থাকা কিংবা না খেয়ে মরার চেয়ে ইউরোপ বা আমেরিকার পথে সমুদ্রে মরা অনেক বেশি ‘মর্যাদাপূর্ণ’।
এখানেই শেষ নয়। ‘গণতন্ত্র’, ‘সভ্যতা’, ‘মানবাধিকার’ ইত্যাদি নানা কিছু বিক্রির আড়ালে আসলে নিরন্তর হস্তক্ষেপ করে গরিব দেশগুলোকে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগটাও দিতে চাচ্ছে না। এখনো অবাধে চলছে খনিজসম্পদ শোষণ। এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যতিন আমেরিকার দেশগুলোকে নিজেদের সমস্যা নিজেদের মতো করে সমাধান করতেও দিচ্ছে না। আর যেসব অঞ্চল শতাব্দীর পর শতাব্দী লুণ্ঠিত হয়েছে, সেখানকার মানুষ আজ জীবন বাঁচাতে সেই পুরোনো শাসকদের দেশেই ছুটছে।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আধুনিক যুদ্ধ ও জলবায়ু সংকট। মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ, আফ্রিকার গৃহসংঘাত, দক্ষিণ এশিয়ার বেকারত্ব ও পরিবেশ বিপর্যয় মানুষকে ভিটেমাটি ছাড়তে বাধ্য করছে। অথচ এসব সংকটের বড় অংশের দায়ও বৈশ্বিক শক্তির ওপর বর্তায়-অস্ত্র ব্যবসা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং কার্বন নিঃসরণের মাধ্যমে।
সমাধান তাহলে কী? দেওয়াল তোলা, সীমান্ত কাঁটাতারে ঘেরা বা নৌকা ডুবিয়ে দেওয়া কোনো সমাধান নয়; ইতিহাস তা প্রমাণ করেছে। মানুষের চলাচল থামানো যায় না, কেবল তাকে আরও বিপজ্জনক করা যায়।
প্রথমত, বৈধ ও নিরাপদ অভিবাসনের পথ খুলতে হবে। কাজ, শিক্ষা ও আশ্রয়ের জন্য বাস্তবসম্মত কোটা ও মানবিক নীতি প্রয়োজন। যখন বৈধ পথ বন্ধ থাকে, তখন মানুষ অবৈধ পথে যেতে বাধ্য হয়।
দ্বিতীয়ত, উৎস দেশগুলোর উন্নয়নে আন্তরিক বিনিয়োগ দরকার। দান বা ঋণ নয়, ন্যায্য বাণিজ্য, প্রযুক্তি হস্তান্তর ও স্থানীয় শিল্পায়নের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে, যাতে মানুষ নিজের দেশেই ভবিষ্যৎ দেখতে পায়।
তৃতীয়ত, যুদ্ধ ও রাজনৈতিক সংকটে আন্তর্জাতিক দায়িত্বশীলতা বাড়াতে হবে। অস্ত্র রপ্তানি বন্ধ করা, শান্তি প্রতিষ্ঠায় কার্যকর ভূমিকা রাখা এবং শরণার্থীদের বোঝা সমানভাবে ভাগ করে নেওয়া জরুরি।
চতুর্থত, জলবায়ু অভিবাসীদের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিতে হবে। যারা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি বা খরার কারণে দেশ ছাড়ছে, তারা কেবল ‘অর্থনৈতিক অভিবাসী’ নয়-তারা জলবায়ু শরণার্থী।
সবশেষে প্রয়োজন মানসিকতার পরিবর্তন। অভিবাসীরা বোঝা নয়; তারা শ্রম, সংস্কৃতি ও ইতিহাস নিয়ে আসে। পাশ্চাত্যের বহু অর্থনীতিই অভিবাসীদের শ্রমে দাঁড়িয়ে আছে-এ সত্য অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
কুন্তা কিন্তে এক মুঠো মাটি মুখে নিয়ে বলেছিল, ‘আমার শিকড়কে আমার থেকে আলাদা করতে পারবে না।’ আজকের অভিবাসীরাও তাই বলে-যদিও ভাষা বদলেছে, সমুদ্র বদলেছে, শিকল বদলেছে। মানবসভ্যতার সত্যিকারের পরীক্ষা এখানেই : আমরা কি মানুষকে মানুষ হিসাবে দেখব, নাকি ইতিহাসের নতুন রূপে আবারও তাকে কুন্তা বানিয়ে ফেলব?
কুন্তা কিন্তে যখন মাটি মুখে দিয়েছিলেন, তখন তার মনে যে হাহাকার ছিল, আজ ভূমধ্যসাগরে ডুবতে থাকা একজন পিতার চোখেও একই হাহাকার দেখা যায়। তফাত শুধু এই যে, কুন্তা ছিলেন শিকলবন্দি শিকার আর আজকের অভিবাসীরা ব্যবস্থার শিকার। পৃথিবীটা কেবল কয়েকটা দেশের জন্য নয়, বরং প্রতিটি মানুষের জন্য সমানভাবে নিরাপদ হওয়া উচিত। মানুষ যেন কেবল ক্ষুধার্ত পেটে বা প্রাণভয়ে ঘর না ছাড়ে, বরং তার যাত্রা যেন হয় মেধা ও স্বপ্নের। কুন্তা কিন্তের সেই মাটির স্বাদ যেন আজকের প্রজন্মের কাছে বিস্বাদ না হয়, বরং তা যেন হয় আপন ঘরে ফেরার প্রশান্তি-এটাই হওয়া উচিত আগামীর লক্ষ্য।
মোহাম্মদ হাসান শরীফ : সাংবাদিক

