জনতার নেতা যে নতুন বাংলাদেশ গড়ার কথা বললেন
মো. জামাল উদ্দিন রুনু
প্রকাশ: ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৭:০৩ পিএম
বক্তব্য রাখছেন তারেক রহমান। ছবি: সংগৃহীত
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
১৭ বছরেরও বেশি সময়ের নির্বাসন শেষে দেশে ফিরে যখন তিনি জনসমুদ্রের সামনে দাঁড়ালেন; যখন জনগণের ভালোবাসাসিক্ত স্বতঃস্ফূর্ত হর্সধ্বনি গোটা বাংলাদেশকে আন্দোলিত করল; যখন তিনি নির্বাসন জীবনের ব্যক্তিগত বঞ্চনা ও কষ্টের বর্ণনা সরিয়ে রেখে ন্যায়পরায়ণতার আলোকে দেশের লিঙ্গ, বয়স, শ্রেণি, পেশা ও ধর্ম নির্বিশেষে সবার জন্য নিরাপদ বাংলাদেশ গড়ার বার্তা দিলেন; তখনই বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থে এক মহান জননেতার উত্থান প্রত্যক্ষ করল। দেশবাসীর উচ্ছ্বসিত উষ্ণ সংবর্ধনা ও অভ্যর্থনায় মহীয়ান হয়ে ওঠা এমন স্বদেশ প্রত্যাবর্তন খুব কম জননায়কের ভাগ্যে জোটে।
সেই দিক থেকে বিবেচনা করলে বলা যায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানের এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও সংক্ষিপ্ত ভাষণ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা।
গণতান্ত্রিক উত্তরণের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য একজন নেতার যে প্রজ্ঞা ও অন্তর্দৃষ্টি প্রয়োজন তা এক দিনে অর্জন করেননি তারেক রহমান। তিনি কখনও মন্ত্রীত্ব নেননি, সরাসরি দলের সর্বোচ্চ পদেও আসীন ছিলেন না।
তবুও কী অবলীলায়, কী নিঃসংকোচে, কী দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র-এর 'আই হ্যাভ আ ড্রিম'খ্যাত ভাষণের প্রতিধ্বনি করে তিনি বলে উঠলেন ‘আই হ্যাভ আ প্ল্যান।’ আর সাধারণ মানুষও তার সেই কথায় ভরসা পেল, উদ্বেলিত হলো।
তারেক রহমানের রাজনৈতিক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, তিনি আচমকা বা রাতারাতি রাজনীতিতে আসেননি। ধীরে ধীরে সময়ের বহু চড়াই উতরাই পার হয়ে তিনি আজ মানুষের নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনি নিজেকে নবায়ন করেছেন। নিজেকে প্রস্তুত করেছেন সাধারণ কর্মী থেকে রাজনৈতিক নেতা হিসেবে।
বগুড়ার গাবতলী উপজেলা বিএনপির সাধারণ সদস্য হিসেবে যোগ দিয়ে প্রথমে তৃণমূলে সংযোগ তৈরি করেছিলেন তারেক রহমান। তখন থেকে একটু একটু করে তিনি নিজেকে গড়ে তুলেছেন তাদেরই একজন করে।
তারেক রহমান তার মা খালেদা জিয়ার গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও দেশ গড়া খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন গভীরভাবে। তিনি শিখেছেন এবং রাজনীতিতে অবদান রাখারও চেষ্টা করেছেন। তিনি ষড়যন্ত্র ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এবং নির্বাসিত হয়েছেন। কিন্তু হারিয়ে যাননি বা চুপ হয়ে যাননি। তিনি দুঃসহ নির্বাসন জীবনেও গণতন্ত্রের শিখা জ্বালিয়ে রেখেছেন, আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে বুঝেছেন, তার দায়িত্ব অনেক বড়, ঐতিহাসিক। তিনি প্রতিকূলতার মধ্যে টিকে থেকে সঠিক সময়ের অপেক্ষা করেছেন। তিনি ফ্যাসিবাদ হঠানো এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার দিকে দেশকে নেতৃত্ব দেয়ার পথে ভূমিকা রেখেছেন। তার এমন ভালোবাসা ও সম্মানের সঙ্গে ফিরে আসা প্রমাণ করেছে, সত্যিকার অর্থেই তিনি জণগনের নেতা, জনতার নেতা।
স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনে জাতির সামনে তারেক রহমানের দেওয়া বক্তব্যে তার যে দৃষ্টিভঙ্গি ও পরিকল্পনার কথা উঠে এসেছে, তা দেশ পুনর্গঠনের এক নৈতিক ও রাজনৈতিক রূপরেখা। আর সেই রূপরেখা দাঁড়িয়ে আছে গুরুত্বপূর্ণ কিছু স্তম্ভের ওপর।
এ স্তম্ভগুলো জনগণের প্রত্যাশিত বাংলাদেশ গড়ে তোলার চেতনার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
কল্যাণরাষ্ট্র হিসেবে নিরাপদ, গণতান্ত্রিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে তারেক রহমান রাষ্ট্র, সমাজ ও নাগরিক সম্পর্ককে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করার নৈতিক ও মানবিক প্রস্তাব রেখেছেন।
গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ
তারেক রহমানের বক্তব্যের কেন্দ্রে রয়েছে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন, যেখানে শান্তি কোনো আপসের বিষয় নয়, বরং রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব।
নিরাপদ বাংলাদেশের ধারণা এখানে প্রতীকী নয়; বরং বাস্তব। তারেক রহমান যে নিরাপদ বাংলাদেশ এর পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন, সেখানে নারী-পুরুষ- শিশু নির্বিশেষে সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে নিরাপদে ঘরে ফিরে আসতে পারবেন। এখানে গণতন্ত্রকে কেবল নির্বাচন বা ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া হিসেবে দেখা হয়নি; বরং গণতন্ত্রকে দেখা হয়েছে নাগরিকের নিরাপত্তা, বাকস্বাধীনতা ও ন্যায়বিচারের অবিচ্ছেদ্য ভিত্তি হিসেবে। আর এই দৃষ্টিভঙ্গির গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো অন্তর্ভুক্তি।
পাহাড় ও সমতলের মুসলিম-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সবাইকে নিয়ে দেশ গঠনের তিনি যে আহ্বান জানিয়েছেন, তা বাংলাদেশের সেই বহুত্ববাদী বাস্তবতাকে স্বীকৃতি দেয়, যেখানে নাগরিকের অধিকার নির্ধারিত হবে যোগ্যতা ও মেধা দিয়ে। শাসনের ভিত্তি হিসেবে ন্যায় ও ইনসাফের উল্লেখ করেছেন তিনি। আর ন্যায় ও ইনসাফ মানবিক রাষ্ট্রের অন্যতম শর্ত।
আই হ্যাভ আ প্ল্যান
বক্তব্যে তারেক রহমান বলেছেন: আই হ্যাভ আ প্ল্যান। তার এই 'প্ল্যান' নিছকই আবেগী কোন স্লোগান নয়; এটি একটি সুস্পষ্ট রাজনৈতিক অবস্থান। বাস্তবায়নযোগ্য এ পরিকল্পনার মূলে তিনি প্রাধান্য দিয়েছেন গণতান্ত্রিক অধিকার পুনরুদ্ধার করাকে।
স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিবাদী শাসনামলে এ দেশের মানুষ বাকস্বাধীনতা উপভোগ করতে পারেনি। তাদের রাজনৈতিক অধিকারের মর্যাদাহানি করা হয়েছে ও অর্থনৈতিক ন্যায্যতাকে ভূলুণ্ঠিত করা হয়েছে।
এখন সময় অন্যায়, দুর্নীতি, দমন-পীড়ন ও বৈষ্যমের বিপরীতে গণতান্ত্রিক, ন্যায্যতার ও শক্তিশালী অর্থনীতির বাংলাদেশ গড়ে তোলার। রাজনৈতিক অধিকার ছাড়া অর্থনৈতিক মুক্তি সম্ভব নয়।
আবার অর্থনৈতিক ভিত্তি দুর্বল হলে গণতন্ত্র টেকসই হয় না। এই পারস্পরিক সম্পর্কের স্বীকৃতি একটি আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে তারেক রহমানের সুদূরপ্রসারী ভাবনার পরিচয় দেয়, যে ভাবনায় গুরুত্ব পেয়েছে মেধা ও যোগ্যতা, ন্যায়বিচার এবং সুদৃঢ় অর্থনৈতিক ভিত্তি।
শৃঙ্খলা ও ধৈর্য
প্রতিকূল অবস্থা মোকাবিলায় সবচেয়ে প্রয়োজন হচ্ছে শৃঙ্খলা ও ধৈর্য। উসকানি ও বিশৃঙ্খলা নয়, ধৈর্যই হবে জাতির শক্তি।
যেকোনো মূল্যে শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখা প্রসঙ্গে তারেক রহমান যে আহ্বান জানিয়েছেন, তা কোনো দমনমূলক রাষ্ট্র গঠনের আহ্বান নয়; বরং তা এক ভঙ্গুর সময়ে দেশের নাগরিকদের নিয়ে একসাথে সুস্থিতভাবে এগিয়ে যাওয়ার কৌশল। তারেক রহমান উসকানি, বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা প্রত্যাখ্যান করার কথা বলেছেন। তরুণদের প্রতি ধৈর্য ধরার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি ধৈর্যকে দুর্বলতা নয়, বরং রাজনৈতিক প্রজ্ঞা হিসেবে উপস্থাপন করেছেন।
সার্বভৌমত্ব রক্ষার ইতিহাস
তারেক রহমান তার বক্তব্যে একাত্তর, পঁচাত্তর, নব্বই ও চব্বিশকে সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র রক্ষার ধারাবাহিক লড়াই হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এ কেবল ইতিহাসের স্মৃতিচারণ নয়, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ গঠনের আলোকবর্তিকা।
মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন (১৯৭১), আধিপত্যবাদী শক্তি হটিয়ে দেশের সুরক্ষা (১৯৭৫), স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলনের মাধ্যমে বিজয় (১৯৯০) এবং ফ্যাসিবাদী অপশক্তির কবল থেকে স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের নতুন অধ্যায় (২০২৪)- এই ঐতিহাসিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে তিনি স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন: স্বাধীনতা কোনো একদিনের অর্জন নয়; তাই, যেকোন মূল্যে আমাদের স্বাধীনতা রক্ষা করতে হবে, সকল অপশক্তিকে রুখে দিতে হবে; এবং বাংলাদেশের জনগণ সেটা করবে। দেশ ও মানুষের বিরুদ্ধে যেকোন অপচেষ্টাকেই নস্যাৎ করবে এ দেশের মানুষ—তারেক রহমান এই আস্থা রেখেছেন মানুষের ওপর।
অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্রচিন্তা
বক্তব্যে তারেক রহমান বাংলাদেশের জনসংখ্যার চাহিদা ও অধিকারের যে বিশদ চিত্র তুলে ধরেছেন (চার কোটি তরুণ, পাঁচ কোটি শিশু, ৪০ লাখ বিশেষভাবে সক্ষম ব্যক্তি ও কোটি কোটি কৃষক-শ্রমিক) তা নিছকই পরিসংখ্যান নয়, বরং রাষ্ট্রের কাছে এক নৈতিক দাবি। বৈচিত্র্যময় এ জনসমষ্টির প্রত্যাশা পূরণ না করে জাতীয় ঐক্য সম্ভব নয়। এই উপলব্ধিই তার এ বক্তব্যের শক্তি।
রাজনৈতিক দলীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে সবাইকে রাষ্ট্রের অংশীদার হিসেবে দেখার জন্য যে আহ্বান তারেক রহমান জানিয়েছেন, তা তার পরিণত গণতান্ত্রিক মানসিকতারই প্রকাশ। তিনি তরুণদের শুধু শক্তি হিসেবেই নয়, দায়িত্বশীল নেতৃত্বের ভবিষ্যৎ হিসেবে তুলে ধরেছেন। শিশুদের ভবিষ্যৎ নিরাপদ রাষ্ট্রের সাফল্যের মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করেছেন, বিশেষভাবে সক্ষম ব্যক্তিদের কথা উল্লেখ করে মানবিক রাষ্ট্রচিন্তার পরিচয় দিয়েছেন।
তারেক রহমান যে উন্নয়নের কথা বলেছেন, সে উন্নয়নের সংজ্ঞা কেবল অবকাঠামোর সংকীর্ণ পরিসরে আবদ্ধ নয়, বরং অন্তর্ভুক্তি সেই উন্নয়নের প্রধানতম অনুষঙ্গ।
ধর্ম, মতাদর্শ, ব্যক্তি ও রাজনৈতিক পরিচয়—সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার অঙ্গীকার একটি প্রকৃত নাগরিক রাষ্ট্রের লক্ষণ। ন্যায় ও ইনসাফের মাধ্যমে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় তারেক রহমান বক্তব্যে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, জনতার নেতা হিসেবে তা তার অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র গঠনের চিন্তাকেই প্রতিফলিত করে।
তরুণদের প্রতি আস্থা
বক্তব্যে তারেক রহমান তরুণদের ওপরে শুধুমাত্র তার আস্থাই প্রকাশ করেননি, পাশাপশি তাদের ওপরে আগামীর বাংলাদেশ গড়ে তোলার দায়িত্বও অর্পণ করেছেন। গণতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক ভিত্তি নির্মাণের ভার তাদের কাঁধেই। শহীদ ওসমান হাদির মতো অকুতোভয় ও দেশপ্রেমিক তরুণদের আত্মত্যাগ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে তিনি বলেছেন, তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই রক্তের ঋণ শোধ করতে হবে। একাত্তর থেকে চব্বিশ-সকল শহীদদের প্রতি দেশ ও দেশের নাগরিকদের যে নৈতিক দায়, তা ন্যায়ভিত্তিক, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার মাধ্যমেই আমাদের শোধ করতে হবে।
তারেক রহমানের ঐতিহাসিক এই বক্তব্যের সারকথা হচ্ছে কল্যাণমূলক জনবান্ধব রাষ্ট্রগঠন। বাংলাদেশ টিকে থাকবে গণতন্ত্র, ন্যায় ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে, তিনি যে প্রজ্ঞা ও রাজনৈতিক দর্শনের পরিচয় দিয়েছেন তা প্রশংসাযোগ্য এবং তার এ বক্তব্য নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ, ইতিবাচক ও গভীর চিন্তাপ্রসূত প্রস্তাব।
লেখক অধ্যাপক মোঃ জামাল উদ্দিন রুনু
পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ
ও
পরিচালক,
শিক্ষার্থী কল্যাণ ও পরামর্শদান কেন্দ্র, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
