Logo
Logo
×

দৃষ্টিপাত

শরিফ ওসমান হাদি হত্যাকাণ্ড: গুজব ও বাস্তবতা

Icon

আহসান হাবিব বরুন

প্রকাশ: ২৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০:৩২ পিএম

শরিফ ওসমান হাদি হত্যাকাণ্ড: গুজব ও বাস্তবতা

শহীদ শরিফ ওসমান হাদি। ফাইল ছবি

বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে সংঘটিত শরিফ ওসমান হাদির হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের সমকালীন রাজনৈতিক ইতিহাসে এক গভীর ক্ষতচিহ্ন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের তফসিল ঘোষণার মাত্র ২০ ঘণ্টার মধ্যেই ১২ ডিসেম্বর ঢাকার পুরানা পল্টনের বক্স কালভার্ট রোডে প্রকাশ্য দিবালোকে তাকে গুলি করা হয়। দেশ-বিদেশের চিকিৎসকদের সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে সাত দিনের মধ্যে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। শত কোটি টাকার বিনিয়োগে পরিকল্পিত এ নৃশংস হত্যাকাণ্ড কেবল একজন রাজনৈতিক কর্মীর জীবন কেড়ে নেয়নি, বরং রাষ্ট্র, রাজনীতি, গণতন্ত্র এবং গণমাধ্যমকে কঠিন এক পরীক্ষার মুখোমুখি করেছে।

জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে যখন রাষ্ট্র সংস্কার, নির্বাচন প্রস্তুতি এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনর্গঠনের সন্ধিক্ষণে বাংলাদেশ, ঠিক তখনই ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও উদীয়মান রাজনৈতিক কণ্ঠস্বর শরিফ ওসমান হাদির ওপর এই সুপরিকল্পিত হামলা অনেকের চোখে একটি বিচ্ছিন্ন অপরাধ নয়; বরং এটি একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক ও কৌশলগত ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত বলে মনে হচ্ছে।

হামলার দিন ও মৃত্যুর প্রেক্ষাপট

১২ ডিসেম্বর দুপুরে মতিঝিলের খলিল হোটেল এলাকা থেকে একটি অটোরিকশায় করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে যাচ্ছিলেন ওসমান হাদি। পথিমধ্যে পল্টনের বক্স কালভার্ট রোডে পৌঁছলে একটি দ্রুতগামী মোটরসাইকেল রিকশাটিকে অনুসরণ করে। প্রত্যক্ষদর্শী ও চালকের জবানবন্দি অনুযায়ী- মোটরসাইকেলে থাকা দুই ব্যক্তি খুব কাছ থেকে হাদির মাথায় লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে এবং মুহূর্তের মধ্যেই নিরাপদে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে।

গুলিবিদ্ধ অবস্থায় প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং পরে এভারকেয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয় তাকে। অবস্থার অবনতি হলে ১৫ ডিসেম্বর এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে পাঠানো হয়। টানা ছয় দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই শেষে ১৮ ডিসেম্বর রাতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এতে শোক, ক্ষোভ ও প্রতিবাদের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক প্রতিবাদী ও তেজস্বী কণ্ঠস্বর ছিলেন শরিফ ওসমান হাদি। অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে তিনি ‘ইনকিলাব মঞ্চ’ গঠন করে সার্বভৌমত্ব, রাষ্ট্র সংস্কার এবং বিদেশি আধিপত্যবাদী প্রভাবের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ নিয়ে তার প্রকাশ্য সমালোচনা এবং আপসহীন বক্তব্য তাকে তরুণ প্রজন্মের কাছে তুমুল জনপ্রিয় করে তোলে।

২০২৫ সালের নির্বাচনে তিনি ঢাকা-৮ আসন থেকে একজন শক্তিশালী স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আলোচনায় ছিলেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, তার এ উত্থান ও জনপ্রিয়তা কিছু প্রভাবশালী মহলের জন্য অস্বস্তিকর হয়ে উঠেছিল। ফলে হত্যাকাণ্ডটি নির্বাচনী পরিবেশ অস্থিতিশীল করা এবং একটি ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করার অপচেষ্টা বলেও অনেকে মনে করছেন।

হত্যাকাণ্ডের পরপরই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যাপক তদন্তে নামে। ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী একে “রহস্যজনক ও পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড” হিসেবে আখ্যায়িত করেন। পুলিশ, ডিবি, র্যাবসহ সব গোয়েন্দা সংস্থাকে কাজে লাগানো হয়েছে বলে তিনি জানান।

এ পর্যন্ত এই মামলায় ১০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত দুটি পিস্তল উদ্ধার করে সিআইডিতে পাঠানো হয়েছে ব্যালিস্টিক পরীক্ষার জন্য। ঘটনার সময় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলও উদ্ধার করা হয়েছে। তদন্তে উঠে এসেছে- এ হত্যাকাণ্ডে বিপুল অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। সিআইডি ২১৮ কোটি টাকার একটি স্বাক্ষরিত চেক উদ্ধার করেছে, যা হত্যার পেছনে সংঘটিত অর্থায়নের ইঙ্গিত দেয়।

ডিএমপি কমিশনার জানিয়েছেন, আগামী ৭ জানুয়ারির মধ্যে মামলার চার্জশিট দেওয়া হবে। তদন্তের স্বার্থে সব তথ্য এখনই প্রকাশ করা সম্ভব নয় বলেও তিনি সতর্ক করেন।

এদিকে হত্যাকারীরা ইতোমধ্যে ভারতে পালিয়ে গেছে এবং হত্যাকারীর দুই সহযোগীকে ভারত সরকার আটক করেছে বলে জানিয়েছেন তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। শাহবাগে অবস্থানরত আন্দোলনকারীদের তিনি জানান, কূটনৈতিক চ্যানেলে ভারত সরকারকে স্পষ্টভাবে জানানো হয়েছে যে, হত্যাকারী ভারতে পাওয়া গেলে যেন তাকে ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করা হয়। ভারত সরকার এ বিষয়ে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বলেও তিনি আশ্বস্ত করেন।

তিনি আরও বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার একটি “শত্রুপক্ষের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে” এ বিচার নিশ্চিত করতে কাজ করছে এবং বর্তমান সরকারের সময়েই এ হত্যাকাণ্ডের বিচার সম্পন্ন হবে।

অপরদিকে হাদি হত্যাকাণ্ডের পর সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক ছিল পরিকল্পিত গুজব ও অপপ্রচার। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া ভিডিও, মিথ্যা আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের উদ্ধৃতি এবং এআই-নির্ভর বিভ্রান্তিকর কনটেন্ট ছড়িয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার চেষ্টা করা হয়। আল-জাজিরা ও ফ্রান্স ২৪-এর নামে ছড়ানো ভিডিওগুলো পরে ভুয়া প্রমাণিত হয়।

এ গুজবকে কেন্দ্র করে কিছু স্থানে সহিংসতা, গণমাধ্যমে হামলা এবং কূটনৈতিক স্থাপনায় আক্রমণের ঘটনাও ঘটে। বিশেষ করে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা বা ডিজিএফআইয়ের দিকে আঙুল তোলা হয়।

এসব গুজব ও ভিত্তিহীন অভিযোগের ফলে দেশের গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এর ফলে ষড়যন্ত্রকারী আধিপত্যবাদী সেই শক্তিই লাভবান হচ্ছে বলে আমি মনে করি। এ ব্যাপারে আমাদের আরও অধিকতর  সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।

বহুল আলোচিত এ হত্যাকাণ্ড আবারও স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে, সংকটকালে দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। তথ্য যাচাই না করে গুজব ছড়ানো যেমন বিপজ্জনক, তেমনি আবেগনির্ভর প্রতিক্রিয়াও প্রকৃত অপরাধীদেরই সুবিধা করে দেয়।

রাষ্ট্রের সামনে এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো পলাতক মূল অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা। অর্থের উৎস ও রাজনৈতিক নেটওয়ার্ক উন্মোচন করা এবং বিচার প্রক্রিয়াকে গুজব ও চাপমুক্ত রাখা। 

এখন দেখার বিষয়, বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ এ হত্যার আসল রহস্য উদঘাটন ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারে নাকি এ হত্যাকাণ্ড জাতির জন্য আক্ষেপ হয়ে থাকবে- আরেকটি অমীমাংসিত রাজনৈতিক ট্র্যাজেডি হিসেবে। 

শেষ কথা

আমি মনে করি, শরিফ ওসমান হাদির রক্ত নিছক কোনো দলের বা গোষ্ঠীর নয় বরং এটি একটি জাতির সার্বজনীন শোকের বিষয়। এ শোককে শক্তিতে রূপান্তর করতে হলে প্রয়োজন সংযম, সচেতনতা ও আইনের শাসনের প্রতি আস্থা। গুজবে কান না দিয়ে সত্যের পক্ষে দাঁড়ানোই হবে এ মুহূর্তে আমাদের সবচেয়ে বড় নাগরিক দায়িত্ব।

আমাদের মনে রাখতে হবে যে, সত্য কখনো চাপা পড়ে থাকে না। আমি বিশ্বাস করি, এ হত্যাকাণ্ডের রহস্যময় অন্ধকার সহসাই সরে যাবে। উন্মোচিত হবে প্রকৃত সত্য ও রহস্য। কারণ কথায় আছে- 'সত্যের নাও সাতবার ডুবে সাতবার ভাসে।'

লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক, ঢাকা।

ahabibhme@gmail.com 

ঘটনাপ্রবাহ: ওসমান হাদি গুলিবিদ্ধ


আরও পড়ুন

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম