পৃথিবীতে গরীব হয়ে জন্মানো সবচেয়ে ব্যয়বহুল বিষয়
রহমান মৃধা, সুইডেন থেকে
প্রকাশ: ১৫ জানুয়ারি ২০২০, ০২:৪১ পিএম
কিডনি রোগে আক্রান্ত মুমূর্ষু শিশু নূর মোমিন
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
পৃথিবীতে গরীব হয়ে জন্মানো বর্তমান সময়ে সবচেয়ে ব্যয়বহুল বিষয়। সহজ করে বলতে হয় দরিদ্র হওয়া মানেই খুবই ব্যয়বহুল (too expensive to be a poor)। এদের সংখ্যা পৃথিবীতে কত তা বলতে পারব না, এমনকি বাংলাদেশে কত তাও জানিনে। তবে এরা ব্যয়বহুল।
একজন গরীব নিজেই বলবে আমার আবার খরচ কি সারাদিন ভিক্ষা করি, যা আয় করি তাতেই চলে যায়। জীবনে চাওয়া পাওয়ার পরিমাণ খুবই কম। এটা যেমন গরীবের ধারনা এটা আমাদের সবার ধারনা। কিন্তু বাস্তবে তা নয়, কারণ বড় লোকের মত মান সম্মত করে যদি তাদের জীবনকেও গড়তে হয় তখন বোঝা যাবে কী পরিমাণ বিনিয়োগের প্রয়োজন।
এরা নিজেরা যদি ব্যাংকে গিয়ে বলে কিছু টাকা ঋণ নিতে চাই, পাবে না কারণ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ যে সমস্ত ডকুমেন্ট চাইবেন তা তারা দিতে বা দেখাতে পারবেন না। এরা ভালো রেস্টুরেন্টে বা ভালো হোটেলে ঢুকতে পারবে না। এদের কেউ দাওয়াত করবে না। এদের সবাই ভিক্ষা দিবে বা দান করবে।
ভিক্ষা বা দানের কারণে বড় লোকের জন্য আখেরাতের সুযোগ সুবিধা বাড়বে বিধায় তারা দান খয়রাত করে থাকে। শুরুতেই বড় লোক হয়ে জন্মানোর পিছে যথেষ্ট ভালো যুক্তি রয়েছে। কারণ গরীব হয়ে জন্মানো ব্যয়বহুল অন্যদিকে বড় লোক হয়ে জন্মানো ব্যয় যেমন কম ঝামেলাও কম।
বড়লোক হলে সব কিছু দিব্যি পাওয়া সম্ভব। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বাড়িতে এসে ঋণ দিয়ে যাবে। হোটেল রেস্টুরেন্টে গেলে যত্ন করবে ইত্যাদি। জীবনের শুরুটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যে জন্মেছে তাকে দোষ দেয়া যাবে না তবে যে জন্মদাতা তাকে বিষয়টি ভাবতে হবে।
বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি বিল গেট বলেছেন, জন্মের শুরুতে বাবা-মা পাওয়া এটা চয়েস নয় তবে শ্বশুর শাশুড়ী পাওয়া চয়েস। কথাটির মাঝে সেন্স রয়েছে। হঠাৎ ধনী দরিদ্র নিয়ে লিখতে বসলাম কিন্তু কেন, কি এমন নতুন কিছু এতে রয়েছে এটাই সবাই বলবে।
নতুন বা পুরনো বলে কথা নয়, সব কিছুর পরিবর্তন হচ্ছে কিন্তু অনেক গরীবের জীবনের পরিবর্তন হচ্ছে না। ভাগ্য? ভাগ্য কি পুনঃনির্ধারিত নাকি তাকে পরিবর্তন করা সম্ভব? আমি স্রষ্টাকে বিশ্বাস করি তাই বিশ্বাস করি ভাগ্যের পরিবর্তনকেও। তবে পরিবর্তনে দরকার কিছুটা সাহায্য এবং সহানুভূতির।
সমাজের দায়িত্ব এবং কর্তা ব্যক্তি যদি একটু সহানুভূতির পরিচয় দেয় তবে পৃথিবীর অনেক গরীবের ভাগ্যের পরিবর্তন হতে পারে বলে আমি বিশ্বাস করি। সদ্য ঘটে যাওয়া একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে লিখা একজন সমাজ সেবীর ফেসবুকের স্ট্যাটাস তুলে ধরি।
শাহজাহানকে আমি চিনি কারণ সে দেশের অনেক মানবিক আবেদন জানিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেয়। আমি চেষ্টা করি তার কাজে হাত বাড়াতে। শাহজাহান আমার এলাকার ছেলে, সে লিখেছে তার বর্ণনায়-
“অসহায়ত্বের নির্মম গল্প! শুনবে কি কেউ? কিডনি রোগে আক্রান্ত শিশু নূর মোমিনের চিকিৎসা সহায়তা চেয়ে নিজের ফেসবুক পেজে একটি মানবিক আবেদন জানিয়েছিলাম সপ্তাহখানেক আগে। বিষয়টি অত্যন্ত মানবিক বিধায় দেশে এবং প্রবাসে অবস্থিত অসংখ্য মানুষ নূর মোমিনের সুস্থতার জন্য যেমন সৃষ্টিকর্তার নিকট দোয়া করছেন।
পাশাপাশি কিছু মহৎপ্রাণ মানুষ প্রচার প্রচারণা এবং আর্থিকভাবে সহযোগিতা করে শিশুটির উন্নত চিকিৎসা কাজে সাহস যুগিয়ে চলছেন।
এরই ধারাবাহিতায় বরাবরের ন্যায় সুইডেন প্রবাসী রহমান মৃধা, কাজী শহীদ, ভাই, বন্ধু নাজমা পারভীন, চাচা মো. হাবিবুল্লাহ, মুক্তা মেসবাহুল ইসলাম, হাসিব উদ্দিন, শামসুদ্দিন ভাইদের সহযোগিতায় কয়েকজন স্বনামধন্য চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে গতকাল নূর মোমিনের পিতা-মাতা তাদের বাছাধনকে উন্নত চিকিৎসার উদ্দেশ্যে গ্রাম থেকে ঢাকার পথে যাত্রা করেন।
গতকাল দীর্ঘ যাত্রার পর ভ্রমণ ক্লান্তিকে সঙ্গী করে প্রথমে ধানমন্ডি ২ নম্বরে অবস্থিত পপুলার কনসাল্টেশন সেন্টারে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে দেখানোর সুযোগ পান। এখানকার চিকিৎসক প্রথমে রেফার্ড করেন ল্যাবএইডে, ল্যাবএইডের চিকিৎসক রেফার্ড করেন বিএসএমএমইউ (সাবেক পিজি) তে। আজ সকাল ৮ থেকে পিজি হাসপাতালের চিকিৎসকরা পরস্পর তিনজনকে রেফার্ড করেন।
সর্বশেষজন বলেন, আগামীকাল সকাল নয়টার মধ্যে “অমুক” ডাক্তারকে দেখাবেন! এদিকে চিকিৎসকদের রেফার্ডের যাঁতাকলে পড়ে শিশু নূর মোমিনের শারীরিক অবস্থা আরও খারাপের দিকে।
উপায়ন্তর না পেয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে কর্মরত এক স্নেহভাজনকে স্মরণ করি। তার তৎপরতায় অতি দ্রুত রোগীকে পাঠাই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সেখানকার চিকিৎসক বলেন, এ রোগীর সুচিকিৎসা এখানে নয়, পিজিতেই সম্ভব। এবার বোঝেন ঠ্যালা কারে কয়।
ক্লান্ত শ্রান্ত নূর মোমিনের পিতা-মাতার একেবারে নাস্তানাবুদ অবস্থা। বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা প্রায়। এতো কষ্টের পরে রাতে কোথায় মাথাগোঁজার ঠাঁই হবে জানেনা তার পিতা-মাতা।
জানি না আগামী দিনের ভোগান্তির কথা চিন্তায় এলে নূর মোমিনের পিতা-মাতার ঘুম হবে কিনা। পরিশেষে বলি এদেশের ডাক্তার, হাসপাতাল কি নূর মোমিনদের জন্য, নাকি অন্যগ্রহে বসবাসকারী কোন প্রাণীদের জন্য?
শাহজাহান সমাজ সেবা করে, সমাজসেবা তার পেশা না। সে পেশায় একজন ব্যাংকার। নিজের টাকা এবং নিজের সময় খরচ করে মানুষের জন্য কিছু করার চেষ্টা করে। বিনিময়ে হয়ত একটু তৃপ্তি পায়, ভালো লাগে কারো মুখে হাসি দেখলে।
নূরের বয়স ১৮ মাস, তার জন্ম হয়েছে দরিদ্র পরিবারে এটা তার দোষ নয়। জন্মের শুরুটা এমন মর্মান্তিক এটাও তার দোষ নয়। নূরের বাবা-মা চেষ্টা করছে নূরের ভাগ্যের পরিবর্তন করতে। এখন দরকার একটু সাহায্য এবং সহানুভূতির।
আমার বিশ্বাস যদি নূর বেঁচে যায় এবং সে যদি জীবনে বড় হতে পারে তবে তার গল্প যারা শুনবে তারা বিশ্বাস করবে যে ভাগ্যের পরিবর্তন করা সম্ভব। আজ তিনদিন হলো নূর ঢাকায়। তাকে এ পর্যন্ত পাঁচজন খ্যাতনামা ডাক্তার দেখেছে তবে কোন সিদ্ধান্তে আসেনি।
আজ কিডনি হাসপাতালের পরিচালক নিজে তাকে দেখেছেন এবং ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে রেফার্ড করেছেন। আজ স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতম কর্মকর্তা শাহজাহানের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করেছেন এবং কাল সকালে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতাল তাকে ভর্তির ব্যবস্থা করা হবে যা নূরের শেষ আশা।
একজন মুমুর্ষ রুগীকে তিন দিন ধরে শুধু রেফার্ড টু রেফার্ড করা হলো, কেউ অ্যাকশনে গেলো না। এসব ঘটনা কি জাতির জানার প্রয়োজন নাই? আমার চোখে নূরই বাংলাদেশ এবং তার জীবনের অনিশ্চয়তাই ১৭ কোটি মানুষের জীবনের ঝুঁকি!
কি হবে নূরের এখন এবং কীভাবে সে সাহায্য পাবে সেটাই এখন প্রশ্ন? যাই হোক না কেন একটি জিনিষ হৃদয়ে গেঁথে গেলো তা হলো পৃথিবী বদলে গেছে, মানবতা মরেনি। যেসব মানুষগুলো নূরের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে তাঁরা সত্যি মানুষ। মানুষের মাঝে আমরা যেন বেঁচে থাকতে পারি এমনটি আশা এবং প্রত্যাশা।
রহমান মৃধা, দূরপরবাস সুইডেন, rahman.mridha@gmail.com
