|
ফলো করুন |
|
|---|---|
আমাদের জীবনে ২০২০ সাল না এলে কী এমন ক্ষতি হত? এই কথার উত্তর দেওয়া কিছুটা কঠিন, তবে আমি নিশ্চিত সুযোগ থাকলে পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষ বছরটি ভুলে যেতে চাইবে। শুধু এক ভয়ানক মহামারীর কারণে পৃথিবীর স্বাভাবিক সমস্ত কিছু স্তব্ধ হয়ে ছিল।
সামান্য এক ভাইরাস, যা চোখে পর্যন্ত দেখা যায় না, এত ছোট, আমাদের জীবনের সবকিছু এলোমেলো করে দিয়েছে। অন্তত ২০২০ সালে এটিই পৃথিবীর ভয়ংকরতম ঘটনা। কোনো কোনো দেশের জন্য তো এটা তাদের ইতিহাসেরই সবচেয়ে বেদনাদায়ক বছর হিসেবে বিবেচিত হবে।
গত শতাব্দীতে প্রায় একশ বছর আগে স্প্যানিশ ফ্লুর পর এটাই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় মহামারী। ১৯১৮ সালে শুরু হওয়া স্প্যানিশ ফ্লু শেষ হয় ১৯২০ সালের দিকে। দুই বছরেরও বেশি সময় এটি বিশ্বব্যাপী এক বিভীষিকা হয়ে বিরাজ করে। তখন ওই মহামারীতে মারা যায় প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ।
করোনাভাইরাস সম্পর্কে আশার কথা হলো সবচেয়ে কম সময়ে এই রোগের টিকা আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে। এখনও পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা অনেকগুলো টিকাকে সফল বলে মনে করছেন। যদিও সাধারণ মানুষ এবং বিশ্বের সব প্রান্তের মানুষের কাছে টিকা পৌঁছানোটাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
স্বাভাবিকভাবেই প্রথম বিশ্বের দেশ অর্থাৎ ধনী দেশগুলো টিকা প্রাপ্তিতে এগিয়ে আছে। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানির মত দেশগুলোতে টিকা দেওয়া শুরু হয়ে গেছে। মহামারী শুরু হওয়ার প্রাক্কালে একটা সাধারণ হিসেব ছিল আঠার মাসের আগে টিকা পাওয়া সম্ভব না। কিন্তু অবিশ্বাস্য দ্রুততায় সারা বিশ্বের বিজ্ঞানীরা বছর খানেকের মধ্যেই এই রোগের অনেকগুলো টিকা আবিষ্কার করে ফেলেছেন।
বলা যায় এ বছর শুরু হওয়া মহামারীটার টিকাও আমরা এই বছরই আবিষ্কার করতে পেরেছি।
মহামারীতে আমাদের দেশের জন্য শুধু নয় বিশ্বের জন্যই অপূরণীয় ক্ষত তৈরি করে গেল। পৃথিবীর বিখ্যাত অনেক মানুষকে আমরা হারিয়েছি করোনাভাইরাসে।
চিকিৎসকেরা যেহেতু করোনার ফ্রন্ট লাইনের যোদ্ধা ছিলেন, প্রথম তিন মাসের মধ্যে আমরা প্রায় ৪০ জন চিকিৎসককে হারিয়েছি। চিকিৎসকদের জন্য যথাযথ সুরক্ষা সামগ্রীর ব্যবস্থা করতে আমাদের বেশ দেরি হয়েছে। তবে স্বাস্থ্য বিভাগের বেহাল দশা এই সময়ে অনেকটাই বেরিয়ে এসেছে।
ভুয়া করোনা টেস্টে এবং সার্টিফিকেট দেওয়ার দায়ে ধরা পড়েছে বেশ কিছু লোকজন। বাংলাদেশের বিশিষ্ট অনেক মানুষকে হারিয়েছি আমরা করোনায়। মারা গেছেন প্রফেসর আনিসুজ্জামান, শিল্পপতি নুরুল ইসলাম, শিল্পপতি লতিফুর রহমান, টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব মোহাম্মদ বরকতউল্লাহ, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীসহ আরও অনেকে। তাদের শূন্যস্থান পূরণ হবার নয়।
করোনায় আমরা দুই ধরনের মানুষই দেখেছি আমাদের দেশে। একদল এই রোগের সুযোগ নিয়ে অসৎ উপায়ে অর্থ উপার্জনে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। অন্য দল মানুষের সেবায় নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিতে পিছপা হয়নি।
করোনার প্রথম দিকে মৃতের সৎকার করার মত লোক পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন আমরা সাধারণ মানুষকে এই কাজে এগিয়ে আসতে দেখেছি, পুলিশ বাহিনীর কিছু সদস্যও মানবিক এই কাজে এগিয়ে এসেছিলেন। ডাক্তারদের পাশাপাশি বেশ কিছু পুলিশ সদস্যকে হারিয়েছে আমরা।
পুলিশও মাঠে ছিল করোনার পুরোটা সময়। লকডাউন কার্যকর করতে এবং আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে তারা নিরলস কাজ করে গেছেন। আমাদের পুলিশ বিভিন্ন সময়ে সমালোচিত হয়, কিন্তু মহামারীতে তাদের সার্বিক ভূমিকা ছিল খুব প্রশংসাযোগ্য।
করোনায় মানুষ দীর্ঘ সময় লকডাউনে ছিল। এখনও অনেক দেশে দ্বিতীয়বারের মত লকডাউন শুরু হয়েছে। তাই এর কিছু নেতিবাচক প্রভাব দেখা গেছে। পারিবারিক সহিংসতা বেড়েছে, বিচ্ছেদ বেড়েছে, শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের হয়েছে ক্ষতি।
পাশাপাশি করোনার কিছু ভালো দিকও লক্ষ্য করা গেছে। এই রোগটি মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেতে শিখিয়েছে, বিভিন্ন শিষ্টাচার শিখিয়েছে, সামাজিক দূরত্বের ধরনা দিয়েছে। যোগাযোগপ্রযু্ক্তির মাধ্যমে মানুষ সেরে নিতে পেরেছে অনেক দরকারি প্রয়োজন।
এই সময়ে অনলাইন ব্যবসা বেড়েছে অনেকগুণ বেশি। ওষুধ কোম্পানির মুনাফা বেড়েছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ। ঘরে বসেই বাইরের সাথে সমস্ত যোগাযোগ সারতে পেরেছে মানুষ। এতদিন এসব প্রযুক্তি থাকলেও মানুষ তা ব্যবহার করেনি।
করোনায় অনেক মানুষ আয় হারিয়েছে এটা যেমন সত্যি, তেমনি অনেক মানুষের খরচ কমেছে।
ই-কমার্সে খাতটি করোনার বছরে বেশ জমে উঠেছে। ঘরে বসে অফিস করেছে মানুষ। নিত্যদিনের ভিড় ঠেলে রাস্তায় বসে থাকতে হয়নি ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
করোনার আরেকটি উল্লেখযোগ্য উপকার হলো দূষণ কমেছে। মানুষ যেহেতু ঘর থেকে কম বেরিয়েছে, তাই বায়ু দূষণ, পানি দূষণ কমেছে। প্রকৃতিও নতুন করে সেজেছে। বায়ুমণ্ডলে সীসা ও ধুলোর আস্তরণ কমেছে। সব মিলিয়ে গত বছরটি এই শতাব্দীর ইতিহাসেই একটা উল্লেখযোগ্য বছর হয়ে থাকবে।
নতুন বছরে আমরা চাই পৃথিবী থেকে এই মহামারী দূর হোক। মানুষ আবার নিউ-নরমাল থেকে আগের মতো স্বাভাবিক 'নরমাল' অবস্থায় ফিরে যাক। প্রকৃতিকে দূষিত না করে মানুষ অনেক বেশি প্রকৃতিবান্ধব হোক। মানুষ আরও বেশি মানবিক হোক, উদার হোক, বন্ধু-সুলভ হোক। পুরনো বছরের গ্লানি ঝেড়ে ফেলে নতুন একটা বছর হোক ২০২১, যে বছরে মহামারির বিভীষিকা তাড়া করবে না মানুষকে। সবাইকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা।
রাহিতুল ইসলাম, লেখক ও সাংবাদিক
