|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার ভাষায় ‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর’। কবিতাটি যেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহধর্মিণী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে উদ্দেশ্য করেই লেখা। এ কথা সত্য যে, প্রত্যেক সার্থক পুরুষের নেপথ্যে থাকেন একজন নারী। কথায় বলে ‘প্রত্যেক সফল পুরুষের সফলতার পেছনে একজন নারীর হাত রয়েছে’। আর এই ধারণাকে আরও একধাপ ওপরে নিয়েছে একটি গবেষণা। যেখানে দেখা গেছে শুধু নারীর হাত নয়- সফল হওয়ার পেছনে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সহযোগিতামূলক মনোভাব। যুক্তরাষ্ট্রের পেনসালভেনিয়ার দ্য কার্নেইগিমেলন ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানীদের দাবির ওপর ভিত্তি করে এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে সম্পর্কবিষয়ক একটি ওয়েবসাইট।
সঙ্গী সহযোগী হলে মানুষ ঝুঁকি নেওয়ার সাহস পায়। আর ঝুঁকি নেওয়ার সৎ সাহসই মানুষের জীবনে বয়ে আনে সফলতা, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, মানসিক শান্তি এবং সুসম্পর্ক। যেমন- জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সফলতার পেছনে যার অবদান সবচেয়ে বেশি তিনি হলেন মহীয়সী নারী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ওরফে রেনু। শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সংগ্রামী সেই মহীয়সী নারী, যিনি নিজেকে নেপথ্যে রেখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তার অভীষ্টের দিকে এগিয়ে যেতে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করেছেন।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার নরনারী প্রবন্ধে লিখেছেন- ‘গৃহগঠন এবং গৃহবিচ্ছেদ স্ত্রীলোকেই করিয়া থাকে। আমাদের দেশে ভালোমন্দ সমস্ত শক্তি স্ত্রীলোকের হাতে; আমাদের রমণীরা সেই শক্তি চিরকাল চালনা করিয়া আসিয়াছে। আমাদের দেশীয় গৃহিণী, লোকলৌকিকতা-আত্মীয়কুটুম্বিতা পরিপূর্ণ বৃহৎ সংসার এবং স্বামী-নামক একটি চলৎশক্তিরহিত অনাবশ্যক বোঝা পশ্চাতে টানিয়া লইয়া আসিয়াছে। সে যখনই ভালোবাসিতে আরম্ভ করে তখনই তাহার কর্তব্য আরম্ভ হয়। তখনই তাহার চিন্তা, বিবেচনা, যুক্তি, কার্য, তাহার সমস্ত চিত্তবৃত্তি সজাগ হইয়া উঠে, তাহার সমস্ত চরিত্র উদ্ভিন্ন হইয়া উঠিতে থাকে। বাইরের কোনো রাষ্ট্রবিপ্লব তাহার কার্যের ব্যাঘাত করে না, তাহার গৌরবের হ্রাস করে না, জাতীয় অধীনতার মধ্যেও তাহার তেজ রক্ষিত হয়।’
কবিগুরুর এ কথাগুলোর মতোই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবনে তার সহধর্মিণী শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের ভূমিকা ও অবদান অনস্বীকার্য। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বারবার তুলে এনেছেন তার সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বা রেনু প্রসঙ্গ। মহীয়সী এই নারীর আত্মত্যাগ শুধু ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুর প্রতি নয়, দেশের প্রতিও। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন- ‘আমার সহধর্মিণী একদিন জেলগেটে বসে বলল, ‘বসেই তো আছ, লেখো তোমার জীবনের কাহিনী।’
হঠাৎ মনে হলো লিখতে ভালো না পারলেও ঘটনা যতদূর মনে আছে লিখে রাখতে আপত্তি কী? সময় তো কিছু কাটবে। আমার স্ত্রী, যার ডাক নাম রেনু- আমাকে কয়েকটা খাতাও কিনে জেলগেটে জমা দিয়ে গিয়েছিল। জেল কর্তৃপক্ষ যথারীতি পরীক্ষা করে খাতা কয়টা আমাকে দিয়েছে। রেনু আরও একদিন জেলগেটে বসে আমাকে অনুরোধ করেছিল। তাই আজ লিখতে শুরু করলাম।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আরও লিখছেন, ‘আমার জীবনে আমি দেখেছি, গুলির সামনে আমি এগিয়ে গেলেও কোনোদিন আমার স্ত্রী বাধা দেয় নাই। এমনও দেখেছি যে, অনেকবার আমার জীবনের ১০-১১ বছর আমি জেল খেটেছি। জীবনে কোনোদিন মুখ কালা কিংবা আমার ওপর প্রতিবাদ করে নাই। তাহলে বোধ হয় জীবনে অনেক বাধা আমার আসত। এমন সময় আমি দেখেছি যে আমি যখন জেলে চলে গেছি, আমি একআনা পয়সাও দিয়ে যেতে পারি নাই আমার ছেলেমেয়ের কাছে। আমার সংগ্রামে তার দান যথেষ্ট রয়েছে।’
মহীয়সী নারী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা একজন অনুকরণীয় দৃষ্টান্তের মানুষ। তিনি তার সচেতন বোধ এবং নিজস্ব চিন্তাচেতনায় তার সময়কে যেভাবে উপলব্ধি করেছিলেন, তা ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে ভিন্নমাত্রা লাভ করে নিঃসন্দেহে।
বেগম ফজিলাতুন্নেছা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘রেনু আমার পাশে না থাকলে এবং আমার সব দুঃখকষ্ট, অভাব-অনটন, বারবার কারাবরণ, ছেলেমেয়ে নিয়ে অনিশ্চিত জীবনযাপন হাসিমুখে মেনে নিতে না পারলে আমি আজ বঙ্গবন্ধু হতে পারতাম না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামেও যুক্ত থাকতে পারতাম না। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময় সে আদালতে হাজিরা দিয়েছে এবং শুধু আমাকে নয়, মামলায় অভিযুক্ত সবাইকে সাহস ও প্রেরণা জুগিয়েছে। আমি জেলে থাকলে নেপথ্যে থেকে আওয়ামী লীগের হালও ধরেছে।
বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা বা রেনুর সংসারই চলেছে ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে। মূলত শৈশবেই রেনু বঙ্গবন্ধুর জীবন চলার সঙ্গী হয়ে এলেও কৈশোর বা তারুণ্যের প্রণয়পাশা দিয়ে তার জীবন গড়ে ওঠেনি। বরং রাজনীতিবিদ স্বামী, যিনি কখনও থেকেছেন ঢাকায়, কলকাতায় কিংবা কারাগারে, সেই স্বামীর সংগ্রামী জীবনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে নিয়েছেন নিজের সংসারের চাকা। কেমন করে পারলেন রেনু- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মতো একজন বহির্মুখী, বহুবার কারাবরণকারী রাজনীতিবিদের সংসারকে সামলে নিতে?’ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে একজন অসাধারণ প্রজ্ঞার মানুষ হিসিবে তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে একজন সাহসী নারী। দুর্বার সাহসে ইতিহাসের ক্রান্তিলগ্নে দিয়েছিলেন দূরদর্শী চিন্তার বার্তা। সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ ফেলার সাহসী বার্তা তাকে ইতিহাসের মানুষ করেছে। নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, জেন্ডার সমতার ইতিহাসে তিনি আমাদের অনুকরণীয় দৃষ্টান্তের মানুষ।’
বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ ছয় দফা ঘোষণার পর বঙ্গবন্ধু যখন বারবার পাকিস্তানি শাসকদের হাতে বন্দি ছিলেন, তখন দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা বঙ্গমাতার কাছে ছুটে আসতেন। তিনি তাদের বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন দিক-নির্দেশনা বুঝিয়ে দিতেন এবং লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য অনুপ্রেরণা জোগাতেন। বিশেষ করে আগরতলা যড়যন্ত্র মামলায় প্যারোলে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি নিয়ে একটি কুচক্রীমহল বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামকে বিপন্ন করার ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছিল, তখন প্যারোলে মুক্তির বিপক্ষে বেগম মুজিবের দৃঢ়চেতা অবস্থান বাঙালির মুক্তি সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করেছিল। মহান মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি ভেঙে না পড়ে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন দৃঢ়তার সঙ্গে। যুদ্ধ পরবর্তীকালে দেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকে কাজ করেছেন, গরিব-এতিম-অসহায় মানুষদের সাহায্য করেছেন, বীরাঙ্গনাদের বিয়ের ব্যবস্থা করে তাদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার মতো মহৎ দায়িত্ব পালন করেছেন।
এ দেশের মানুষের আন্দোলন-সংগ্রামে বেগম মুজিব যে কর্তব্যনিষ্ঠা, দেশপ্রেম, দূরদর্শী চিন্তা, বুদ্ধিমত্তা ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন তার ফলে জাতির পিতার পাশাপাশি তিনি আজ বঙ্গমাতার আসনে অধিষ্ঠিত। শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব এভাবেই বেঁচে থাকবেন ইতিহাসের সাহসী নারী হয়ে। আজ এই মহীয়সী নারীর জন্মদিনে প্রণতি জানাই তাকে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
