Logo
Logo
×

দৃষ্টিপাত

নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে বাচ্চাদের কাছ থেকে কী শিখলাম?

Icon

ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াস

প্রকাশ: ০২ আগস্ট ২০১৮, ০৬:৩০ পিএম

নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে বাচ্চাদের কাছ থেকে কী শিখলাম?

নিরাপদ সড়কের দাবিতে বৃষ্টিভেজা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। ছবি: যুগান্তর

সরকারে যেই আসুক, সরকারি দলের দুঃসহ লুটপাট, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, টেন্ডারবাজি, মানবাধিকার লঙ্ঘন আর বিরোধী দলের আন্দোলনে দেশের সম্পদ ধ্বংস লুটপাট হবেই।  এছাড়া অর্থনীতির বিপর্যয়, সমাজের জ্ঞানী-গুণী মানুষের ওপর অর্ধশিক্ষিত/অশিক্ষিতদের খবরদারি, মানবিক অনুভূতির ন্যাক্কারজনক অবমাননা, মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন - এগুলি হয়তো এই দেশের জন্যে প্রয়োজন।

অত্যাচার, দুরাচার, মিথ্যাচার, লুটপাটের মহোৎসব দেখে মানুষ সুশাসনের মূল্য বুঝবে, রাষ্ট্রের উপন নিজের ওনারশীপ এসর্ট করার মূল্য বুঝবে যেমনটা এখন কিছুটা বুঝতে শুরু করছে। হয়তো, তখন একদিন এই দেশের সাধারণ মানুষ নিজের রেস্পন্সিবিলিটি নিজের হাতে নিবে, নিজের অধিকারের জন্যে রাস্তায় নামবে।

দারি তুলবে একটা ভাল সরকারের, সুশাসনের, দুর্নীতি মুক্ত কোর্টের, দুর্নীতি মুক্ত টেন্ডারের, সাইনবোর্ড মুক্ত রাস্তার, ফিটনেস এবং লাইসেন্স সংবলিত গাড়ির, দালালবিহীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থার, ভাল ইনফ্রাস্ট্রাকচারের, সৎ এবং দক্ষ শাসকের, যোগ্যতাভিত্তিক মূল্যায়নের। তখন বিরোধী দল, সরকারী দল, প্রশাসন, বিচারবিভাগ, পরিবহন ব্যবস্থা সবই নৈতিক এবং দক্ষ হতে বাধ্য হবে। এগুলো এখনো হয়নি, এতদিনে হয়নি কারন, মানুষ এগুলো চায়নি, চাওয়ার মত করে চায় নি। যেদিন মানুষ এগুলো চাওয়ার মত চাইবে, সেদিন এই দাবীগুলো পূর্ণ হবে। সেই পরিবর্তনের দায় আগে আমাদের, জনগণের - রাজনীতিবিদদের না।

পৃথিবীর সভ্য এবং উন্নত রাষ্ট্রগুলোর ইতিহাস দেখুন। প্রায় প্রতিটি দেশেরই ইতিহাসের কোনো না কোনো পর্যায়ে ভয়ংকর ধরণের লুটপাটতন্ত্র, অস্থিতিশীলতা এবং দুর্নীতি ছিল। আর সেই লুটপাটের বেনিফিশিয়ারিরা প্রো একটিভলি এমনি এমনিই ভাল হয়ে গিয়েছিল – এটা ইতিহাসে কখনোই ঘটেনি।

লুটপাটতন্ত্র এবং দুঃশাসনে অতিষ্ঠ হবার এক পর্যায়ে সাধারণ জনগণই লড়াই করে তার অধিকার আদায় করে রাজনীতিবিদদেরকে তাদের পক্ষে পলিসি বানানোর জন্য বাধ্য করেছে। অর্থাৎ জনগণ রাষ্ট্রের উপর তাদের ওনারশীপ এসর্ট করেছে।

আমাদের রাষ্ট্রের বয়স অনেক কম, মাত্র ৪৭ বছর, তাই এখনো আমাদের রাষ্ট্র এখনো সেই পর্যায়ে যায়নি।

কিন্তু রাষ্ট্র ব্যবস্থার স্বাভাবিক বিবর্তনে এক সময় সেই পর্যায়ে যাবেই।

জনগণের প্রশ্ন - জীবনবাজি রেখে বিরোধী দল অন্যায় অনাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে পারে না ক্যান?

এই তো কিছুদিন আগেও সাধারণ মানুষ মনে করত সুশাসন প্রতিষ্ঠা আর অন্যায়ের প্রতিবাদ করার দায় সব রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের, বিশেষ করে বিরোধীদলের, আমাদের সাধারণ মানুষের তাতে কোন কাজ নাই।

আচ্ছা জানবাজি রেখেই যদি সুশাসন প্রতিষ্ঠা আর অন্যায়ের প্রতিবাদ করা বা সরকার বদল করতে হয় রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের, তাহলে যার যার সরকার ক্ষমতায় আসলে তারা লুটপাট আর চাঁদাবাজি করলে সেটাতে আপত্তি থাকার কথা না।

একটা ছেলে রাজনীতি করে, তাই সে জান বন্ধক রেখে রাস্তায় মিছিল করবে, আর আমি সাধারণ মানুষ এই ধুয়া তুলে কোন অন্যায়ের প্রতিবাদ করব না, সুশাসনের দারি তুলব না, অর্থাৎ কারো জান গেলে আমার ক্ষতি নাই, আমার ভাগের রুটি যেন কম না পড়ে .এই হিপোক্রেসি দ্বারা সুশাসন প্রতিষ্ঠা হয় না কিংবা লুটপাটতন্ত্র থেকে মুক্তি আশা করা যায় না।

লুটপাটতন্ত্র থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় সাধারণ জনগণের রাষ্ট্রের ওপর তাদের ওনারশীপ এসার্ট করা।

সুশাসন প্রতিষ্ঠার এই কাজটা তো আমার আপনার সবার।

সাধারণ মানুষ রাষ্ট্র এবং রাজনীতিতে তাদের ঔনারশীপ এসার্ট করে না দেখেই তো রাজনীতিবিদরা লুটপাটের সুযোগ পায়।

জনগণের দর্শক হয়ে থাকাটাই লুটপাটতন্ত্রের সবচেয়ে বড় ইন্ধন।

প্রগতিশীলতা দেখাতে গিয়ে আমরা প্রায়ই বলি, "উই হেইট পলিটিক্স"। কিন্তু এই "আই হেইট পলিটিক্স" ফিলসফি ভয়ংকর সুবিধাবাদী ফিলসফি এবং এই ফিলসফিধারীরা এমন একটি শ্রেণি যারা পলিটিশিয়ানদের চেয়েও জঘণ্য।

এরা পলিটিক্সকে হেইট করে, আবার নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য রাজনৈতিক নেতাদের পা চাটতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না। চাকরি লাভ, প্রমোশন, বদলি প্রত্যেক ক্ষেত্রেই এরা রাজনৈতিক নেতাদের পা চাটে, প্রশাসন, পুলিশ, এনএসআই, আইন আদালত এই সবের ফোর্থ ক্লাসের কর্মচারীদের তেলাতে বা ঘুষ দিতে ও এদের আপত্তি নেই।

এই  ‘আই হেট পলিটিক্স’ প্রজন্মের স্ট্যাটাস, আওয়ামীলীগ-বিএনপি-জাপা-বাসদ-জাসদ, জামায়াত সবাই খারাপ, সবাই সন্ত্রাসী কর্মকান্ড করছে, সবাই জনগণের জীবনকে অতিষ্ঠ করে দিচ্ছে। তাই এরা সবাই বাংলাদেশ থেকে নির্বাসিত হয়ে গেলেই দেশের মানুষগুলো বাঁচে।

আচ্ছা দেশ পরিচালনা করে কারা? তুমি আমি বা কোন কচুটা করেছি দেশের জন্যে নিজের উদরপূর্তি ছাড়া এ পর্যন্ত! বিষয়টা অনেকটা এই রকম, যে ভেড়ার পালের রাখাল দুষ্ট-চোর-সন্ত্রাসী। তাই কিছু ভেড়া এবার বলছে ওহে রাখাল সরে দাড়াও। ভেড়াদের ("আই হেট পলিটিক্স" প্রজন্মের) মনে হয় বুদ্ধিতেও নেই যে, তাদের আচরণ ভেড়ার সাথেই যায় ভালো, রাখালের কাজ তাদের দিয়ে হবে না। রাখাল খারাপ হলে তাকে ভালো করতে হবে, ভাল রাখাল খুজতে হবে, এই বোধবুদ্ধি তাদের হাটুর উপরে আছে বলে মনে হয় না।

সত্যিকার অর্থে সাধারণ জনগণের নন পলিটিক্যাল শক্তিশালী নাগরিক প্লাটফর্মই শুধু পারে দুই দলকে সুশাসনে বাধ্য করতে। এই দায়িত্ব যতোদিন তারা অগ্রাহ্য করবে ততোদিন লালুভুলুদের অত্যাচার থেকে তাদের নিস্তার নাই।

নাগরিকদের দল মত নির্বিশেষে এই ঐক্যকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ডীপ স্টেট বলে। ভ্যাট প্রত্যাহার আন্দোলন, কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং চলমান নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন এই ডীপ স্টেটের ই অংশ।

এসব আন্দোলনকে পলিটিক্যাল ট্যাগিং করে সাময়িক ভাবে থামিয়ে দেওয়া যাবে সত্য, কিন্তু ইতিহাস বলে রাষ্ট্রব্যবস্থার বিবর্তনের স্বাভাবিক পরক্রমায় একসময় বঞ্চিত নাগরিকদের ডীপ স্টেট অতি স্বাভাবিক ঘটনা। এই ডীপ স্টেট তৈরিতে তারাই মাঠে নেমেছে যারা কিনা বয়সে সবচেয়ে ছোট।

ডীপ স্টেটের আন্দোলন আসলে সরকার বা বিরোধীদল কারোরই পক্ষে বা বিপক্ষে নয়। এই আন্দোলন সাধারণ জনগণের পক্ষের আন্দোলন। কাজেই এই ধরণের মাস আন্দোলনকে সরকার বিরোধী আন্দোলন মনে করা কিংবা এই ধরণের আন্দোলন দিয়ে সরকার পতনের স্বপ্ন দেখা বা আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চিন্তা করা দুটাই রাজনীতিবিদদের মানসিক দেওলিয়াত্ব।

জনগণ কী চায়?

একটা দক্ষ সরকার, সুশাসন, দুর্নীতি মুক্ত কোর্ট, দুর্নীতি মুক্ত টেন্ডার, সাইনবোর্ড মুক্ত রাস্তা, ফিটনেস এবং লাইসেন্স সংবলিত গাড়ি, ভাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার, সৎ এবং দক্ষ প্রশাসক এবং যোগ্যতাভিত্তিক মূল্যায়ন।

সরকারে যেই থাকুন, নাগরিকদের এই দাবিগুলো পূরণ করুন, নইলে রাষ্ট্রব্যবস্থার স্বাভাবিক বিবর্তনে ডীপ স্টেট থেকে এক সময় না এক সময় এই দাবী আসবেই। সেই দাবী সাময়িকভাবে স্তব্ধ করে দেওয়া যাবে, চিরতরে নয়।

রাষ্ট্রব্যবস্থার স্বাভাবিক বিবর্তনে ডীপ স্টেট বাংলাদেশেও কার্যকর হবে, এটা বিশ্বাস করতাম, এখন বাস্তবে দেখতেছি।

আর সেই ডীপ স্টেট প্রতিষ্ঠা করতেছে এক চোখা বুদ্ধিজীবী বা জ্ঞানীগুণী প্রবীণরা নয়, তথাকথিত ডিজুস প্রজন্মের ইয়াহু বাচ্চারা।

সুতরাং এই দেশের বর্তমান যাইহোক, ভবিষ্যৎ নিয়ে আর কোন সংশয় নেই।

লেখক: ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াস, রেসিডেন্ট (নিউরোলজি), বিএসএমএমইউ।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম