Logo
Logo
×

দৃষ্টিপাত

জন্ম ও দুঃখের হেতুবাদ    

Icon

ড. মো. রুহুল আমিন সরকার

প্রকাশ: ০৩ জুলাই ২০২৪, ০৫:০২ পিএম

জন্ম ও দুঃখের হেতুবাদ    

আমরা শিশু হয়ে জন্মাই। আমাদের হাসিতে সবাই হেসে দেয়; আমাদের কান্নায় সবাই কাঁদে— একমাত্র পশু ও সীমার এর ব্যতিক্রম! অনেক পশু আছে নিষ্পাপ শিশুদের সঙ্গে খেলা করে। অনেক সময় দেখা যায়, বিড়াল বাচ্চা, কুকুরছানা অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে ছোট ছোট বাচ্চাদের সঙ্গে খেলাধুলা করছে। সময় যত গড়িয়ে যায়, আমরা জগতের বাস্তবতার সঙ্গে তত বেশি পরিচিত হতে থাকি। শৈশব পেরিয়ে কিশোর বয়স, যৌবনকাল এবং জীবনের শেষ পড়ন্ত বিকাল দেখে—একদিন সব শেষ হয়। জীবনের নদী কোথাও ভাঙে; কোথাও গড়ে চর; অনেক অচেনা মুখ বন্ধু হয়; অনেক আপন মানুষ হয় পর। যে মুখ একদিন না দেখলে পৃথিবীর সব কিছু অসাড়, শূন্য ও ধু ধু মরুভূমি মনে হয়; সে মুখ একসময় দেখতে ইচ্ছা করে না। মনে হয়, এই জনমে যেন সেই মুখ আমার সামনে না আসে! জীবন ও সময়ের কি অদ্ভুত বিবর্তন! আবার এই সময়ই মানুষের সব কেড়ে নেয়। রাগ, অহঙ্কার, অভিমান, শৌর্য-বীর্য ও ক্ষমতা- একসময় কোনো কিছুই আর প্রয়োজনীয় মনে হয় না। জীবন বিকাশের নানা পর্যায়ে, যে সকল প্রাপ্তি না হলে, জীবনকে অপূর্ণ মনে হয়, সেসব প্রাপ্তির দিকে পেছন ফিরে তাকালে মনে হয়— কি হতো এসব না হলে? সময়ের স্রোতধারায় প্রাপ্তির নিমিত্ত, কী অর্থহীন পাগলামিই না আমরা করি! সময় শেষ হয়! আমরা পেছনে ফিরে তাকাই! খুব সহজেই বুঝতে পারি: অনেক কিছুই জীবনের প্রয়োজনীয় ছিল না! কিন্তু আমরা সেসবের জন্যই রাত-দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর পাগলা ঘোড়ার মত ছুটে চলেছিলাম। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা জেনে যাই যে, পৃথিবীর সবাই নেলসন মেন্ডেলা, মহাত্মা গান্ধী বা আব্রাহাম লিংকন হয়ে জন্মায় না; চাইলেই সে সবকিছু নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে বা নিজের ইচ্ছামতো করতে পারে না। সংসার, পরিবার, পড়াশোনা,  জীবিকা,  কর্মক্ষেত্র, সমাজ, এমনকি রাষ্ট্র— সবকিছুই যার যার নিয়মে চলে। উপলব্ধির ডান দিক পরিস্থিতি চলতে থাকে—
“nothing is meaningless; or, everything is meaningless!

দিন চলে যায় সময়ের আপন গতিতে; আমরা ঠিকই বুঝে যাই—পাহাড় ঠেলে সরানোর চেষ্টাকে ‘কাজ’ বলে না। নিছক ‘নিরর্থক চেষ্টা’ বলা যেতে পারে। আমরা অনেক কিছু পেতে চেষ্টা করি। অনেক কিছু পেতে চাই! সব প্রাপ্তি-প্রচেষ্টা'র বেশিরভাগই না বুঝেই চেষ্টা করি। কেন সেটা আমার দরকার? কেন আমি এর জন্য উদগ্রীব? এসব প্রশ্নের অনেকটাই না বুঝে করে থাকি। শুধু জাগতিক ও স্বল্পস্থায়ী আনন্দ ও কৃত্রিম সমাজের মধ্যে নিজের অবস্থান, সবার সামনে উপস্থাপনার চরম ও পরম বাসনা থেকেই আমাদের এই সতত ও শত ব্যাকুলতা! স্বল্প স্থায়ী জীবনের খুব সংক্ষিপ্ত সময়ে, নিজেকে সর্বোচ্চ আসনে দেখার যে পরম জাগতিক ও বস্তুকেন্দ্রিক আনন্দ; তার মোহ আমাদের তীব্রভাবে গ্রাস করে! তাই তো ‘আমিই শ্রেষ্ঠ”’ এই ইগোর পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে একসময় ক্লান্ত হই।

জগতের সব বড় মানুষের জন্য দুঃখ অনিবার্য। এই বড় মানুষ বলতে আর্থিকভাবে ধনী বা কোনো উচ্চবিত্ত মানুষকে বোঝানো হয়নি। যারা প্রকৃত বড় মানুষ, তাদের সবার জীবনে বড় বড় দুঃখ ছিল। যীশু খ্রিস্ট ও হজরত মুহাম্মদ (স.) থেকে শুরু করে জগতের মহামানবগণের জীবনে অনেক বড় বড় দুঃখ ছিল। দুঃখের ইতিবৃত্ত মানবসভ্যতা সৃষ্টির ইতিহাসের মতোই প্রাচীন। যীশু খ্রিস্টের মতো মানুষকে ক্রুশ বিদ্ধ করে হত্যা করা হয়েছে। দুঃখ এ যুগের বড় মানুষের জীবনেও চরমভাবে দেখা যায়। ধরা যাক, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের কথা। বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় দার্শনিক এবং বিশ্বমানের সাহিত্যিক, নোবেল বিজয়ী রবীন্দ্রনাথের জীবনের দুঃখের কথা প্রায় সবারই জানা। স্ত্রীর মৃত্যুর পর কন্যাসন্তানদের একের পর এক মৃত্যু! নিকট আত্মীয়দের দ্বারা অপমানিত হওয়া! হিন্দু ধর্মের মানুষের দ্বারা চরমভাবে নিগৃত হওয়া— কবিগুরুর জীবনের মর্মান্তিক বাস্তবতা ছিল। অসুস্থ মেয়েকে দেখতে গিয়ে বারবার নিজ মেয়ের জামাতা কর্তৃক অপমানিত হয়ে বাড়িতে ফিরে এসেছেন! একদিন মেয়েকে দেখতে গিয়ে মাঝপথে শুনতে পান মেয়ে মারা গেছে। কবি আর তাদের বাড়িতে যাননি। লম্পট জামাতা বুঝেছিল, এই বুড়ো লোকটা আর যাই হোক পুলিশ-কেস করবে না। ফলে তাকে অপমান এবং লাঞ্ছনা-গঞ্জনা দেওয়ার সব আয়োজন জামাতা করত। কবিগুরুর সামনে বসে, পায়ের ওপর পা তুলে সিগারেট খেত। আর কবিকে অপমান করে নানান ধরনের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপমূলক বাক্য ব্যবহার করত।

ফিরে  আসা যাক, এ যুগের বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতিবিদ, ন্যায়বিচার ও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ৬০ বছর ধরে সারা পৃথিবীব্যাপী জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে চলছেন যিনি, অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেনের কথায়। বরেণ্য এই অধ্যাপক  হার্বাট, অক্সফোর্ড, ক্যামব্রিজ ও বোস্টনসহ বিশ্বের বড় বড় ২০০ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করে চলছেন প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে। এই অর্থনীতিবিদের ছোট্ট একটি পৈতৃক বাড়ি ছিল শান্তিনিকেতনে। তার নামে ভারতের আদালতে মামলা হয়। সরকার মামলাটি করে। এ মামলায় তাকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়। সেই উকিল নোটিশের জবাবে তিনি যা লিখেছিলেন, তা অত্যন্ত মর্মস্পর্শী, করুণ ও হৃদয়বিদারক! মামলার জবাব না দিয়ে বাড়ি দিয়ে চলে গেছেন! যাওয়ার সময় বলেছেন, তার পূর্বপুরুষদের থেকে শুরু করে, তার নিজের অনেক স্মৃতি এ বাড়িতে! খুব দুঃখ পেয়েছেন তিনি। ছয় শতক জায়গার একটি ছোট বাড়ি! কেঁড়ে না নিলে, মনে হয় না খুব ক্ষতি হতো! তারা সাধারণ মানুষ না! এই বাড়ির জন্য দিনের পর দিন আদালতের বারান্দায় দৌড়াবে! অথচ হার্বাট বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় তাকে বিরাট বড় বাড়ি দিয়ে রাখা হয়েছে। বিশ্বের বড় বড় একশ ইউনিভার্সিটিতে তিনি অবৈতনিকভাবে অধ্যাপক হিসেবে নিয়োজিত আছেন। সেসব বিশ্ববিদ্যালয় বিপুল পরিমাণ অর্থ দিতে চাইলেও, তিনি তাদের নিকট থেকে কোনো অর্থগ্রহণ করেন না। এ রকম একজন মানুষকেও চরম অবস্তুগত কষ্ট নিজ মাতৃভূমিতেই পেতে হলো। 

জগতের যে মানুষ যত বড়, তাকে তত বড় কষ্ট পেতে হবে— এটি সমান্তরাল ও সমীকরণের মতো সত্য। বস্তুগত প্রাপ্তির জন্য যে ধরনের সংগ্রামে লিপ্ত হতে হয়, অনেক মানুষ সেই সংগ্রামে লিপ্ত হতে পারে না। ফলে জগতের জাগতিক প্রাপ্তি তাদের কম হয়। সমাজের বাস্তবতায় তাঁরা খুব বেশি সম্মানিত এবং সমাদৃত হন না। অর্থ, পদমর্যাদা ও অন্য সকল সম্পত্তি সীমিত। অসংখ্য প্রতিযোগী সীমিত সম্পদ, অর্থ ও পদমর্যাদার জন্য নিয়ত সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বিশেষ ব্যতিক্রম ছাড়া সাদা মনের মানুষগুলো এখানে পিছিয়ে পড়বে- এটা খুবই স্বাভাবিক। তাঁরা প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে থাকেন। কিন্তু প্রকৃতি ন্যায়বিচার সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন। জগতের লাখ লাখ মানুষ অন্যায়ভাবে হত্যার শিকার হলেও প্রকৃতি তার কোনো প্রতিশোধ নেয় বলে মনে হয় না। প্যালেস্টাইনের শিশুদের  কথায়  ধরুন। বিশ্ব মোড়ল ও স্বার্থান্বেষী মহলের প্ররোচনায় আজ ৭০ বছর ধরে ফিলিস্তিনের শিশুদের নির্বিচারে মারা হচ্ছে। তার কি প্রতিবিধান প্রকৃতি করেছে? করেনি কোনো কিছু!

জাগতিক প্রাপ্তির মহাআনন্দ একদিন শেষ হয়। জীবন একসময় শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়ায়। মানুষ তখন বুঝতে পারে এসব কিছুর খুব বেশি প্রয়োজন ছিল না। মনে আছে না? স্টিভ জবসের মৃত্যুর বিছানায় শুয়ে লিখে যাওয়া অমর বাণীগুলোর কথা! অর্থ-বিত্তের জন্য তিনি ফুলের সৌন্দর্য, প্রজাপতির পাখার রঙ ও প্রিয় আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে সময় কাটানোর কথা ভুলে গিয়েছিলেন। জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে মৃত্যুর বিছানায় শুয়ে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন; এসব অর্থ তার জীবনে কোন কাজে আসেনি। গ্রিক বীর আলেকজান্ডার বিশ্ব জয় করে বুঝতে পেরেছিলেন, তিনি মানুষের হৃদয় জয় করতে পারেননি। তাইতো মৃত্যুর সময় তিনি বলে গিয়েছিলেন, তাঁর হাত দুটো যেন কাফনের বাইরে রাখা হয়; তার কফিন যেন চার জন ডাক্তার বহন করে। তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন, অর্ধ পৃথিবী জয় করেও শূন্য হাতে যেতে হয়! আর ডাক্তার ও কবিরাজ লাশ বহন করলেও, জীবন ফিরিয়ে দিতে পারে না!

১৩ বছর কারাবরণ করে, ফাঁসির মঞ্চে গিয়েও যিনি বাংলার স্বাধীনতার প্রশ্নে আপস করেননি; সেই মানুষকেও এই দেশ থেকে বড় দুঃখে বিদায় নিতে হয়েছিল! পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনার শিকার হতে হয়েছে সেই মানুষকে; যিনি এ দেশের মানুষের জন্য সারাটা জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন; সংসার, আত্মীয়স্বজন এমনকি প্রধানমন্ত্রীর আসনও ছেড়ে দিয়েছেন শুধু দেশের মানুষের মুক্তির জন্য; সেই মানুষকে এদেশের মানুষেরাই নির্বিচারে ও নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করেছে। শুধু তাঁকে নয়! তাঁর পরিবারের সকলকে! তাঁর চোখের সামনে বড় ছেলেকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে! এর চেয়ে বড় দুঃখের ইতিহাস জগতে বিরল! এটা দেখে যখন তিনি নিচে নেমেছেন; তাঁর বুকেও চালানো হয়েছে গুলি! স্ত্রী, পুত্র, পুত্রবধূ সহ সকল আত্মীয় স্বজনকে এক ঘণ্টার নৃশংস অপারেশন শেষ করা হয়েছে! আহ্! প্রকৃতি কতই না নির্লিপ্ত!! এত বড় দুঃখের পর প্রকৃতির উচিত ছিল_ আকাশ, বাতাস, চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, তারা, নক্ষত্র ও জল সবকিছু একত্রিত করা! ভীষণ হুঙ্কারে ওদের উপর বজ্রপাত নিক্ষেপ করা!

বলছিলাম জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের করুণ দুঃখের কথা! তার মতো এত মর্মান্তিক দুঃখ পৃথিবীর কোন রাজনীতিবিদ পাননি! পৃথিবীর অনেক রাষ্ট্রনায়ক আততায়ীর গুলিতে নিহত হয়েছেন; কিন্তু শুধু একজন- আর বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে সপরিবারে! জীবনের সব শক্তি দিয়ে যে দেশ তিনি স্বাধীন করে গেলেন, সেই দেশের মানুষ তাকে নির্মমভাবে হত্যা করল! এই হলো বড় মানুষদের প্রতি সাধারণ মানুষের প্রতিদান! উনি কি দিলেন? আর প্রতিদানে আমরা কি দিলাম? তিনি কেন? জগতের কোনো মহৎ মানুষ চরম দুঃখ ছাড়া পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে পারেননি! এটাই হচ্ছে পৃথিবীর বাস্তবতা! এটা কোনো দুঃখবাদী বা হতাশাবাদীদের অভিব্যক্তি নয়! এটা পৃথিবীর হাজার হাজার বছরের ইতিহাসের সঙ্গে অত্যন্ত সাদৃশ্যপূর্ণ ও সমান্তরাল। সক্রেটিসের কথা সবারই মনে আছে। সত্য ও সুন্দরের কথা বলতেন সক্রেটিস। বর্বর শাসকগোষ্ঠী হেমলক লতার বিষ পান করিয়ে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল!

মহাত্মা গান্ধীর কথা মনে আছে নিশ্চয়ই! ভারতবাসী মুক্তির জন্য এই মানুষটি কিনা করেছেন? সেই সময়ে লক্ষ লক্ষ মানুষকে ভারতবাসী’র স্বাধীনতার দাবির পতাকাতলে সমবেত করেছিলেন। মহাত্মা গান্ধীকে রক্তাক্ত অবস্থায় পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল! মাঝে মধ্যে ভাবনার উদয় হয়: এই মহামানবের প্রাণ পাখি যখন উড়ে যাচ্ছিল! যখন তিনি ব্যথায় ছটফট করছিলেন! কি ভাবনা তার মনে উদয় হয়েছিল? মনে হয়, তিনি শুধু বলেছিলেন— আহারে! ভারতবাসী! এই তোমাদের প্রতিদান! মানুষের সঙ্গে মানুষের এই আচরণের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা সমাজবিজ্ঞানীগণ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। লেখার শেষ অংশে এবার সেসব ব্যাখ্যা দিয়ে সামাজিক আচরণের দিকগুলো পর্যালোচনা করার প্রচেষ্টা নেওয়া যেতে পারে।

আইডিয়ালিজম বা আদর্শবাদব, রিয়ালিজম বা বাস্তববাদ, মার্কসিজম বা মার্কসবাদ, নিও-রিয়ালিজম বা নব্য-বাস্তববাদ মূলত এই চারটি তাত্ত্বিক সূত্র দিয়ে সামাজিক আচরণকে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।
আদর্শবাদীদের বা ভাববাদী তাত্ত্বিকগণের মতামত অনুসারে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক মৌলিক কতগুলো আদর্শ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। রক্তের সম্পর্ক, আবেগ, মমতা, মানবতাবোধ, স্নেহ, মায়া, রাগ, ক্রোধ, অভিমান ও পাশাপাশি একত্রে বসবাস করার আকাঙ্ক্ষা এই সম্পর্ককে নিয়ন্ত্রণ করে। আদর্শবাদীরা মনে করেন মানুষ মানবিক গুণাবলিসমৃদ্ধ প্রাণী। এখানে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, সামাজিক ন্যায়বিচার, নৈতিক মূল্যবোধ, মানবতাবোধ সবার উপরে স্থান পায়। রাগ, ক্রোধ ও অভিমান এগুলো মানুষের আবেগেরই বহিঃপ্রকাশ। এগুলোর কোনটারই স্থায়ী প্রভাব সমাজের উপর পড়ে না। বিধায় হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ সমাজবদ্ধভাবে একত্রে বসবাস করে আসছে। স্নেহ, মায়া, মমতা ও আবেগ দ্বারা তাড়িত হয়ে মানুষ পরিচালিত হয়। স্বার্থের সংঘাত নয়; মানবিক মূল্যবোধই সর্বাগ্রে স্থান পায়। 
আদর্শবাদীদের এই মর্মবাণী  সামাজিক সংঘাত ও স্বার্থের দ্ব›দ্বকে ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হয়েছে। মানুষে মানুষে সংঘাত, গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে সংঘাতে রূপান্তরিত হয়েছে, একসময় তা রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়েছে। রক্তের হোলি খেলা হয়েছে। প্রতিপক্ষের মুন্ডু কর্তনের জন্য হাজার হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় সংঘাতের ফলে শত শত বছর ধরে কোটি কোটি মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। এই ভয়াবহ অবস্থার ব্যাখ্যা দিয়েছে বাস্তববাদী তাত্ত্বিকগণ।

রিয়ালিজম বা বাস্তববাদী তত্ত্বের মূল কথা হচ্ছে, মানুষের মানুষের সম্পর্ক  নিয়ন্ত্রিত  হয়  মূলত স্বার্থের দ্বারা।  বাস্তববাদীদের মূল কথা হলো— আদিম সমাজে মানুষ যখন একত্রে বসবাস করত, সেখানেও স্বার্থ জড়িত ছিল। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বন্যপ্রাণীর আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য মানুষ দলবদ্ধভাবে বাস করত। একত্রে বসবাসের কোনো একপর্যায়ে নারী-পুরুষ একত্রে বসবাসের দিকগুলো আসে। সুন্দরী সঙ্গিনী বাছাই, একাধিক সঙ্গিনী নিজ দখলে রাখার মতো ঘটনাগুলো নারীকে শক্তির দিকে ধাবিত করে। আবেগ ও মমতার স্থান এখানে গৌন। শক্তির দাপটে একজনের নিকট থেকে আরেকজন শিকার করা বন্যপ্রাণী কেড়ে নিয়েছে। নারীরা শিকারের ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত দুর্বল অবস্থায় ছিল। ফলে যে পুরুষ বা গোত্র বেশি বেশি শিকার করতে পারত, তার বা তাদের প্রতি নারীদের আকর্ষণ বেশি থাকত। এখানে আবেগ ও মমতা নয়, খাদ্য সংগ্রহের স্বার্থ বিশেষভাবে জড়িত ছিল। বাস্তববাদীদের এই ব্যাখ্যা দ্বারা বর্তমান সমাজব্যবস্থাকেও বহুলভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। সীমিত সম্পদ বা পদমর্যাদার জন্য অসংখ্য প্রতিযোগী । ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র সব পর্যায়েই সম্পদ সংগ্রহের তীব্র প্রতিযোগিতা এবং আধিপত্য বিস্তারের মানসিকতা বাস্তববাদীদের সর্বাগ্রে সমর্থন করে। এখানে কোথাও ন্যায়বিচার, মানবিক মূল্যবোধ, স্নেহ, মমতা,  আবেগ ও ভালোবাসার স্থান সর্বোচ্চ আসনে আসীন নয়।

মার্কসবাদী তত্ত্বের মূল কথা হচ্ছে— মানুষের সংঘাতের মূল কারণ হচ্ছে স্বার্থ নয়-পুঁজির বিকাশ। আদিম সমাজ থেকে বর্তমান সমাজব্যবস্থায়, মানুষ ক্রমে ক্রমে পুঁজি সংগ্রহ এবং পুঁজির নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে পরস্পরের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়েছে। এই সংঘাত নিয়ন্ত্রণের একমাত্র উপায় হলো— এমন একটি সমাজ কাঠামো সৃষ্টি করা, যেখানে সম্পদের সুষমবণ্টন নিশ্চিত হবে; এবং ব্যক্তিমালিকানায় কোনো পুঁজি থাকবে না। মানুষ তার যোগ্যতার ভিত্তিতে একটি সামাজিক কাঠামো দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে। এভাবে নিয়ন্ত্রিত হতে হতে, একসময় সমাজে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠিত হবে। থাকবে না কোনো হানাহানি ও সংঘাত। মার্কসবাদীদের এই তত্ত্ব শুনতে বেশ লোল লাগে। বাস্তববাদী ও ভাববাদীদের কাছে তা ইউটোপিয়ান বা অলীক কল্পনা মাত্র। 

ক্লাসিক্যাল রিয়ালিজম এর তাত্ত্বিক দুর্বলতার দিকগুলোকে পরিশোধন করে নিও-রিয়ালিজম বা নব্য-বাস্তববাদের উৎপত্তি হয়েছে। নব্য-বাস্তববাদীগণ ক্লাসিক্যাল রিয়ালিস্টদের সঙ্গে একটি বিষয়ে অভিন্ন মতামত প্রকাশ করেছেন। নব্য-বাস্তববাদী মনে করেন, মানুষের সম্পর্কের মূল ভিত্তি হচ্ছে স্বার্থ। স্বার্থের সংঘাত মানুষের মজ্জাগত। মানুষ চিরদিন স্বার্থ দ্বারা পরিচালিত। তবে সমাজের কিছু কিছু অংশ আবেগ অনুভূতি দ্বারাও নিয়ন্ত্রিত হয়। নারী-পুরুষের সম্পর্ক ও  পারিবারিক সম্পর্ক- এসব বিষয়ে স্বার্থের পাশাপাশি আবেগ-অনুভূতিও স্থান পায়। তবে কখনই এগুলো মুখ্য হয়ে ওঠে না। মানুষ, সমাজ, রাষ্ট্র  তথা জাতি— সব কিছু পারস্পরিক স্বার্থ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। মানবিক মূল্যবোধ, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের সংজ্ঞা স্থান, কাল ও পাত্রভেদে মানুষ পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সংশোধন করে নেয়। নিরপোরাধ মানুষকে হত্যার মতো ভয়ানক ঘটনা সমাজ ও রাষ্ট্র যৌক্তিকতা দিয়ে বিচার করার চেষ্টা করে। স্বার্থের সংঘাত এখানে অনিবার্য। বস্তুগত স্বার্থ এখানে সর্বাগ্রে স্থান পায়; মানবিক মূল্যবোধ এখানে চিরদিনই গৌন। পার্পেচোয়াল ট্রুথ, ইউনিভার্সাল জাস্টিস বা সার্বজনীন ন্যায়বিচার বলে কিছু নেই!!

শেষ কথাটা খুব সহজ; মানুষ তার প্রয়োজনে নিয়ম বানায়। চায়ের কাপে মাছি পড়লে চা ফেলে দেয়; আর ঘিয়ের বয়ামে মাছি পড়লে মাছি ফেলে দেয়। মূল্যবান হলে সমাদৃত; মূল্য কম হলে, অসমাদৃত বা পরিত্যাজ্য— এটিই জগতের নিয়ম!

দু:খগাথা শিশু

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম