Logo
Logo
×

দৃষ্টিপাত

আল্লামা ইকবাল– আত্মবিশ্বাস স্বপ্ন আর জাগরণের কবি

সানোয়ারা খাতুন

সানোয়ারা খাতুন

প্রকাশ: ২৫ এপ্রিল ২০২৫, ০৮:১৭ পিএম

আল্লামা ইকবাল– আত্মবিশ্বাস স্বপ্ন আর জাগরণের কবি

বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দে মাতরম’ এর কথা হয়তো সবার জানা, তার কাছে স্বদেশ ছিল বাংলা আর তার ভাষ্যে স্বজাতি ছিল কেবল বাঙালি হিন্দু। অন্যদিকে আল্লামা ইকবাল লিখেছেন- তারানায়ে হিন্দ, তার দেশ সমস্ত বিশ্ব এবং তার স্বজাতি সমগ্র বিশ্বের মুসলমান; কিন্তু তার লেখায় বঙ্কিমের মতো সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ কখনো উঠে আসেনি।

‘চীন অউর আরব হামারা, হিন্দুস্তাঁ হামারা/ মুসলিম হ্যায় হাম, উতনি সারা জাহা হামারা’। অর্থাৎ, ‘আরব ও চীন আমাদের, হিন্দুস্তান আমাদের, আমরা মুসলিম, সারা বিশ্বজগত আমাদের। আল্লামা ইকবাল– আত্মবিশ্বাস, স্বপ্ন আর জাগরণের কবি।

যখন একটি জাতি হারিয়ে ফেলছিল নিজের অস্তিত্ব, তখন একজন মানুষ কলম হাতে তুলে নিলেন, চিন্তার আগুন জ্বালালেন এবং বললেন – 

‘خُدی کو کر بلند اتنا کہ ہر تقدیر سے پہلے

خدا بندے سے خود پوچھے، بتا تیری رضا کیا ہے؟’

অর্থাৎ- নিজেকে এমন উচ্চতায় নিয়ে যাও, যাতে নিয়তি আসার আগেই খোদা তোমার ইচ্ছা জেনে নেয়।

ড. মোহাম্মদ ইকবাল, যিনি শুধু কবি ছিলেন না, ছিলেন এক স্বপ্নদ্রষ্টা। তার কল্পনায় প্রথম জন্ম নিয়েছিল পাকিস্তান নামক স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্রের ধারণা। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন ‘তুমি হীনমন্যতায় ভোগো না, কারণ তোমার ভেতরেই লুকিয়ে আছে এক মহাশক্তি।’

ইকবাল বিশ্বাস করতেন, একজন মুসলমান কেবল ধর্ম পালন করেই থেমে থাকতে পারে না—তাকে হতে হয় জ্ঞানী, সাহসী এবং আত্মবিশ্বাসী।

তিনি বলতেন–‘A Muslim is he whose aim is to please God, not to please the world.’

তার ‘খুদি’ দর্শন ছিল আত্মচেতনা ও আত্মশক্তির শিক্ষা। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন, যদি আমরা নিজেদের বিশ্বাস করতে শিখি, তাহলে পাহাড়ও সরে যেতে পারে আমাদের সামনে থেকে।

ইকবালের দর্শনের মূল ভিত্তি ছিল ‘খোদা-সচেতন আত্মা’ (Self or Khudi)—একটি শক্তিশালী আত্ম-সত্ত্বার বিকাশ। তিনি বিশ্বাস করতেন, একজন মুসলমানের দায়িত্ব হলো নিজের আত্মাকে বিকশিত করা এবং খোদার প্রতিনিধি হিসেবে সমাজে দায়িত্ব পালন করা। তিনি পাশ্চাত্যের বস্তুবাদ ও আত্মনির্ভরতাহীন মুসলিম সমাজের সমালোচনা করতেন।

১৮৯৭ সালে তিনি আররি ও ইংরেজিতে সমগ্র পাঞ্জাবে প্রথম স্থান নিয়ে বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং দুটি স্বর্ণপদক লাভ করেন। পরবর্তীতে তিনি দর্শনশাস্ত্রে এমএ পাশ করেন এবং কলকাতা ওরিয়েন্ট কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন। 

১৯০৫ সালে তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য লন্ডন যান এবং কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। পরবর্তীতে জার্মানির মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে Development of Metaphysics in Persia নামে পারস্য-দর্শনবিষয়ক থিসিস লিখে পিএইচডি অর্জন করেন। এই থিসিসটি বই আকারে প্রকাশিত হলে বিজ্ঞ সমাজে তার বেশ নাম-ডাক পড়ে যায়। এরপর তিনি Lincon’s Inn থেকে ব্যারিস্টারি পাশ করেন।

দেশে ফিরে তিনি বিপুলভাবে সংবর্ধিত হন এবং আইন ব্যবসায় নিয়মিত হন; কিন্তু তিনি কখনো মাসিক খরচের টাকা আয় হয়ে যাওয়ার পর আর কোনো মোকাদ্দমা হাতে নিতেন না। এমনকি যদি কোনো মোকদ্দমায় মক্কেলের তেমন উপকার করতে পারবেন না বলে মনে হতো, তিনি সেটিও নিতেন না।

১৯৩৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ১৯৩৭ সালে ইলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে ডিলিট ডিগ্রি প্রদান করা হয়।

জালাল উদ্দিন রুমির প্রভাব 

মুসলিম জাতীয়তাবাদের কবি আল্লামা ইকবাল ছিলেন পারস্যের মহান সুফি কবি জালালউদ্দিন রুমির একনিষ্ঠ অনুসারী। তিনি রুমিকে তার ‘রুহানী পীর’ বা আত্মিক পথপ্রদর্শক হিসেবে মানতেন। তার অনেক কবিতায় রুমির প্রভাব স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করা যায়।

 ইকবাল ও পশ্চিমা দর্শন 

ইকবাল পশ্চিমা দর্শনের ওপর গভীর মনোযোগ দিয়েছিলেন, বিশেষ করে ফ্রেডারিখ নিটশে এবং ম্যাক্স শেলার -এর মতো দার্শনিকদের তত্ত্বে। তিনি তাদের চিন্তা ও দর্শন শাস্ত্রের ধারণাগুলোকে ইসলামি ধার‍ণার সঙ্গে সংযুক্ত করার চেষ্টা করেছিলেন। 

মুসলিম জাতীয়তাবাদ ও ইকবাল

ইকবালের বিখ্যাত উক্তি- ‘I am a Muslim first, because at the core of my soul, my faith, my morality, and my future — lies Islam.’

এই বক্তব্যে ইকবাল স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, তার পরিচয়ের কেন্দ্রে ইসলাম রয়েছে— জাতীয়তাবাদের প্রচলিত পাশ্চাত্য ভিত্তিকে তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন। পাশ্চাত্য জাতীয়তাকে তিনি বিপজ্জনক হিসেবে গণ্য করতেন। তার মুসলিম জাতীয়তাবাদের চিন্তা থেকে পরবর্তীতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়,যার ভেতরে আজকের বাংলাদেশের বীজ নিহিত ছিল। 

ইসলামের সুউচ্চ ধারণা ও উম্মাহর ঐক্য প্রসঙ্গে তিনি (১৯৩০ সালে এলাহাবাদ) বলেন- ‘Islam is not a nationality, but a nation-maker.’ তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে, ইসলাম নিজেই একটি জাতি গঠনের উপাদান, কারণ এটি একটি সামগ্রিক জীবন।

১৯৩০ সালে এলাহাবাদের ভাষণে মুসলিমদের জন্য একটি স্বতন্ত্র ও স্বাধীন রাষ্ট্রের উল্লেখ করেন। ভাষণের একটি পর্যায়ে বলেন- ‘I would like to see the Punjab, North-West Frontier Province, Sind and Baluchistan amalgamated into a single state. Self-government within the British Empire or without the British Empire, the formation of a consolidated North-West Indian Muslim state appears to me to be the final destiny of the Muslims, at least of North-West India.’

এই বক্তব্যকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বুদ্ধিবৃত্তিক ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়। তিনি কোথাও ‘পাকিস্তান’ শব্দটি উল্লেখ করেননি। মূলত তার নিকট পাকিস্তান ছিল একটি আন্দোলনের নাম- যা হিন্দুত্ববাদীদের কল্পিত রাম রাজ্যের বিপরীতে একটি মতবাদ, যার প্রতিফলন আজকের ভারত ও পাকিস্তানের ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে ক্রমাগতভাবে প্রতীয়মান হয়ে চলেছে।

‘শিক গুলাম’ ও ‘ইসলামিক এক্সিলেন্সি’

ইকবাল মুসলিম তরুণদের জন্য ‘শিক গুলাম’ বা শক্তিশালী ছাত্র আন্দোলন গড়ে তোলার পক্ষে ছিলেন। তার মতে, মুসলিম সমাজের উউন্নয়ন শুধুমাত্র সামাজিক বা রাজনৈতিক দিক থেকে নয় বরং সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাগত দিক থেকেও হওয়া উচিৎ। মূলত আজকের ‘কালচারাল উইন’ বা সাংস্কৃতিক বিজয় ধারণাটি তার  দর্শন থেকে এসেছে। 

ইকবাল ও জিন্নাহ

ইকবাল ও জিন্নাহর প্রথম সাক্ষাৎ হয় ১৯৩০ সালের পর। ততোদিনে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহের কাঁধে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিমদের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় মুক্তির লড়াই এসে বর্তেছে। শিষ্য লিয়াকত আলী খানের প্রেরিত বার্তা অনুসারে জিন্নাহ পুরোদমে মুসলিম লীগের হয়ে মাঠে আবির্ভুত হন। ইকবাল ছিলেন মুসলিম জাতীয়তাবাদের গভীর চিন্তক আর জিন্নাহ ছিলেন এই চিন্তার সরাসরি নেতা। অর্থাৎ একজন হলেন দার্শনিক, আরেকজন সেই দর্শনকে বাস্তবায়নকারী নেতা।

পশ্চিমে ইকবালের প্রভাব

ইকবাল ইউরোপে পড়াশোনা করার সময় (বিশেষ করে ইংল্যান্ড ও জার্মানিতে) সেখানে ফ্রেডারিখ নিটশে, কান্ট, গোয়েথে এবং বারগসনের মতো দার্শনিকদের চিন্তাধারার সঙ্গে পরিচিত হন এবং পরে তার নিজের চিন্তায় তাদের প্রভাব দেখতে পাওয়া যায়। একইভাবে, ইকবাল নিজেও ইউরোপে এক ধরনের ‘পূর্ব ও পশ্চিমের সংলাপ’ শুরু করেন।মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে রচিত তার পিএইচডি থিসিস ‘The Development of Metaphysics in Persia’ ইউরোপীয় পণ্ডিতদের মধ্যে মুসলিম দর্শনের নতুন গুরুত্ব তুলে ধরে। এটি ইউরোপে ইসলামি দর্শনের একটি নতুন পরিচিতি দেয়।

জার্মানিতে বিশেষ করে তার ফারসি কবিতাগুলোর জন্য আগ্রহ দেখা যায়, কারণ তিনি গ্যোয়েথেকে শ্রদ্ধা করতেন এবং অনেক জায়গায় তার লেখা গ্যোয়েথের দর্শনের পরিপূরক ছিল। গ্যোয়েথে ইনস্টিটিউটে ইকবাল নিয়ে আলোচনা এবং অনুবাদ কর্মও হয়েছে।

ইউরোপে বসবাস তাকে মুসলিম জাগরণের দার্শনিক করে তোলে। ইংল্যান্ডে ও জার্মানিতে পড়ার সময় ইকবাল ইউরোপীয় সমাজব্যবস্থা, বস্তুবাদ ও আত্মিক শূন্যতা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। এই অভিজ্ঞতা পরবর্তীতে তার কাব্য ও দর্শনের কেন্দ্রে পরিণত হয়। ফলে, তিনি একাধারে ইউরোপের দর্শনের সমালোচক এবং শিক্ষাগ্রাহী হয়ে উঠেন। আধুনিক ইসলামিক রেনেসাঁর চিন্তক হিসেবে ইউরোপে তাকে নিয়ে প্রায়শই আলোচনা হয়ে থাকে।

বেশ কিছু ইউরোপীয় ইসলামিক স্কলার, যেমন এনেম্যারি স্কিমেল (Annemarie Schimmel) (জার্মান ইসলামবিদ) ইকবালকে নিয়ে বহু গবেষণা করেছেন এবং তার রচনাকে ইসলামি পুনর্জাগরণের দিকনির্দেশক হিসেবে মূল্যায়ন করেছেন। 

আজও ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইকবাল পড়ানো হয়। বিশেষ করে Comparative Religion, Philosophy, Islamic Thought বা Post-Colonial Studies-এর পাঠ্যক্রমে ইকবাল এখনো ইউরোপের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়।

জার্মান ইসলামিক ওই স্কলার,  যিনি ইকবাল নিয়ে সবচেয়ে গভীরভাবে গবেষণা করেছেন, তার লেখা বইয়ের নাম- ‘Gabriel’s Wing: A Study into the Religious Ideas of Sir Muhammad Iqbal’-এটি ইকবালের কবিতা, দর্শন এবং ধর্মীয় ভাবনার বিশ্লেষণমূলক বই।

Goethe-র একজন বিশিষ্ট স্কলার Nicholas Boyle (UK), তিনি ইকবাল ও গ্যোয়েথের পারস্পরিক দার্শনিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করেছেন, বিশেষ করে ইকবালের ‘Payam-e-Mashriq’ ও গ্যোয়েথের ‘West-östlicher Divan’ তুলনা করেন।

ইকবাল ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান

আল্লামা ইকবালকে নিয়ে ইউরোপে যেসব স্টাডি সেন্টার রয়েছে-

১. Iqbal Chair at Cambridge University (ইউকে)।

২. Iqbal Akademie Deutschland (জার্মানি),

৩. SOAS University of London– এখানে ইসলামিক থট ও ইকবাল বিষয়ে পাঠ ও গবেষণা হয়।

আজকের তরুণদের জন্য ইকবাল শুধুই ইতিহাসের নাম নয়, তিনি এক মোটিভেশনাল আইকন। যখন মনে হবে তুমি একা, তুমি পারবে না– তখন মনে রেখো, ইকবাল বলেছিলেন –

‘তুমি ফিনিক্স পাখির মতো, নিজের ছাই থেকে জন্ম নিতে শেখো।’

চলো, ইকবালের মতো নিজের ভেতরের আগুন জ্বালাই। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলি– ‘আমি হার মানতে জানি না, কারণ আমার স্বপ্ন এখনো বাকি আছে।’ এই মহান ইসলামিক জাতীয়তাবাদী নেতা জন্মগ্রহণ করেন ৯ নভেম্বর ১৮৭৭ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারত, বর্তমানে পাকিস্তানের পাঞ্জাবের শিয়ালকোটে। ইন্তেকাল করেন ২১ এপ্রিল ১৯৩৮ সালে পাকিস্তানের লাহোরে।  মহান এই কবি পাকিস্তানের জাতীয় কবি হিসেবে অভিহিত হয়ে থাকেন।

লেখক: আহ্বায়ক বিপ্লবী ছাত্র পরিষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা

আল্লামা ইকবাল মুসলিম জাগরণ

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম