শতফুল ফুটতে দাও
এই সংকটকালে ঐক্যের বিকল্প নেই
ছবি: সংগৃহীত
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
’২৪-এর জুলাই গণ-অভ্যুত্থানপরবর্তী সময়, বিশেষ করে গত কয়েক মাসে বাংলাদেশের রাজনীতির হালচাল দেখে প্রচণ্ড হতাশবোধ করছি। শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের সাড়ে ১৫ বছরের অত্যাচার, নিপীড়ন ও নির্যাতন বাংলাদেশের দেশপ্রেমিকদের এক কঠিন অগ্নিপরীক্ষায় নিক্ষিপ্ত করেছিল।
দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলগুলো এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিল জুলাই অভ্যুত্থানে। জুলাই অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের শৃঙ্খল চূর্ণ করে, দেশবাসীর জন্য নিয়ে এসেছিল এক মুক্ত স্বদেশ। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি এক বিরল সময়।
এ সময়ে মুক্তির সুবাতাসের মধ্যে আমরা প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিয়েছি, প্রকাশ করেছি অন্তরের গভীরে লুকিয়ে থাকা ইচ্ছাগুলো। মায়ের, ভাইয়ের, বোনের রক্তস্নানে পূতপবিত্র হয়ে উঠেছিল স্বদেশভূমি। রক্তের বন্ধনে এক অভূতপূর্ব গণঐক্য গড়ে উঠেছিল।
’২৪-এর জুলাই অভ্যুত্থান একদিকে যেমন ছিল শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের মূলোৎপাটনের আপসহীন প্রয়াস, অন্যদিকে তেমনি ছিল বাংলাদেশের বুক থেকে ভারতীয় আধিপত্যবাদের শিকড়-বাকড়গুলোর উৎপাটন। ৫ আগস্ট ২০২৪ শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গেল এবং চরম ভরসার আশ্রয় পেল ভারত সরকারের কাছে।
শেখ হাসিনার দিল্লি চলে যাওয়াকে আমরা কেন পালিয়ে যাওয়া বলি, তা আমার মাথায় আসে না। শেখ হাসিনা তো নিরাপত্তা প্রহরার মধ্য দিয়ে হেলিকপ্টারে আসীন হলেন এবং হেলিকপ্টারযোগে বিমানবন্দরে অবতরণ করলেন। সেখান থেকে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি কার্গো বিমানে দিল্লির নিকটবর্তী হিন্দন বিমান ঘাঁটিতে পৌঁছান শেখ হাসিনা। সেখানে তাকে অভ্যর্থনা জানান ভারতের নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল।
শেখ হাসিনার সঙ্গে ছিল কারও কারও মতে ১৪টি স্যুটকেস, আবার কারও কারও মতে ৪টি স্যুটকেস। এ স্যুটকেসগুলোতে নিছক কাপড়-চোপড় ছিল না, ছিল মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা, স্বর্ণ ও হীরকের অলংকার। বিষয়টা অনুমাননির্ভর। কারণ অধিকাংশ স্বৈরশাসক দেশ ছেড়ে পালানোর সময় মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা ও হিরা-জহরত সঙ্গে করে নিয়ে যায়। ঢাকা থেকে দিল্লির হিন্দন বিমান ঘাঁটিতে যাওয়ার সময় তার সঙ্গী ছিলেন তারই ছোট বোন শেখ রেহানা।
অজিত দোভাল ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসাবে নিয়োগ পাওয়ার আগে ভারতের পুলিশ সার্ভিসের একজন খ্যাতিমান সদস্য ছিলেন। তিনি ছিলেন এবং এখনো আছেন অঘটনঘটনপটিয়সী হিসাবে। ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে অজিত দোভাল নানাবিধ কর্মকৌশল প্রণয়ন করেন।
ভারতে পৌঁছানোর পরপর শেখ হাসিনার সঙ্গে অজিত দোভালের সাক্ষাৎ তাৎপর্যহীন নয়। এ ছাড়া শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের ক্ষমতাসীন মহলের উচ্চপদস্থদের বেশকিছু বৈঠক হয়েছে। এসব বৈঠক নিছক গাজরের হালুয়া খাওয়ার বৈঠক ছিল না।
কীভাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন পালটে দেওয়া যায়, কীভাবে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসিত করা যায়, কীভাবে বাংলাদেশে অব্যাহতভাবে অস্থিরতা জাগিয়ে রেখে সাধারণ মানুষের মন বিষিয়ে তোলা যায়, সেসবই হলো ভারতের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে শেখ হাসিনার শলা-পরামর্শের বিষয়। বাংলাদেশে প্রায় প্রতিদিন যেসব খণ্ড খণ্ড বিক্ষোভ-প্রতিবাদের ঘটনা ঘটছে, সেগুলোর মধ্যে কয়টি ন্যায্য এবং কয়টি ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার ‘র’-এর কারসাজি, তা ভেবে দেখতে হবে।
বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরপর কিছু সাম্প্রদায়িক দুর্ঘটনা ঘটে। ভারতীয় পত্র-পত্রিকায় এসব ঘটনা সম্পর্কে তিলকে তাল করে প্রচার করা হয়। সামান্য সংখ্যক যেসব ঘটনা ঘটেছে, তার মূলে রয়েছে রাজনৈতিক বিরোধ, সাম্প্রদায়িক বিরোধ নয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো স্বেচ্ছাসেবক টিম গঠন করে সংখ্যালঘুদের জীবন ও সম্পদ রক্ষায় দিনরাত্র পাহারার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। সরকারও এসব দুর্ঘটনা দমনে সক্রিয় থেকেছে। এরপর আমরা দেখলাম কলকাতা ও আগরতলায় বাংলাদেশ হাইকমিশন অফিস আক্রান্ত হয়েছে। ভারতীয় মিডিয়ায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কাল্পনিক বিরোধ-সংঘাতের খবর প্রতিনিয়ত প্রচার করা হচ্ছে।
এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, ভারতীয় আধিপত্যবাদ বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে যাওয়া আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠায় কোনো রকম শৈথিল্য প্রদর্শন করবে না। মাঝে মাঝে রব তোলা হয়, ইউনূস সরকার অমুক দিন ক্ষমতা হারাবে, শেখ হাসিনা অমুক দিন বাংলাদেশের প্রবেশ করবেন, ইত্যাদি ইত্যাদি। আওয়ামী লীগওয়ালাদের এসব দুঃসাহসিক উচ্চারণের ভিত্তি হলো বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে এখনো বিশালসংখ্যক আওয়ামী দোসর রয়ে গেছে। এরা প্রকাশ্যে বৈরিতা না দেখালেও ভেতরে ভেতরে অনেক কলকাঠি নাড়াচ্ছে বলে আমরা ধারণা করতে পারি। এসব ষড়যন্ত্রকারীর মুখোশ উন্মোচনের দায়িত্ব গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর।
এক্ষেত্রে জনগণের দায়িত্ব কোনো অংশে কম নয়। বিশেষ পরিস্থিতিতে তারা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর চেয়েও ভালো ভূমিকা পালন করতে পারে। যুদ্ধাবস্থায় গোয়েন্দাদের চেয়েও দেশপ্রেমিক জনতার ভূমিকা অনেক বেশি কার্যকর হতে পারে। বাংলাদেশে একটি প্রতিবিপ্লব ঘটাতে শেখ হাসিনা ও ভারত কোনো সুযোগ হাতছাড়া করবে না। এ সাবধানবাণী আমি গভীর আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে উচ্চারণ করতে চাই। আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতীয় আধিপত্যবাদের দ্বন্দ্বই প্রধান দ্বন্দ্ব। অন্যসব দ্বন্দ্ব এ প্রধান দ্বন্দ্বের অধীনস্থ হয়ে গেছে।
জাতীয় জীবনের পরম সংকটময় মুহূর্তে আমরা যখন দেখি, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো একে অপরের সঙ্গে খাওয়াখায়িতে লিপ্ত, তখন ভয়ানকভাবে হতাশ হই। বাংলাদেশে অনেক রাজনৈতিক দল থাকলেও তিনটি রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ড মিডিয়াতে স্থান পায়। রাজনৈতিক দলগুলো হচ্ছে বিএনপি, জামায়াত ও জাতীয় নাগরিক পার্টি। এ দলগুলোর মধ্যে বড় ধরনের বিরোধ সৃষ্টি হওয়ার কথা ছিল না।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে সত্য হলো, জাতির জন্য বিপজ্জনক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হচ্ছে এ দলগুলোর মধ্যে। বিরোধের ইস্যুগুলো হচ্ছে নির্বাচনের তারিখ, সংস্কারের বিষয়ে গুরুত্ব, জাতীয় ও স্থানীয় সরকারের নির্বাচনের সময় কীভাবে নির্ধারিত হবে এবং ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার কী কী ভুল করছে তা নিয়ে। এক বিএনপি নেতা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
অথচ আমরা যতটুকু জানি বা বুঝি, তাতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারের ৯ মাসে অবৈধ হওয়ার কোনো অবকাশ সৃষ্টি হয়নি। এ সরকারের বৈধতার উৎস হলো ২০২৪-এর জুলাই অভ্যুত্থান। একইভাবে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান তার ক্ষমতার বৈধতা পেয়েছেন ১৯৭৫-এর ৭ নভেম্বরের সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে।
যে যুক্তিতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারকে বৈধতাহীন ভাবা হচ্ছে, সেই একই যুক্তিতে শহীদ জিয়ার রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনও অবৈধ মনে করা যায়। তবে এর চেয়ে সত্যের অপলাপ আর কিছু নয়। আওয়ামী লীগ শহীদ জিয়ার শাসনামলকে অবৈধ ঘোষণা করতে সংবিধান কাটাছেঁড়া করেছে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, আজ তারাই এদেশের জনগণের চোখে অবৈধ হয়ে পড়েছে। আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
তবে সব কথার শেষ কথা হলো ভারতীয় আধিপত্যবাদ ও আওয়ামী লীগের সম্মিলিত অপপ্রয়াস থেমে থাকছে না, বরং দিনের পর দিন তারা মারমুখী হয়ে উঠছে। এত মানুষের প্রাণহরণ এবং এত মানুষকে আহতকরণের পরও তারা বিন্দুমাত্র অনুশোচনা করছে না। বরং উলটো গীত গাইছে, সুনিপুণভাবে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে ড. ইউনূস মানুষের লাশের ওপর দাঁড়িয়ে ক্ষমতা দখল করেছে। এটা শেখ হাসিনার উক্তি। এর চেয়ে সত্যের অপলাপ আর কী হতে পারে!
গত কয়েক মাসে তিনটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। কী কী বিষয়ে সম্পর্কের অবনতি ঘটল, তা আমার চেয়ে পাঠকরা অনেক বেশি ভালো জানেন। তবে ভারতীয় আধিপত্যবাদ ও আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্রের পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনৈক্য শুধু হতাশাব্যঞ্জক নয়, বিপজ্জনকও বটে। তাদেরকে উপলব্ধি করতে হবে, তাদের অনৈক্য বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনের পথ প্রশস্ত করে দিচ্ছে।
সুতরাং সাবধান! এ যাত্রায় আওয়ামী লীগ পুনর্বাসিত হলে কারও অস্তিত্ব থাকবে না। বিএনপি ও ড. ইউনূসের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি খুবই দুঃখজনক। আওয়ামী আমলে ড. ইউনূস নিগৃহীত হলে বিএনপি তার পাশে দাঁড়িয়েছিল। ড. ইউনূসের গৌরবে দেশ গৌরবান্বিত হয়েছে। তার মতো মানুষ ভুল করতে পারেন না, এমনটি নয়। হিউম্যান করিডর ও চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে ড. ইউনূস সরকারের উদ্যোগ কিছু বিতর্কের জন্ম দিয়েছে, অস্বীকার করা যাবে না। তবে এজন্য তার সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধংদেহী মনোভাব পোষণও দেশের বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতিতে কাম্য নয়। ড. ইউনূস যখন সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান বিবৃতি দিয়ে বলেছিলেন, এ সরকারকে ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না। এ অবস্থান আজকের দিন পর্যন্ত সঠিক।
ড. ইউনূস এখন ব্রিটেন সফরে আছেন। তার সফরসূচির মধ্যে তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠকের কর্মসূচিও রয়েছে। আমরা আশা করব, এ বৈঠক ক্ষতিগ্রস্ত জাতীয় ঐক্যকে আবারও সচল ও সুদৃঢ় করে তুলবে। বিএনপির মহাসচিব সম্ভাব্য এ বৈঠককে জাতীয় রাজনীতির টার্নিং পয়েন্ট বলে মন্তব্য করেছেন। এর আগে সংবাদ সম্মেলন করে তিনি সব পক্ষকে একে অপরের প্রতি সুস্থ ও শালীন ব্যবহারের আহ্বান জানিয়েছেন। আমরা জানি, রাজনীতিতে কুরুচিপূর্ণ বচনগুলো ক্ষতি ও বিপদ ডেকে আনে। সামাজিক মাধ্যমে জানলাম, বেগম খালেদা জিয়া তার দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যদের বলেছেন, ড. ইউনূসের সঙ্গে বিরোধ করে বিএনপির কোনো লাভ হবে না।
আশা করা যায়, এরপর থেকে বিএনপি নেতারা বিভ্রান্তির চোরাগলিতে পথ হারাবেন না। সবচেয়ে বড় দল হিসাবে বিএনপির কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক। তবে এ দলটি যদি পথভ্রষ্ট হয়, তাহলে অগণিত সাধারণ মানুষ দুঃখ পায়। বড় দল হিসাবে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার বিশাল দায়িত্ব বিএনপির কাঁধে। বিএনপিকে এ দায়িত্ব থেকে বিচ্যুত হওয়া চলবে না। লন্ডনে ড. ইউনূসের সঙ্গে তারেক রহমানের বৈঠকটি সুন্দর ও সফল হোক, এটাই দেশবাসীর কামনা।
ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ

