পাউলো ফ্রেইরি—শিক্ষার বিপ্লবী দার্শনিক
প্রকাশ: ২২ জুলাই ২০২৫, ০৬:৩০ পিএম
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
পাউলো ফ্রেইরি ছিলেন ব্রাজিলের একজন প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, যিনি বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ‘শিক্ষা ও নিপীড়ন’ বিষয়ে বিপ্লবী চিন্তাধারা উপস্থাপন করেন। তার ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত বই ‘Pedagogy of the Oppressed’ বা ‘নিপীড়িতের শিক্ষাবিদ্যা’ আজও বিকল্প শিক্ষাদর্শনের ক্ষেত্রে সর্বাধিক প্রভাবশালী গ্রন্থ। তিনি বিশ্বাস করতেন, শিক্ষা শুধু জ্ঞান প্রদান নয় এটি হচ্ছে মুক্তির একটি পথ, যা মানুষকে সচেতন করে তোলে, প্রশ্ন করতে শেখায় এবং সমাজ বদলের অনুপ্রেরণা জোগায়।
একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বে জ্ঞান ও শিক্ষা ক্ষমতার প্রধান ভিত্তি হয়ে উঠেছে। কিন্তু এই শিক্ষা সবসময় কি সকল মানুষের মুক্তির পথে সহায়ক হচ্ছে? নাকি তা কখনো কখনো নিপীড়নকে আরও সংহত করছে? এই প্রশ্নই উত্থাপন করেছিলেন ব্রাজিলের বিপ্লবী শিক্ষাবিদ পাউলো ফ্রেইরি, তার ঐতিহাসিক এই বইটিতে। এই বইয়ে তিনি দেখিয়েছেন শিক্ষা যদি নিপীড়িত জনগণের আত্মসচেতনতা জাগিয়ে তুলতে ব্যর্থ হয়, তবে তা নিছক একটি শাসকগোষ্ঠীর হাতিয়ার হয়ে পড়ে।
ব্যাংকিং মডেল বনাম মুক্তির শিক্ষা
ফ্রেইরি প্রচলিত শিক্ষাকে বলেছেন ‘ব্যাংকিং মডেল’ যেখানে শিক্ষক হচ্ছেন একমাত্র ‘জ্ঞানধারক’ আর শিক্ষার্থী শুধু ‘জ্ঞানগ্রহীতা’। এই ব্যবস্থায় শিক্ষার্থী কোনো প্রশ্ন করতে শেখে না, সমাজের অবস্থান নিয়ে চিন্তা করে না। এর ফল হলো একটি নিষ্ক্রিয়, অনুগত এবং দমনযোগ্য জনগোষ্ঠী।
ফ্রেইরির প্রস্তাব একটি ডায়ালগভিত্তিক, চেতনা-নির্মাণমুখী ও পারস্পরিক শেখার শিক্ষাব্যবস্থা যেখানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী একসঙ্গে সমাজ বিশ্লেষণ করে, নিজেদের বাস্তবতা বুঝে এবং মুক্তির পথ খুঁজে নেয়।
চৈতন্যের বিকাশ
এই বইয়ের অন্যতম প্রধান অবদান হলো ‘চেতনা জাগরণ বা বোধের বিকাশ’ নামক ধারণা। এটি এমন এক মানসিক উত্তরণ, যার মাধ্যমে নিপীড়িত ব্যক্তি নিজেকে নিপীড়িত বলে চিহ্নিত করে এবং শোষণের শিকড় চিনে নিতে শেখে। এই চেতনা ব্যক্তিগত নয় এটি রাজনৈতিক, সামাজিক ও বিপ্লবী। একটি চিন্তাশীল মানবগোষ্ঠী নিজ সমাজের অনাচার, বৈষম্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে। আর এই চেতনা জন্ম নেয় তখনই, যখন শিক্ষা হয় পারস্পরিক সংলাপভিত্তিক, অভিজ্ঞতা-নির্ভর ও মানবিক।
শিক্ষা সর্বদা রাজনৈতিক
ফ্রেইরি বলেন, ‘Education is never neutral’ অর্থাৎ শিক্ষা নিরপেক্ষ নয়। এটি হয় বিদ্যমান ক্ষমতা কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করে, না হয় তা টিকিয়ে রাখে। যারা শিক্ষা নিয়ন্ত্রণ করে, তারা অনেক সময় জনগণের প্রশ্ন করার ক্ষমতা হরণ করে নেয়। তাই শিক্ষার কাজ হলো ক্ষমতা পুনর্বিন্যাসে জনগণকে প্রস্তুত করা, তাদের কণ্ঠস্বর ফিরিয়ে দেওয়া।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রয়োগ
বাংলাদেশে আজো শিক্ষার অভ্যন্তরে নানা বৈষম্য, শ্রেণি বিভাজন ও কেন্দ্রীকরণ লক্ষ্য করা যায়। শহর ও গ্রাম, ইংরেজি ও বাংলা মাধ্যম, মাদ্রাসা ও আধুনিক শিক্ষা এই বিভাজন শুধু দক্ষতার নয়, এটি আত্মপরিচয় ও মর্যাদার লড়াইও বটে।
এখানে ‘নিপীড়িতের শিক্ষাবিদ্যা’ হতে পারে একটি রূপান্তরমুখী হাতিয়ার। যার কাজ হবে শ্রমজীবী ও প্রান্তিক জনগণের জন্য প্রাসঙ্গিক শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করা, শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন করতে শেখানো, পাঠ্যবইয়ের বাইরের বাস্তবতা নিয়ে ভাবতে উৎসাহ দেওয়া এবং ‘একতরফা শেখানো’ সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে পারস্পরিক শেখার সংস্কৃতি গড়ে তোলা—এই সবই হতে পারে ফ্রেইরি-অনুপ্রাণিত শিক্ষায় উত্তরণের দিকচিহ্ন।
গণশিক্ষা ও প্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষায় ফ্রেইরি
বাংলাদেশে নন-ফরমাল শিক্ষা, সামাজিক আন্দোলন, গ্রামীণ শিক্ষাকেন্দ্র, নারীশিক্ষা, এমনকি শ্রমজীবী মানুষের সচেতনতাভিত্তিক প্রশিক্ষণ এসব ক্ষেত্রেই ফ্রেইরির দর্শন বাস্তব প্রয়োগযোগ্য। তিনি মনে করতেন, বই মুখস্থ নয়—মানুষের জীবনের বাস্তবতা নিয়ে কথা বলা ও শেখা—তবেই তা প্রকৃত শিক্ষা।
শ্রমজীবী মানুষের শিক্ষা: ক্ষমতায়নের অবিচ্ছেদ্য অংশ
শ্রমজীবী মানুষের শিক্ষা বা ওয়ার্কার্স এডুকেশন আজকের কর্মসংস্থান ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত জরুরি। এটি কেবল তাদের প্রফেশনাল দক্ষতা বৃদ্ধি করে না, বরং তাদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও মানবাধিকার বিষয়েও সচেতন করে তোলে। শ্রমিকদের জন্য নির্দিষ্ট শিক্ষামূলক কর্মসূচি যেমন শ্রম আইন, শ্রমিক অধিকার, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা, সংগঠন গঠন, ও অর্থনৈতিক জ্ঞান—তারা যেন কর্মস্থলে এবং সমাজে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, অসংগঠিত শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীর জন্য এ ধরনের শিক্ষা তাদের জীবনমান উন্নয়ন এবং সামাজিক ন্যায়বিচার অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। পাউলো ফ্রেইরির দর্শনে যেমন শিক্ষার মাধ্যমে নিপীড়িতের চেতনা জাগানো হয়, তেমনি শ্রমজীবীদের জন্যও শিক্ষা একটি শক্তিশালী মুক্তির পথ হতে পারে।
জাগরণের শিক্ষা চাই
পাউলো ফ্রেইরির ‘মজলুমের শিক্ষানীতি’ আমাদের শেখায় শিক্ষা কেবল পুঁথিগত বিষয় নয়, এটি এক সামাজিক কর্মযজ্ঞ। এই শিক্ষাব্যবস্থা হতে হবে এমন, যা জনগণের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেয়, তাদের চিন্তাকে মূল্যায়ন করে, এবং পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখাতে শেখায়। আজকের বাংলাদেশে যখন সামাজিক সাম্য, ন্যায়বিচার ও মানবিক বিকাশের কথা বলা হচ্ছে তখন ফ্রেইরি’র চিন্তা হতে পারে একটি দিশারী শক্তি। নিপীড়নের অবসান ঘটিয়ে, প্রশ্ন ও সংলাপভিত্তিক এক জাগরণশীল শিক্ষাব্যবস্থাই হতে পারে জাতির মুক্তির পথ।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, গ্লোবাল নলেজ ফাউন্ডেশন ও পিএইচডি গবেষক
ই-মেইল: farukdu321@gmail.com

