Logo
Logo
×

দৃষ্টিপাত

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত: নিরাপত্তার নামে মানবাধিকার লঙ্ঘন?

মো. ওবায়দুল্লাহ

মো. ওবায়দুল্লাহ

প্রকাশ: ২৭ জুলাই ২০২৫, ০৮:২২ পিএম

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত: নিরাপত্তার নামে মানবাধিকার লঙ্ঘন?

ফাইল ছবি

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত, প্রায় ৪,১৫৬.৬ কিলোমিটার দীর্ঘ। এই সীমান্তটি ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে অবস্থিত এবং পাঁচটি ভারতীয় রাজ্য - পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও মিজোরামের সাথে মিলিত হয়েছে। এই সীমান্ত শুধু একটি ভৌগোলিক রেখা নয়, এটি ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং মানবিক কষ্টের এক জীবন্ত স্মারক। পৃথিবীর পঞ্চম দীর্ঘতম স্থলসীমান্ত হওয়া সত্ত্বেও, এটির পরিচয় দৈর্ঘ্যে নয়, বরং সীমাহীন রক্তক্ষরণের গল্পে গাঁথা। যেখানে প্রতিটি কাঁটাতারের ফাঁকে ঝুলে থাকে নিহত কারও আত্মার আর্তনাদ।

এই সীমান্ত হতে পারত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের সেতু। কিন্তু বাস্তবে, এটি হয়ে উঠেছে প্রাণসংহারী বন্দুকের আওয়াজে প্রকম্পিত এক মৃত্যু সীমান্ত। বিশেষ করে বাংলাদেশের দরিদ্র সীমান্তবাসীদের কাছে, যারা প্রায়শই “চোরাকারবারি” বা “অনুপ্রবেশকারী” আখ্যা পেয়ে বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের (বিএসএফ) গুলিতে প্রাণ হারান। ভারত এই ঘটনাগুলোর পেছনে চোরাচালান ও নিরাপত্তার অজুহাত দেয়, কিন্তু মানবাধিকারের চোখে এসব নিছক অবমাননা ও নিষ্ঠুরতার দৃষ্টান্ত।

র‌্যাডক্লিফ রেখা থেকে রক্তাক্ত বাস্তবতা

এই সীমান্তের জন্ম ১৯৪৭ সালের দেশভাগে, যখন ব্রিটিশ আইনজীবী সাইরিল র‌্যাডক্লিফ ব্রিটেনে বসেই মাত্র ৫ সপ্তাহের মধ্যে ধর্মীয় বিভাজনের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তানকে ভাগ করে দেন। পূর্ববঙ্গ হয় পূর্ব পাকিস্তান, পরবর্তীতে এক রক্তরক্ষী যুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্ম হয়। কিন্তু ভারত বিভাজনের সেই ইতিহাস এখনও কাঁটাতারে বাঁধা পড়ে আছে।

স্বাধীনতার পাঁচ দশক পরেও, এই সীমান্তে শান্তি, আস্থা ও বন্ধুত্ব প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়নি। বরং এটি হয়ে উঠেছে এমন এক ভয়ানক অঞ্চল, যেখানে ভারতীয় রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে প্রতিনিয়ত নিহত হন সাধারণ মানুষ। কোনো বিচার নেই, কোনো জবাবদিহি নেই।

ভারতের ‘নিরাপত্তা’ নীতিবাস্তবতা নাকি কল্পকথা?

ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে "অবৈধ বাংলাদেশি" অভিবাসী ইস্যুটি একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক হাতিয়ার। আসাম ও পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যগুলোতে এই প্রসঙ্গে অহরহ বলা হয়, "বাংলাদেশিরা ভারতে এসে চাকরি কেড়ে নিচ্ছে, সমাজে অস্থিরতা তৈরি করছে।" এমনকি ২০২০ সালে ভারতের তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জি. কিশান রেড্ডি মন্তব্য করেন, “ভারত যদি বাংলাদেশিদের নাগরিকত্ব দিতে শুরু করে, তাহলে বাংলাদেশের অর্ধেক জনসংখ্যা খালি হয়ে যাবে। (বিবিসি বাংলা, ২০২০)”

এই ধরনের বক্তব্য জনমনে আতঙ্ক তৈরি করে এবং সীমান্তে গুলি চালানোর ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করে। অথচ সরকারি তথ্য বলছে ভিন্ন কথা। ২০১১ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে মাত্র ১৫,১৭৬ জন বাংলাদেশি ভারতীয় নাগরিকত্ব পেয়েছেন, যার ১৪,৮৬৪ জনই পেয়েছেন ২০১৫ সালের ভূমি সীমান্ত (ছিটমহল) চুক্তির আওতায়। অর্থাৎ রাজনৈতিক বক্তব্য আর বাস্তবতায় বিস্তর ফারাক।

সীমান্তের রক্তাক্ত পরিসংখ্যান

১৯৭২ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত, বিএসএফ-এর গুলিতে ৫,২৮৮ জন বাংলাদেশি নাগরিক নিহত হয়েছেন। সবচেয়ে ভয়াবহ সময় ছিল ২০০২ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত, যেখানে প্রতি বছর গড়ে ২৩৫ জন মারা গেছেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মৃত্যুর সংখ্যা কিছুটা কমলেও (২০২২২০২৩ সালে ৯৫ জন), সহিংসতার ধারা থেমে নেই। এই সংখ্যা কোনভাবেই "সীমান্ত নিরাপত্তার" সঙ্গে মানানসই নয়বরং রাষ্ট্রীয় সহিংসতা ও জবাবদিহির অভাবকে প্রতিফলিত করে।

২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি, কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ফেরার সময় ১৫ বছর বয়সী ফেলানি খাতুন বিএসএফ-এর গুলিতে নিহত হন। কাঁটাতারের বেড়ায় আটকে তার ছোট্ট দেহ পাঁচ ঘণ্টা ঝুলে থাকে। পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল বিএসএফ সদস্যরা, কেউ এগিয়ে যায়নি। সেই করুণ দৃশ্য আজও বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মহলের বিবেককে নাড়া দেয়।

২০১৫ সালে ভারতের মানবাধিকার কমিশন ফেলানির পরিবারকে মাত্র ৫ লাখ রুপি ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সুপারিশ করে। কিন্তু একটি কিশোরীর জীবনের মূল্য কি এতটাই সস্তা?

বিএসএফ-এর যুক্তি কি টেকে?

বিএসএফ প্রায়ই দাবি করে, তারা চোরাচালান ঠেকাতে গুলি চালায়। কিন্তু ভারতের নিজস্ব এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) ২০২০ সালে প্রকাশ করে যে বিএসএফ সদস্যরাই গবাদি পশু পাচারের একটি বৃহৎ চক্রের সঙ্গে যুক্ত। যারা চোর ধরে, তারাই যদি চোর হয়তাহলে সীমান্ত নিরাপত্তা আসলে কার জন্য?

এই দ্বিচারিতা সীমান্ত রক্ষীদের দায়িত্ববোধকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। সীমান্তবাসী জানেসবচেয়ে বড় ভয় চোর নয়, রক্ষকের গুলি।

মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইন

বিএসএফ-এর নির্বিচারে গুলি, আটক ও নির্যাতন ভারতের সংবিধান এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তিযেমন ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন অব হিউম্যান রাইটস (ইউডিএইচআর) ও আইসিসিপিআরআরদুইয়েরই সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। বাংলাদেশ সরকার একাধিকবার এই ইস্যু জাতিসংঘ ও দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে তুলেছে, কিন্তু কার্যকর পদক্ষেপ বিরল।

বাংলাদেশের সীমান্তবাসীদের কাছে কাঁটাতারের ওপার মানে আতঙ্ক, অসহায়তা আর সম্ভাব্য মৃত্যু।

আমরা কী চাই?

নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কিন্তু সেই নিরাপত্তা যদি মানুষের জীবনহানির বিনিময়ে হয়তাহলে তা আর নিরাপত্তা নয়, বরং অন্যায় ও নিপীড়নের নতুন রূপ।

আমাদের প্রস্তাবনা:

সীমান্তে নির্বিচার গুলি বন্ধ করতে হবে এবং বিএসএফ-এর অস্ত্র ব্যবহারে আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে হবে

দ্বিপক্ষীয় তদন্ত কমিশন গঠন করতে হবে, যেখানে নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে হত্যাকাণ্ডের বিচার নিশ্চিত হবে

সীমান্ত অঞ্চলে সম্প্রীতি ও বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে মানুষ বিপথে না যায়

ফেলানি খাতুনের মতো ঘটনায় নতুন ন্যায়বিচার মডেল প্রতিষ্ঠা করতে হবেযা শুধু ক্ষতিপূরণ নয়, বরং প্রতিকার ও জবাবদিহি নিশ্চিত করবে

ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কাঁটাতার দুই জাতির শত্রুতা নয়, বরং অতিক্রান্ত ইতিহাসের একটি অধ্যায়। আজ আমাদের প্রয়োজন এই সীমান্তকে একটি "নিরাপত্তা ও মানবতা"দুইয়ের ভারসাম্যের প্রতীক হিসেবে গড়ে তোলা।

সীমান্তের প্রতিটি প্রাণ, প্রতিটি আর্তনাদ একটি বার্তা দেয়রাষ্ট্রের দায়িত্ব শুধু সীমান্ত পাহারা নয়, বরং জীবনের মর্যাদা রক্ষা করা। ফেলানির কাঁটাতারে ঝুলে থাকা দেহ যেন আর কোনো মা-বাবাকে দেখতে না হয়সেটাই হোক আমাদের রাষ্ট্রের মানবিক দায়িত্ব।

লেখক: ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ঢাকার একজন ভিজিটিং স্কলার। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন মিসিসিপিতে পলিটিক্যাল সায়েন্সে উচ্চশিক্ষারত

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম