মব জাস্টিসের নামে নৃশংসতা রোধ করুন
সেলিম আল রাজ
প্রকাশ: ৩০ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে/মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই’। সোহাগও চেয়েছিল এই সুন্দর পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে। কিন্তু কিছু মানুষরূপী নরপশুগুলো তাকে বেঁচে থাকতে দেয়নি। এখনও জ্বলজ্বল করে চোখের সামনে ভেসে বেড়ায় বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরারের নির্মম হত্যাকাণ্ডের দৃশ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তোফাজ্জল হোসেন নামে এক যুবককে আঘাতে আঘাতে মৃত্যুর মুখে ঢেলে দেওয়ার নিদারুণ হৃদয়বিদারক ঘটনা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র শামীম মোল্লাকে গণপিটুনিতে কেড়ে নেওয়া প্রাণের খবর। সহিংসতার চিত্রগুলো মনে পড়লেই গা শিউরে উঠে। এমন অজস্র বেদনাদায়ক ঘটনা ঘটাচ্ছে নরপিশাচগুলো। ক্রোধ, দ্বন্দ্ব, খামখেয়ালি, তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রায় সময় দেখা যাচ্ছে বিচারবহির্ভূত এমন হত্যাকাণ্ডের দৃশ্য।
৫ আগস্ট সরকার পতনের পর দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার ঘটনা বেড়েছে অনেক। মব জাস্টিস অর্থাৎ উচ্ছৃঙ্খল জনতা অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিজ নিজ স্বার্থসিদ্ধির জন্য বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছে। বাড়িঘর, দোকানপাট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর ও লুটপাট, বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষদের অসম্মান ও মানহানিকর ঘটনা প্রায়শই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কুমিল্লার মুরাদনগরের প্রবাসী গৃহবধূ ধর্ষণ ও মব পরিবেশ সৃষ্টির পেছনে ছিল দুই ভাইয়ের দ্বন্দ্বের জের। ভাইরাল হওয়া ভিডিও চিত্র শুধু ভুক্তভোগীর জন্য নয় আমাদের দেশের জন্যও লজ্জাজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।
মব জাস্টিস নামে যে সংক্রামক ব্যাধি সমাজের সর্বত্র দেখা দিচ্ছে, এর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে রাষ্ট্রে। ফলশ্রুতিতে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছে জনমনে। আইনবহির্ভূত লোমহর্ষক নিষ্ঠুরতার ঘটনা কখনো কাম্য হতে পারে না। সভ্য সমাজ কখনো আদিম যুগের মতো নৃশংসতা সমর্থন করে না। প্রতিটা রাষ্ট্রের প্রতিটা মানুষের ন্যায়বিচার চাওয়া পাওয়ার অধিকার আছে। বাংলাদেশের সংবিধানে ২৭ অনুচ্ছেদে বলা আছে সব নাগরিক আইনের চোখে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয়লাভের অধিকারী। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি প্রতিবেদন অনুসারে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে ৭ মাসে গণপিটুনিতে অন্তত ১১৯ জন নিহত ও ৭৪ জন আহত হয়েছেন। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ১০ বছরে গণপিটুনিতে ৭৯২ জন প্রাণ হারিয়েছেন। জাতিসংঘের মানবাধিকারসংক্রান্ত বৈশ্বিক ঘোষণা অনুযায়ী মন জাস্টিসের কারণে মানবাধিকারের বড় লঙ্ঘন হয়।
জুলাই বিপ্লব পরবর্তী দেশের জনগণের প্রত্যাশা ছিল জানমালের নিরাপত্তা, বৈষম্যহীনতা, দুর্নীতিমুক্ত, ন্যায়ভিত্তিক সমাজের। সেই প্রত্যাশা একটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে, এ প্রশ্ন দেশবাসীর। একদিকে জনআকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থতা, অন্যদিকে চলছে দেদার মব জাস্টিস। মব সৃষ্টির মাধ্যমে যে অরাজকতা চলছে দেশে, এতে আমাদের আইনশৃঙ্খলার ওপর যেমন মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে, তেমনি বহির্বিশ্বের বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ন হচ্ছে। মব জাস্টিস রুখতে সরকারের কঠোরতা বিশেষ প্রয়োজন। মবের ফলে সৃষ্ট হত্যাকাণ্ড ও অন্যান্য অপরাধ সংঘটনের পেছনে জড়িতদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনা এবং আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের বিকল্প নেই।
প্রভাষক, গৌরীপুর মহিলা কলেজ, ময়মনসিংহ
