ইরানের হাতে আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র!
ইউসেফ রামাজানি
প্রকাশ: ৩১ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
খোররামশহর-৫ ক্ষেপণাস্ত্র। ছবি: সংগৃহীত
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
সম্প্রতি ইরানের সম্ভাব্য আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ‘খোররামশহর-৫’ নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জল্পনা-গুঞ্জন বেড়েছে, যা ইঙ্গিত করছে ইরান হয়তো শিগগিরই সেই ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হতে চলেছে, যাদের নিজস্ব ICBM বা আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক মিসাইল রয়েছে। মিডিয়ায় প্রচারিত একাধিক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, খোররামশহর-৫-এর পাল্লা প্রায় ১২,০০০ কিলোমিটার, গতিবেগ মাখ ১৬ এবং এটি ২ টন ওজনের ওয়ারহেড বহন করতে সক্ষম। এ তথ্যগুলো যদিও সরকারিভাবে নিশ্চিত করা হয়নি, তথাপি এগুলোর সামরিক গুরুত্ব অস্বীকার করা যাচ্ছে না।
অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সামরিক অগ্রগতির তুলনায় এ ক্ষেপণাস্ত্র সম্পর্কিত তথ্য প্রকাশ হয়েছে অপ্রচলিত ও অনানুষ্ঠানিক উৎস থেকে। কিছু সংবাদমাধ্যম আগের খোররামশহর-৪ পরীক্ষার ভিডিও ব্যবহার করে ভ্রান্তভাবে নতুন পরীক্ষার দাবি করে। তবে ক্ষেপণাস্ত্রটির প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে কিনা, তা এখনো পুরোপুরি অস্বীকারও করা যাচ্ছে না।
ইরানের পূর্বঘোষিত অবস্থান
২০১৫ সাল থেকে ইরানের জ্যেষ্ঠ নেতারা বারবার জানিয়েছেন, দেশটির ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি কেবল প্রতিরক্ষামূলক উদ্দেশ্যে এবং এর পাল্লা সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে ২,০০০ কিলোমিটারে। এ অবস্থান বারবার পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে।
ইসলামি বিপ্লবী গার্ডের (আইআরজিসি) পদস্থ ব্যক্তিরাও অতীতে জানিয়েছেন, ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ এবং মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটিগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য বিদ্যমান ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতাই যথেষ্ট। তবে সাম্প্রতিক ভূরাজনৈতিক পরিবেশ, বিশেষ করে ইসরাইল-আমেরিকার ‘অকারণ আগ্রাসনের’ পরিপ্রেক্ষিতে ইরান তার দীর্ঘদিনের নীতিগত অবস্থান পুনর্বিবেচনার পথে যেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কী
আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হলো এমন একটি সুদূরপাল্লার গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্র, যার ন্যূনতম পাল্লা ৫,৫০০ কিলোমিটার। এতে একাধিক পরমাণু বা প্রচলিত ওয়ারহেড সংযুক্ত করা যায়। কিছু উন্নত ICBM-এর পাল্লা ১৬,০০০ থেকে ১৮,০০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে। এগুলো সাধারণত দুই বা তিন ধাপে বিভক্ত হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে বায়ুমণ্ডলের বাইরে গিয়ে স্পেস আর্কে চলে যায়। গতি কখনো মাখ ২০+ (২৪,০০০ কিমি/ঘণ্টা) ছাড়িয়ে যায় এবং এরা একাধিক ওয়ারহেড বা বিভ্রান্তিকর ডিকয় বহন করতে পারে। এর লক্ষ্যবস্তুতে পতনের সময় ওয়ারহেডগুলো ভীষণ উচ্চগতি এবং তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে। এটি নির্ভুলভাবে লক্ষ্যে আঘাত করার জন্য জিপিএস এবং ইনর্শিয়াল নেভিগেশন ব্যবস্থার সাহায্য নেয়। পূর্ণ পাল্লায় একটির গড় ফ্লাইট সময় মাত্র ৩০-৪০ মিনিট। ICBM সাধারণত কৌশলগত পারমাণবিক ত্রিভুজের (nuclear triad) অংশ হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
খোররামশহর-৫ : সম্ভাব্য বৈশিষ্ট্যগুলো
বিশেষ সূত্রের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, খোররামশহর-৫ একটি ICBM, যেটির পাল্লা ১২,০০০ কিমি পর্যন্ত হতে পারে; যা যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ডকে স্পর্শ করতে সক্ষম! এটি খোররামশহর সিরিজের চতুর্থ সংস্করণের তুলনায় অনেক এগিয়ে, যেখানে পূর্ববর্তী সংস্করণগুলোর সর্বোচ্চ পাল্লা ছিল আনুমানিক ৪,০০০ কিমি। অন্যান্য ব্যালিস্টিক বাহক যেমন সিমোরঘ বা সোরোশ-১/২, যাদের মূলত সিভিলিয়ান রকেট হিসাবে পরিকল্পনা করা হয়েছে, তাদের পাল্লা বাড়ালেও তারা যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ধীরগতির হওয়ার কারণে সেনাবাহিনীর প্রথম সারির অস্ত্র হিসাবে বিবেচ্য নয়।
খোররামশহর-৫-এর মাখ ১৬ গতির বলে দাবি করা হয়েছে, যা ICBM-এর জন্য আদর্শ। এ ধরনের গতি সামলাতে গেলে পুনঃপ্রবেশযানের (re-entry vehicle) উপাদানগুলোকে চরম তাপ ও চাপ মোকাবিলা করতে হয়, যা ইরান আগেই ফাত্তাহ হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার মাধ্যমে সক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, এ ক্ষেপণাস্ত্রের ওয়ারহেডের ধারণক্ষমতা প্রায় ২ টন, যা যুক্তরাষ্ট্রের কিছু উন্নত বাঙ্কার-বাস্টার বোমার সমপর্যায়ের বলে দাবি করা হচ্ছে। অবশ্য পাল্লা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ওয়ারহেডের ওজন সাধারণত হ্রাস পায়, তাই এ হিসাবটি স্পষ্ট নয়।
২০২৫ সালের জুনে ইরানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আজিজ নাসিরজাদেহ জানিয়েছেন, হাইপারসনিক গতিতে ২ টন ওজনের ওয়ারহেডের সফল পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। যদিও তিনি তা ICBM নয়, বরং মধ্যপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ‘এমাদ’ ও খোররামশহর সিরিজে ব্যবহারের পরিপ্রেক্ষিতে উল্লেখ করেন।
যদিও খোররামশহর-৫ সম্পর্কিত তথ্য সম্পর্কে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়নি, তথাপি এর সম্ভাব্য সক্ষমতা ও পরিসর আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা এবং আঞ্চলিক ভারসাম্য নিয়ে নতুন করে আলোচনার দরজা খুলে দিয়েছে।
ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি যদি আন্তঃমহাদেশীয় ধাপে উন্নীত হয়, তবে তা শুধু দেশটির প্রতিরক্ষা সক্ষমতার নয়, বরং সামগ্রিক কৌশলগত অবস্থানের নতুন অধ্যায় সূচিত করতে পারে।
প্রেস টিভি থেকে ভাষান্তর : সাইফুল খান
ইউসেফ রামাজানি : ইরানি বিশ্লেষক
