Logo
Logo
×

দৃষ্টিপাত

বরফে ঢাকা নরক, কাশ্মীরের ইতিহাস শুধুই দখল আর প্রতারণার

জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান

জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান

প্রকাশ: ২৫ আগস্ট ২০২৫, ১২:৫৬ পিএম

বরফে ঢাকা নরক, কাশ্মীরের ইতিহাস শুধুই দখল আর প্রতারণার

কাশ্মীর—হিমালয়ের কোলে স্বর্গের মতো এক উপত্যকা, যেখানে শালগাছের ছায়ায় জন্মেছিল কবিতা, আর ডাল হ্রদের জলে প্রতিফলিত হতো ভালোবাসার গল্প। অথচ সেই স্বর্গ আজ পৃথিবীর ইতিহাসে রক্তাক্ত প্রতারণার প্রতীক। 

কাশ্মীরের মাটিতে জন্ম নেয়নি শুধু সৌন্দর্য, জন্ম নিয়েছে সাম্রাজ্যের ষড়যন্ত্র, ধর্মের নামে বিভাজন, আর এক দীর্ঘ প্রতিরোধের ইতিহাস। 

ষোড়শ শতাব্দীতে মোগল সম্রাট আকবর যখন কাশ্মীর দখল করলেন, তখন থেকেই শুরু হলো বহিরাগতদের পদচিহ্নে উপত্যকার ক্ষতচিহ্ন। পরে আফগান আর শিখ শাসন এর বুক চিরে গেল। কিন্তু ১৮৪৬ সালের আমৃতসর চুক্তি এই ইতিহাসকে দিল এক অবিস্মরণীয় কলঙ্ক। ব্রিটিশরা মাত্র সাড়ে সাত মিলিয়ন রুপির বিনিময়ে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীরকে বিক্রি করে দিল ডোগরা শাসক গুলাব সিংয়ের হাতে। স্বাধীনতার স্বপ্ন তখনই শেকলবন্দি হলো। 

১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির সময় কাশ্মীর দাঁড়ালো ইতিহাসের সবচেয়ে জটিল সন্ধিক্ষণে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ পাকিস্তানের সঙ্গে মিলনের স্বপ্ন দেখছিল, অথচ হিন্দু মহারাজা হরি সিং চাইলেন নিরপেক্ষ থাকতে। 

পাকিস্তানপন্থী উপজাতিদের আক্রমণে মহারাজা দিল্লির দ্বারস্থ হলে স্বাক্ষরিত হলো Instrument of Accession (অ্যাকসেশন দলিল)—কাশ্মীর ভারতের সঙ্গে যুক্ত হলো, শর্ত ছিল গণভোট হবে। জাতিসংঘও সেই প্রতিশ্রুতি মেনে নিল। কিন্তু সেই গণভোট আজও হয়নি। প্রতিশ্রুতির এই প্রতারণাই পরিণত হলো এক অবিরাম রক্তক্ষয়ী সংঘাতের মূল। 

পরবর্তী ইতিহাস হলো শুধু যুদ্ধ আর দখলের গাথা। ১৯৪৭, ১৯৬৫, ১৯৭১—তিন দফা ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ কাশ্মীরকে পরিণত করল রক্তস্নাত প্রান্তরে। ১৯৮৯ সালে শুরু হলো সশস্ত্র বিদ্রোহ, যখন তরুণেরা স্বাধীনতার স্বপ্নে হাতে তুলে নিল বন্দুক। তখন থেকে কাশ্মীর হলো বিশ্বের সবচেয়ে সামরিকীকৃত ভূখণ্ড। 

সেনাদের বুটের নিচে চাপা পড়ল গান, পেলেটগানের আঘাতে অন্ধ হলো শিশুর চোখ, হারিয়ে গেল হাজারো কিশোর-যুবক। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো বারবার বলেছে, কাশ্মীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ভয়াবহ প্রতীক। 

২০১৯ সালের আগস্টে ভারতের বিজেপি সরকার কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নিল সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৭০ বিলোপ করে। হঠাৎ রাতারাতি কাশ্মীর হারাল তার পরিচয়, পতন ঘটল তার সীমিত স্বায়ত্তশাসনের। হাজার হাজার সেনা মোতায়েন করা হলো, ইন্টারনেট অন্ধকারে নিমজ্জিত হলো, রাজনৈতিক নেতাদের বন্দী করা হলো। 

আল-জাজিরা এই দিনটিকে বলেছিল “সবচেয়ে অন্ধকার দিন”। উপত্যকা তখন সত্যিই হয়ে উঠল এক বরফে ঢাকা নরক। 

আজকের কাশ্মীর আরও ভিন্নভাবে বন্দি। জমি ও সম্পদ চলে যাচ্ছে বহিরাগতদের হাতে, সংস্কৃতি মুছে যাচ্ছে পরিকল্পিত সামাজিক প্রকৌশলে। স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে রুদ্ধ করার জন্য ভারত যে নির্মম নীতি চালাচ্ছে, তার প্রতিধ্বনি দ্য গার্ডিয়ান, ওয়াশিংটন পোস্ট, এবং আল জাজিরার সম্পাদকীয়তে ক্রমাগত শোনা যাচ্ছে। অথচ আন্তর্জাতিক মহল চুপ, কারণ কাশ্মীরের রক্ত তাদের কূটনৈতিক স্বার্থের চেয়ে হালকা। 

২০২৫ সালের সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার পর নতুন করে উত্তেজনা ছড়িয়েছে। ভারত পাকিস্তানকে দায়ী করছে, পাকিস্তান বলছে ভারতীয় দমননীতিই এর কারণ। দক্ষিণ এশিয়ার দুই পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্রের টানাপোড়েন যে কোনো মুহূর্তে রূপ নিতে পারে বৈশ্বিক বিপর্যয়ে। 

কিন্তু যুদ্ধ-দমন-সাম্রাজ্যবাদ ছাপিয়ে একটাই প্রশ্ন আজও অনুত্তরিত—কাশ্মীরিরা কি কোনোদিন তাদের ভাগ্য নিজেরা নির্ধারণ করার সুযোগ পাবে? এ প্রশ্নের উত্তর চাপা পড়ে আছে বন্দুকের নলের আড়ালে। 

কাশ্মীর আমাদের শেখায়—স্বর্গকেও দখলদারিত্ব নরকে পরিণত করতে পারে। কাশ্মীরের প্রতিটি বরফকণা, প্রতিটি পাহাড় আর প্রতিটি নদী যেন ফিসফিস করে বলে—স্বাধীনতার স্বপ্ন বন্দুক দিয়ে চেপে রাখা যায় না। ইতিহাস সাক্ষী, প্রতারণা একদিন ভেঙে পড়ে, আর প্রতিটি জাতির স্বপ্ন একদিন মুক্ত আকাশ খুঁজে নেয়।

তথ্যসূত্র: আল জাজিরা, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, রয়টার্স, অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি),ওয়াশিংটন পোস্ট

লেখক: শিক্ষার্থী, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, কায়রো, মিশর

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম