Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

ঘরে-বাইরের প্রবল সংকটে ভারত

Icon

গৌতম দাস

প্রকাশ: ৩১ আগস্ট ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ঘরে-বাইরের প্রবল সংকটে ভারত

গত দুদিন হলো, যুক্তরাষ্ট্র-ভারত মানে ট্রাম্পের আমেরিকা আর মোদির ইন্ডিয়ার মধ্যে ‘যুদ্ধ’ তুঙ্গে উঠেছে। বিষয়টা হলো, ট্রাম্পের ভারতের ওপর ৫০ শতাংশ বাড়তি শুল্কারোপ কার্যকর শুরুর ইস্যু। মানে এতদিন যা ছিল প্রস্তুতি পর্ব, এবার সেটি পাগলা ট্রাম্প বাস্তবে শুরু করে দেখিয়েছেন! এর সঙ্গে শুরু হয়েছে বাকযুদ্ধ!

যেমন, ভারতের ওপর ট্রাম্পের নয়া শুল্কনীতি আরোপ কার্যকর হয়েছে ২৭ আগস্ট বা চলতি মাসের ২৭ তারিখ থেকে। আর এ ‘‘নতুন নিয়ম চালু হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় গণমাধ্যম ‘ব্লুমবার্গ’কে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্টের বাণিজ্য উপদেষ্টা পিটার নাভারো।’’

এ বাড়তি শুল্কারোপ কেন জায়েজ আর তা প্রমাণ করার জন্য ভারত (এখন কত খারাপ) আর মোদি আমেরিকার বিরুদ্ধে কী কী খারাপ কাজ করেছে এর বর্ণনা উল্লেখ করেছেন ট্রাম্পের এ বাণিজ্য উপদেষ্টা।

এ নিয়ে আনন্দবাজারের এক বর্ণনাও পাওয়া যাচ্ছে। সেটি হলো, ওই ‘ব্লুমবার্গ’ সাক্ষাৎকারে নয়াদিল্লিকে ‘একগুঁয়ে’ বলে তোপ দাগেন তিনি। পাশাপাশি, ইউক্রেন সংঘাতকে ‘মোদির যুদ্ধ’ বলেও উল্লেখ করেছেন নাভারো।

আমেরিকার চোখে ইউক্রেন যুদ্ধের শুরু থেকেই আমেরিকা রাশিয়ার পণ্য কেনাবেচা নিষিদ্ধ বা অবরোধপ্রাপ্ত বলে ঘোষণা করেছিল। সোজা কথায় রাশিয়ান তেল কেনাবেচা বন্ধ। ফলে, ভারতের কেনাটা অন্যায় ও অপরাধ আমেরিকার চোখে। এখন ভারত মনে করে, এমন তেল আমদানি-বাণিজ্য এটি তার নিজ বাণিজ্য সিদ্ধান্ত নেওয়ার ‘সার্বভৌম অধিকার।’ আর এর বিপরীতে আমেরিকার ট্রাম্প বা তার বাণিজ্য উপদেষ্টা নাভারো বলবেন বা মনে করেন, রাশিয়া/ভারতকে বাধা দেওয়াটাও তার অধিকার! সেই অধিকার ফলাতে ট্রাম্পের ভারতের ওপরে ৫০ শতাংশ শুল্কারোপ!

এমন পরিস্থিতিতে এটি অধিকারের তর্ক করে কোনো সমাধান আসবে না। বিশেষ করে সারা ভারতীয় অর্থনীতি আমেরিকায় রপ্তানি বন্ধ হওয়াতে যখন প্রবল ক্ষতিগ্রস্ত! তাই, ভারতের দরকার এখনই সমাধান!

আসলে প্রশ্নটা এখানে নয়। ২০০১ সালে বুশের ‘মুসলমান কোপানো’ শুরু হয়েছিল ‘ওয়ার অন টেররের’ নামে। আর এ ভারত তাতে খুবই খুশিতে হাততালি দিয়ে উঠেছিল, এতে চারদিকে নিজের ফায়দার সয়লাব দেখতে পেয়ে! আর সেই থেকেই আমেরিকার কোলে উঠে বসে গলা জড়াজড়ি করে ধরা কঠিন বন্ধু হয়ে উঠার শুরু ভারতের! সেসব কি এখন ইন্ডিয়ার মনে পড়ছে? পড়ছে না!

বরং পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর কূটনৈতিক জ্ঞানবুদ্ধি ফেলে রেখে এখন এ বাণিজ্য উপদেষ্টা নাভারোকে সামলাতে গেছেন এই বলে যে, মুসলমান ‘এই জাত’ মানে এই ‘এথনিক-জাত গোষ্ঠীটাই খারাপ’ একথা বলে! ট্রাম্পের সঙ্গে এখন পাকিস্তানের সম্পর্ক ভালো কেন? কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর? জয়শঙ্করের চোখে এই হলো, ট্রাম্পের মুসলমান প্রীতির নিদর্শন!

তাই জয়শঙ্কর ফিরিস্তি দিয়েছেন, মুসলমান রাষ্ট্রের সঙ্গে আমেরিকার সারা জীবন খাতির ছিল। তাই আমেরিকা এখন মোদি-জয়শঙ্করদের চোখে খুবই খারাপ দেশ! আর স্বভাবতই তাতে শীর্ষে এসেছে পাকিস্তানের নাম!

কিন্তু মোদি-জয়শঙ্করের মনে রাখা উচিত, ভারত-আমেরিকার যৌথ উদ্যোগে আইএসের সঙ্গে একালে সম্পর্ক রাখা, এটি কিন্তু আমরা ভুলিনি! বিশেষ করে আফগানিস্তানে আইএসের (খোরসান) সঙ্গে সম্পর্ক এবং স্যাবোটাজের যৌথ উদ্যোগগুলো! পাকিস্তানে চীনা ‘গোয়াদার অবকাঠামো প্রজেক্টে’ হামলা কিংবা সর্বশেষ বেলুচিস্তানে আস্ত একটা ‘প্যাসেঞ্জার-ট্রেন ছিনতাই’-এর মতো ঘটনা; এগুলো কীসের প্রমাণ? এ কাজে আমেরিকা-ভারতের যৌথ প্রযোজনায় ‘মুসলমান কোপানো’-এটি তো খুবই সুস্বাদু লেগেছিল মোদি-জয়শঙ্করের! এভাবে এ আমেরিকার হাত ধরেই এতদিন ফায়দা নিতে?

তাহলে এটি কেমন মোদি-জয়শঙ্করের মুসলমান ঘৃণার হিন্দুত্ববাদ? যেখানে আইএস (খোরসান) বা উইঘুরের বিদ্রোহী মুসলমান-এদের মোদি-জয়শঙ্করেরা নিজেদের অ্যালায়েন্স পার্টনার/বন্ধু হিসাবে কোলে তুলে নেয় কেমন করে? এটি কোন হিন্দুত্ববাদ?

যাই হোক, বোঝা যাচ্ছে, এতদিনের ভারত-আমেরিকার বিশেষ অ্যালায়েন্সের মাখন এরা দুপক্ষ মিলে খেয়ে গিয়েছিল অসুবিধা হয়নি; আর মুসলমান এ ‘এথনিক-জাত গোষ্ঠীটাই খারাপ’ বলে নিজেদের হীন কাজের সাফাই দিয়ে গেয়েছিল, যারা আজ সেই হিন্দুত্ববাদই বিপদে পড়ে গেছে; আমেরিকার সঙ্গে খাতিরদারি সব সম্পর্ক ভেঙেচুরে গেছে, এমনকি উলটা ঘটনাটা হলো, মোদি চীনের কোলে উঠে বসেছে! কেন?

কারণ, নাভারো বলেছেন, ইউক্রেন যুদ্ধ তো আসলে ছিল ‘মোদির যুদ্ধ’!

কিন্তু এটি মোদি-জয়শঙ্করের কেন এত লেগেছে? কারণ, এটি কূটনৈতিক বাতচিতের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা ঝগড়া-বাকযুদ্ধ নয়। এটি ভারতীয় অর্থনীতির বিশেষ করে রপ্তানি-বাণিজ্যের ভেঙে পড়ার সংকট! যা সরাসরি ভারতের ভাতের স্বার্থ! যেটি থেকে বের হতে, হিন্দুত্ববাদ বেচে মোদি-জয়শঙ্করেরা কোনো সমাধান বা উপায় বের করতে পারছে না! এমনই গভীর সংকট এটি!

প্রসঙ্গ দুই

এদিকে মোদির ঘরের বা অভ্যন্তরীণ ইস্যুতেও শান্তি নেই! একের পর এক অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে মোদির সরকার পর্যদুস্ত! যেমন, ভুয়া ভোটার লিস্ট ইস্যু! এটি আর এখন প্রমাণহীন বা প্রমাণ করতে হবে তারপর-এমন ইস্যু নয়! মোদি কোণঠাসা! তিনি এখন চেষ্টা করছেন এর দায় যতটা সম্ভব নির্বাচন কমিশনের ওপর চাপাতে!

ওদিকে এতদিন মোদির ভাড়াটে বিবিসি বাংলা এবার মোদিবিরোধী এক রিপোর্ট করেছে। মারাত্মক এ হেডলাইনটা দেখেন-‘ত্রুটিপূর্ণ ভোটার তালিকার নির্বাচনে জিতেই কি মোদি প্রধানমন্ত্রী।’ এটাই অনেক কিছু বলে দিচ্ছে। ভেতরের উপশিরোনাম-‘ভোট চুরির অভিযোগ, এসআইআর বিতর্ক’। আবার রাহুল গান্ধীর অভিযোগ থেকে উপশিরোনাম, ‘গুজরাট মডেলের ভোট চুরি’। আর সবচেয়ে মারাত্মক রাহুলের এসব অভিযোগের প্রতি ডিএমকে, সমাজবাদী পার্টি, আরজেডি, তৃণমূলের সমর্থন। এমনকি মুখ্যমন্ত্রী মমতার ভাতিজা তৃণমূল নেতা অভিষেক ব্যানার্জি ... দাবি করেছেন, ভোটার তালিকায়... কারেকশন ‘সেটা করতে হবে আর সেই প্রক্রিয়ার সূচনা হতে হবে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের মধ্যে দিয়ে’। মমতাও অনেক জায়গায় ভারত ভেঙে যাবে কিনা সেই সংশয়ের ইঙ্গিত জানিয়ে আজকাল কথা বলতে শুরু করেছেন। এসব শিরোনাম থেকেই পাঠক বুঝতেই পারছেন, কেমন অভ্যন্তরীণ সংকটে পড়েছে মোদি-অমিত শাহেরা!

ওদিকে দ্বিতীয় অভ্যন্তরীণ প্রসঙ্গ যেটা আরও বড় সংকটের-সেটা হলো, বিজেপি-আরএসএসের নেতাদের ‘পঁচাত্তর বয়সে পা দেওয়া’ বিতর্ক! মোদি ২০১৪ সালে নিয়ম এনেছিলেন, নেতাদের বয়স পঁচাত্তর হয়ে গেলেই প্রধান প্রধান পদ থেকে অবসরে যেতে হবে। এভাবে তিনি আদভানিসহ বড় নেতাদের সরিয়ে নিজে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। আর সেই নিয়মে পড়ে এখন তিনি নিজের ফ্যাসাদ এনেছেন। ওদিকে আরএসএসের প্রধান ভগবতও সেপ্টেম্বরে মোদির ছয় দিন আগে পঁচাত্তর বয়সে পা রাখবেন জানা যাচ্ছে।

বিজেপি-আরএসএস দ্বন্দ্বটা ২০২৪-এর নির্বাচনের সময় থেকে, তখন দ্বন্দ্ব মেটাতে না পেরে আরএসএসের সমর্থন ছাড়াই সেবার (২০২৪) বিজেপি একাই নির্বাচন করবে বলে মোদি-অমিত ঘোষণা দিয়ে নির্বাচন করেছিলেন। আর এখন মোদি অবসরে গেলে কে হবেন প্রধানমন্ত্রী-এ তর্কে মোদির প্রার্থী অমিত শাহ আর আরএসএসের প্রার্থী উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী! সর্বশেষ ২৮ আগস্ট এনডিটিভি আরএসএসের প্রধান ভগবতের রেফারেন্সে বলেছেন, তিনি কোনো পদত্যাগে যাচ্ছেন না; এসব নিয়ে তিনি কথা বলছেন না। আর এতে এ বক্তব্যের মানে করা হয়েছে যে, মোদি পদত্যাগ না করলে, তিনিও পদত্যাগ করবেন না।

ভারতের জন্য এটিও আরেক বিরাট সংকট! কেন?

বিজেপি-আরএসএস দ্বন্দ্বটা যে মূল থেকে, তা হলো, ১৯৪৭ সাল থেকেই একমাত্র হিন্দুত্ববাদ দিয়ে ভারতকে শাসন বা জবরদস্তিতে এক করে ধরে রাখা এক ভারত রাষ্ট্র, যেটা শুরু হয়েছিল-এটি শেষ দিনের দিকে যাচ্ছে। তথাকথিত ‘কেন্দ্রের শাসনের’ কথা বলে নেহেরু যেটা (সফট হিন্দুত্ববাদ দিয়ে) শুরু করেছিলেন, সেটা নেহেরুর ১৯৬৪ সালে মৃত্যুর পরে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত টিকতে পেরেছিল। পরের নরসীমার শাসন যেন বিজেপিকেই প্রস্তুত হয়ে আসার সময় দেওয়া। কাশ্মীরের খোলাখুলি ভোট চুরি, যা কাশ্মীরের রাজনীতিকে সশস্ত্র পথে পাঠিয়ে এবার জঙ্গিবাদের অভিযোগ (মুসলমান কোপানো) শুরু করা, ২. বাবরি মসজিদ ধ্বংস, ৩. বাজপেয়ির সীমা পাড় কী আতঙ্কবাদ বলে পাকিস্তানকে দায়ী করে চোটপাট ৪. আর এরপর থেকেই ক্রমশ উগ্র হিন্দুত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করে মোদির শাসন দিয়ে ভারত এক করে ধরে রাখার যে প্রচেষ্টা চলতি শতকে শুরু হয়েছিল, সেটিও এবার যেন ২০২৫ সালে এসে মুখ থুবড়ে পড়তে যাচ্ছে।

মূল কথাটা হলো, এবার সব ধরনের হিন্দুত্ববাদের শেষ হওয়া আসন্ন সম্ভবত! এ কঠিন ইঙ্গিত, এটাই মুখ্য হয়ে উঠা শুরু করেছে ভারতের চারদিকে!

গৌতম দাস : রাজনৈতিক বিশ্লেষক

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম