বিএনপির আবির্ভাব কি অনিবার্য ছিল
সালাহউদ্দিন আহমেদ রায়হান
প্রকাশ: ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৩:৪১ পিএম
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
‘পঁচাত্তর পরবর্তী উথাল-পাথাল দিনগুলোতে জিয়াউর রহমান শক্ত হাতে লাগাম টেনে ধরেছিলেন এবং দেশে স্থিতিশীলতা ফিরে এসেছিল— জনমনে এমন একটা ধারণা জন্মে। মুদ্রাস্ফীতিও কমে আসছিল এবং পরপর কয়েক বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হওয়ার কারণে কৃষক গোলায় ফসল তুলতে পেরেছিল। মানুষ স্থিতাবস্থা চেয়েছিল। এই প্রেক্ষাপটেই জিয়াউর রহমানের একটা দেশপ্রেমিক ও জাতীয়তাবাদী ভাবমূর্তি গড়ে ওঠে। তার গড়া বিএনপি দাঁড়ানোর মতো অনুকূল জমি পায়। পঁচাত্তর- পরবর্তী রাজনৈতিক শূন্যতার মধ্যে বিএনপির মতো একটি দলের আবির্ভাব অনিবার্য হয়ে উঠেছিল।’ — বিএনপি সময়-অসময়, মহিউদ্দিন আহমদ। পৃষ্ঠা-১৭১
শেখ মুজিবুর রহমান চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে কেবল গণতন্ত্রকেই হত্যা করেননি, নিজেকেও হত্যা করেছিলেন। স্বাধীনতা-পরবর্তী শেখ মুজিবের অবয়ব, অপশাসনের রুদ্রমূর্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্রের ব্যাবস্থা করেন। পত্রিকার সার্কুলেশন অবারিত করে দেন। মানুষ ফিরে পায় তার সামাজিক, গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক অধিকার।
একাত্তর ছিল আমাদের জাতীয় মুক্তি ও স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। এই স্বাধীন দেশের জন্য এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম করতে হয়েছে। বহু মানুষের প্রাণ ও নারীদের সম্ভ্রবের বিনিময়ে এ দেশ আমরা পেয়েছিলাম। কিন্তু স্বাধীন দেশে গণতন্ত্রহীনতা ও চরম অপশাসন মানুষের মনোজগতে তখনকার শাসকগোষ্ঠীর দিকে এক তীব্র ক্ষোভের জন্ম দেয়। জিয়াউর রহমানের প্রণীত ১৯ দফা এবং বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ মানুষের মনে নতুন প্রাণের সঞ্চার করে।
খাল খনন কর্মসূচি, জনগণের সার্বিক কল্যাণ ও আর্থ সামাজিক উন্নয়নের জন্য জিয়াউর রহমানের প্রণীত ১৯ দফা বর্তমান বাংলাদেশেও সমভাবে প্রাসঙ্গিক। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে তিনি বলেছেন সার্বিক জাতীয়তাবাদ— বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডে যারাই বসাবাস করে তারা সবাই বাংলাদেশি। একটি রাজনৈতিক শক্তির প্রয়োজন ছিল দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য। তাই প্রথমে জাগদল, তারপর জাতীয়াতাবাদী ফ্রন্ট হয়ে ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপি প্রতিষ্ঠা করলেন জিয়াউর রহমান।
তিনিই একমাত্র সরকার প্রধান, যিনি বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে হেঁটেছেন মাইলের পর মাইল, মানুষের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন, মানুষকে নানাভাবে উদ্দীপ্ত করেছেন, উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে গণমানুষকে সম্পৃক্ত করেছেন। জিয়াউর রহমান তথা বিএনপির খাল খনন কর্মসূচি এক অভিনব উদ্যোগ ছিল, যা কৃষিতে বিপ্লব সৃষ্টি করে।
তার সততা ছিল সর্বজনবিদিত— যা রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির সবচেয়ে বড় সম্পদ। এ সম্বন্ধে মওদুদ আহমদ বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট জিয়া মিতব্যয়ী ব্যক্তি ছিলেন। ভোগবিলাস একেবারেই পছন্দ করতেন না। থাকা খাওয়া এবং চলাফেরার ব্যাপারে একেবারেই সাধারণ জীবনযাপন করতেন। বঙ্গভবনে খেতে দাওয়াত দিলে আমরা হয় বাড়ি থেকে আগে খেয়ে যেতাম আর সেটা না হলে ফিরে এসে আবার কিছুটা খেতাম। খুব সাধারণ মেনু থাকত: ডাল, রুটি, সবজি আর বড়জোর একটু মাছ ও মাংস। রাষ্ট্রীয় কোনো জৌলুস তিনি পছন্দ করতেন না। প্রেসিডেন্ট হলেও নিজের যাতায়াতের জন্য ১৩০০ সিসির একটা সস্তা টয়োটা করোলা গাড়ি ব্যাবহার করতেন’। -রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমান: শফিক রেহমান।
বিএনপি’কে তিনি তৃণমূলে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। স্থানীয় সরকারকে আরও শক্তিশালী করার জন্য গ্রাম সরকারব্যাবস্থা উদ্ভাবন করেছিলেন। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে মানুষের গ্রাম থেকে শহরে আসার প্রবণতা কমে গিয়েছিল। জিয়াউর রহমান রাষ্ট্র শাসনের সময় জনপ্রশাসনে সামরিক ও বেসামরিক উভয় শ্রেণির মানুষের সম্মিলন ঘটিয়েছিলেন। খুব দ্রুত নীতিনির্ধারণী স্বিদ্ধান্ত নেওয়ার সহজাত গুণ ছিল তার।
তরুণদেরকে তিনি বিশেষভাবে রাজনীতিতে এবং দেশের উন্নয়ন কাজে সম্পৃক্ত হওয়ার জন্য উৎসাহিত করতেন। বিভিন্ন জায়গায় খাল খনন কর্মসূচি প্রদর্শনের জন্য ছাত্র-ছাত্রীদের পাঠাতেন—তাদের মতামত জানতে চাইতেন। মেধাবী শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের নিয়ে সমুদ্র ভ্রমণে যেতেন। এরকম নানামুখী জনবান্ধব উদ্যোগ বিএনপির প্রাসঙ্গিকতাকে অনিবার্য করে তোলে।
জিয়াউর রহমান বিএনপির পররাষ্ট্রনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনেন। আরব দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে বিশেষ প্রচেষ্টা চালান এবং সফল হন। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ ১৯৭৯ সালে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যপদ লাভ করে। জিয়াউর রহমান ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইরান-ইরাক যুদ্ধে আরবিটার (Arbiter) হিসেবে কাজ করেন। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সার্বিক যোগাযোগ এবং বিশ্ব পরিমণ্ডলে মর্যাদাশীল হওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি ১৯৮০ সালে সার্ক প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার প্রেসিডেন্ট জিয়াকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানান।
স্বাধীন বাংলাদেশে বিএনপির অবদান অপরিসীম। তবে জিয়াউর রহমানকে হত্যা করার পর গণতন্ত্র পুনরায় স্বৈরশাসকের দ্বারা পদদলিত হয়। রাষ্ট্রীয় প্ররোচনায় বিএনপিকে তিন ভাগ করা হয়। মূল ভাগের নেতৃত্বে আসেন বেগম খালেদা জিয়া। তিনি ১৯৮৪ সালে বিএনপির চেয়ারপার্সন নির্বাচিত হন। গণতন্ত্রহীন দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার জন্য তিনি দীর্ঘ ৯ বছর স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম করেন। গুম হন, গৃহবন্দী হন; কিন্তু গণতন্ত্রের জন্য, মানুষের অধিকারের জন্য নিজের অবিচল অবস্থান থেকে কখনো নড়ে যাননি। প্রলোভনকে দূরে সরিয়ে সততাকে আলিঙ্গণ করে বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়েছেন। ১৯৮৬ সালের আঁতাতের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেননি। আওয়ামী লীগ সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বেঈমানির পরিচয় দিলেও বেগম জিয়া ছিলেন আপসহীন। তার এই সততার সুমিষ্ট ফল, বিএনপি দল হিসেবে পায় ১৯৯১ সালে।
বিএনপিকে বলা হতো সামরিক ছাউনি থেকে জন্ম নেওয়া দল। এর কোনো সামাজিক এবং গণতান্ত্রিক ভিত্তি নেই। অনেক রাজনৈতিক দলই মনে করতেন জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বিএনপিও নিঃশেষ হয়ে যাবে। কিন্তু খালেদা জিয়ার সময় তা ভুল প্রমাণিত হয়। সবার চোখকে কপালে তুলে ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি সরকার গঠন করে। বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হন। শুধু তাই নয়, বিএনপি সরকারে এসেই সর্বপ্রথম রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থা থেকে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন করে।
জিয়াউর রহমানের মতো খালেদা জিয়াও যে খুব সাধারণ জীবনযাপন করতেন বা করেন তার একটি ছাপ পাওয়া যায় মহিউদ্দিন আহমদের বর্ণনায়—‘আমি পর্দা ঠেলে তাঁর কামরায় ঢুকলাম। ছোট একটা ঘর। মেঝেতে কার্পেট নেই, সাধারণ একটা ম্যাট। আসবাব বলতে শুধু মাঝারি আকারের সেক্রেটারিয়েট টেবিল। দেওয়ালের দিকে একটি চেয়ারে বসে আছেন চেয়ারপারসন। উল্টোদিকে তিনটি চেয়ার সাক্ষাৎপ্রার্থীদের জন্য। এক কোণে বিশ ইঞ্চি মাপের একটা টেলিভিশন। সম্ভবত সময় কাটাতে তিনি এটা দেখেন।
এটি একটি বাসাবাড়ি। তারই একটি বেডরুম হয়তো এটি, যেটাকে একটা অফিস রুম হিসেবে সাজানোর চেষ্টা হয়েছে। খুবই নিরাভরণ এবং অনাড়ম্বর। নেতাদের অফিস বা বসার জন্য যেরকম সিংহাসন দেখি, এ ঘরে সেসব নেই।আগে শুনেছিলাম, তিনি খুব বিলাসী জীবনযাপন করেন। এই ঘরে তার কোন চিহ্ন দেখলাম না।’ খালেদা: মহিউদ্দিন আহমদ, পৃষ্ঠা ১১।
খুব সাধারণ ভাবে চিন্তা করলে বিএনপি নেতৃত্ব সবসময়ই সরলতাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। বিএনপিকেও গড়ে তুলেছেন একটি লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি হিসেবে, যার ভিত্তিই হচ্ছে গণমানুষ ও গণতন্ত্র।
দেশের যা কিছু ভালো তার সবকিছুর সঙ্গে বিএনপির নাম জড়িয়ে আছে। এর মধ্যে সবার আগে গণতন্ত্র। মানুষের মৌলিক অধিকারগুলোর নিশ্চয়তা বিধানে বিএনপি সবসময়ই ছিল অবিচল। ১/১১ সরকার এবং পরে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকার বিএনপিকে ধ্বংস করার জন্য রাষ্ট্রীয়, দলীয় সব ধরনের প্রচেষ্টা চালায়। নির্বাচন ব্যবস্থাকে কুক্ষিগত করে মানুষের ভোটাধিকার হরণ করে। বিএনপি পুনরায় ভোটের অধিকারের লড়াইয়ে নামে। ২০১৮ সালে মিথ্যা মামলায় ফরমায়েশি রায় দিয়ে বেগম জিয়াকে জেলে পাঠায় ফ্যাসিস্ট সরকার। দলের একটি চরম ক্রান্তিলগ্নে হাল ধরেন তারেক রহমান। নেতৃত্ব দেন দৃঢ়তার সঙ্গে।
স্বাধীন বাংলাদেশে বিএনপি তার অনিবার্যতা বার বার প্রমাণ করেছে। দলের কর্মসূচি ছিল জনবান্ধব, দলের নেতৃত্ব ছিল সৎ, দলের কর্মীরা ছিল অবিচল। তাই বিএনপিকে নিঃশেষ করা যায় নি। বরং বিএনপি দিনে দিনে শাণিত হয়েছে— যুগের পর যুগ, প্রজন্মের পর প্রজন্ম টিকে থাকার জন্য।
লেখক : প্রকৌশলী


