Logo
Logo
×

দৃষ্টিপাত

গণতন্ত্রের সংকট ও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ

ড. শামীম হামিদী

ড. শামীম হামিদী

প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৬:৪৫ পিএম

গণতন্ত্রের সংকট ও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ

রাজনীতির ইতিহাস বারবার প্রমাণ করেছে, জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে উপেক্ষা করে কোনো শাসকগোষ্ঠী দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকতে পারেনি। ক্ষমতা ধরে রাখতে দমননীতি যতই কঠোর হোক, জনগণের ইচ্ছাশক্তি শেষ পর্যন্ত তার চেয়ে প্রবল হয়ে ওঠে । ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থান তারই প্রমাণ, যেখানে সাধারণ মানুষ, ছাত্রসমাজ ও নাগরিক শক্তি নীরবতার দেয়াল ভেঙে নিজেদের অধিকার পুনরুদ্ধারে সোচ্চার হয়। এটি শুধু সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ নয়, বরং দীর্ঘদিনের ক্ষোভ ও অবদমিত চেতনার বিস্ফোরণ, যা নতুন রাজনৈতিক অধ্যায়ের সূচনা করেছে।

গণতন্ত্রের মূল শর্ত হলো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের অবাধ সুযোগ এবং কার্যকর বিরোধী শক্তির উপস্থিতি। রাজনৈতিক চিন্তাবিদ রবার্ট ডাল তার Polyarchy তত্ত্বে নাগরিক অংশগ্রহণ এবং বিভিন্ন মত ও স্বার্থের প্রতিনিধিত্বকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অপরিহার্য শর্ত হিসেবে তুলে ধরেছেন। গত ১৬ বছরের শাসনকাল দেখিয়েছে, নির্বাচনী প্রহসন, বিরোধী দলের ওপর দমননীতি, বিচারব্যবস্থার সীমিত স্বাধীনতা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দলীয়করণ—সব মিলিয়ে গণতন্ত্র নিছক আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়েছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের কিছু সূচক থাকলেও তা জনগণের জীবনে সুষমভাবে প্রতিফলিত হয়নি। অবকাঠামোগত প্রকল্প ও বৈদেশিক ঋণনির্ভর উন্নয়ন সাধারণ মানুষের কল্যাণে রূপান্তরিত না হয়ে বরং ঋণের বোঝা ও বৈষম্য বাড়িয়েছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্টগুলোও বারবার দেখিয়েছে, বৃহৎ প্রকল্পগুলোতে লুটপাট ও দুর্নীতি গভীরভাবে প্রোথিত।

ফ্যাসিবাদী রাজনীতির প্রভাব পড়েছে শিক্ষা ও সংস্কৃতিতেও। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দলীয় প্রভাব, স্বাধীন মতপ্রকাশের সীমাবদ্ধতা এবং ইতিহাস বিকৃতির প্রবণতা তরুণ সমাজকে নিয়ন্ত্রিত দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে আবদ্ধ করছে। এভাবে নাগরিক চেতনা ধীরে ধীরে ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে। অথচ স্যামুয়েল হান্টিংটন Political Order in Changing Societies গ্রন্থে দেখিয়েছেন, রাজনৈতিক শৃঙ্খলা তখনই টেকসই হয়, যখন শিক্ষা ও প্রতিষ্ঠান জনগণকে সক্রিয় নাগরিক রূপে গড়ে তোলে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এর উল্টো বাস্তবতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

তবে জুলাইয়ের গণজাগরণ স্পষ্ট করে দিয়েছে—জনগণ স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধারে মানসিকভাবে প্রস্তুত এবং রাজনৈতিকভাবে সক্রিয়। কিন্তু প্রশ্ন রয়ে যায়: এই জনঅভ্যুত্থান কি একটি দীর্ঘমেয়াদি গণতান্ত্রিক রূপান্তরের সূচনা, নাকি তা সাময়িক ক্ষোভের বিস্ফোরণ হয়েই থেমে যাবে? ইতিহাস আমাদের শেখায়, কোনো আন্দোলন তখনই স্থায়ী ও ফলপ্রসূ হয়, যখন তা একটি সুসংগঠিত, আদর্শনির্ভর এবং কার্যকর রাজনৈতিক বিকল্প শক্তিতে পরিণত হয়। জনতার আবেগ যদি কাঠামোগত সংগঠনে রূপ না নেয়, তবে তা দ্রুতই নিঃশেষ হয়ে যায় অথবা ক্ষমতাসীনদের দমননীতির কাছে পরাজিত হয়।

বাংলাদেশের জন্য এখন জরুরি একটি গণতান্ত্রিক বিকল্প শক্তি গঠন, যা প্রতিশোধমূলক রাজনীতি নয় বরং ভারসাম্যপূর্ণ রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরি করবে। এ শক্তি হতে হবে দেশভিত্তিক ও মধ্যমপন্থী, যা বিদেশি স্বার্থের প্রভাব থেকে মুক্ত থেকে জাতীয় সার্বভৌমত্বকে অগ্রাধিকার দেবে। শক্তিশালী নাগরিক সমাজ, স্বাধীন গণমাধ্যম, কার্যকর বিরোধী শক্তি ও তরুণদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া গণতন্ত্রের পুনর্জাগরণ সম্ভব নয়।

অতএব ভবিষ্যৎ শুধু রাজনৈতিক পরিবর্তনের ওপর নির্ভর করছে না; বরং একটি ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র কাঠামো ও নাগরিক চেতনার জাগরণ অপরিহার্য। জনগণের ইচ্ছাই যে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত—এই সত্যকে প্রতিষ্ঠানগত রূপ দিতে না পারলে গণতন্ত্র বারবার হোঁচট খাবে। এখনই সময় টেকসই গণতান্ত্রিক কাঠামো গড়ে তোলার, যেখানে ক্ষমতার মালিকানা দলীয় শাসকের হাতে নয়, জনগণের হাতে ন্যস্ত হবে।

লেখক: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম