Logo
Logo
×

বিচ্ছু

একটি সংসারের গল্প

Icon

শফিক হাসান

প্রকাশ: ২২ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

একটি সংসারের গল্প

নিজের কানও মাঝেমধ্যে বেইমানি করে বসে। বাতাসের গতিপথ পালটে দিয়ে ভুলভাল কথা শোনায়। তামান্নাকে আবার বললাম, ‘বুঝতে পারছি না, কী বলেছ?’

‘আম্মা প্রায়ই রোগে ভুগছেন। কটা দিনইবা বাঁচবেন। আমাদের বাসায় এনে কিছু দিন রাখ।’

‘তোমার আম্মা নাকি আমার আম্মা? কার কথা বলছ?’

এমন কথায় তামান্না রেগে গেল কেন বুঝি না। গলা চড়িয়ে বলল, ‘বিয়ের পর তোমার-আমার বলে তো আলাদা কিছু থাকে না! আমাদের আম্মার কথা বলছি।’

কথার ম্যারপ্যাঁচে ঝালিয়ে নিলাম, শাশুড়ি-আম্মা নয়, তামান্না বলছে আমার গর্ভধারিণীর কথাই। প্রথমে খুশি হলেও পরক্ষণে বেজার ভঙ্গিতে বললাম, ‘আম্মা বাসে উঠতে পারেন না। বমি করেন। প্রাইভেট কার ভাড়া করে আনতে হবে।’

‘আনবে। সমস্যা কী?’

‘এতগুলো টাকা গচ্ছা দেব?’

‘ছি, রিফাত। বাবা-মায়ের পেছনে ব্যয় করলে ওটাকে গচ্ছা বলে না। সব সন্তান বাবা-মায়ের জন্য কিছু করার সুযোগ পায়?’

কথা সত্য। কিন্তু থাকবেন কোথায়? ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য শালাবাবু আগামী সপ্তাহে আসবে। মাকে আনলে ও কোথায় থাকবে! সমস্যার কথাটা শোনালে তামান্না বলল, ‘বাবুকে বলে দিয়েছি খালাম্মার বাসায় উঠতে।’

‘সেটা কেমন দেখাবে?’

‘ওসব বোঝার জন্য আমি আছি, আয়না আছে। এখন তুমি দোকানে গিয়ে শারমিনকে হাজার পাঁচেক টাকা বিকাশ করে দাও। ওর মেয়েটা খুব অসুস্থ। হাসপাতালে নিতে হতে পারে।’

শারমিন আমার ছোট বোন। এতগুলো টাকা ওকে পাঠাব কেন? ছয় মাস যাবত আমাদের একমাত্র ছেলেটা খেলনা মোটরসাইকেল কেনার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। বুঝ মানছে না। পয়েন্টটা ধরিয়ে দিতেই তামান্না জানাল, মানুষের জীবনের চেয়ে খেলাধুলা গুরুত্বপূর্ণ নয়। বেঁচে থাকলে খেলনা কিনতে পারবে।

এক অসুস্থতার মধ্যেই আরেকটা খবর এলো। মা কল দিয়ে জানালেন, বাবা কেমন যেন করছেন। বুক ধড়ফড় করছে। শুনে তামান্না দেরি করল না। কল দিয়ে বসল ওর ডাক্তার মামাতো ভাইকে। আমাদের বাড়ির কাছেই, বাজারে তার চেম্বার। দ্রুত দেখতে যাওয়ার জন্য তাড়া দিল মাহফুজ ডাক্তারকে। তামান্নার অতি পেরেশানিতে বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘তুমি যা শুরু করেছ, তাতে আমার আরও তিনটা চাকরি করতে হবে। এক চাকরির বেতনে কুলাবে না। সামান্য সর্দি-কাশিতেও ডাক্তার লাগে!’

‘মানুষ বৃদ্ধ হলে সর্দি-কাশিও বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। টাকার জন্য কোনোকিছু আটকে থাকবে না।’

আমাকে বিমর্ষ ভঙ্গিতে বসে থাকতে দেখে কিছুক্ষণ পর এক তোড়া নোট এনে দিল তামান্না। বলল, ‘টাকাটা শারমিনকে বিকাশ করে এসো। আমি কল করে ওদের খোঁজখবর নিচ্ছি।’

‘এত টাকা কোথায় পেলে?’

‘পকেট থেকে চুরি করিনি। আমার জমানো টাকা। আরও কিছু টাকা আছে। আম্মা যখন এখান থেকে বাড়িতে ফিরবেন, ভাইয়ার জন্য শার্ট-প্যান্ট কিনে দেব। ভাবির জন্য শাড়ি।’

‘নিজেকে ফতুর করে দেবে অপরের জন্য?’

‘ফতুর হওয়ার মাঝে যে কী আনন্দ, সেটা কখনো ভোগ-বিলাসীদের বোঝানো যাবে না।’

টাকা পাঠাতে এসে ঝামেলাতেই পড়লাম। মঞ্জুর সঙ্গে দেখা। গত বছর বিনা কারণেই ওর চাকরিটা চলে গেছে। এখন ভীষণ সমস্যা পোহাচ্ছে। মুখ ফসকে বলে ফেললাম, ‘বাসায় চল, চা খাবি।’

মঞ্জুটাও যে কী, বেহায়ার মতো রাজি হয়ে গেল!

বাসায় ফিরলে তামান্না বলল, ‘ভালো করেছ মঞ্জু ভাইকে সঙ্গে এনে। বড় ফুপু রান্না-করা খাবার পাঠিয়েছেন। সবাই মিলে খাওয়া যাবে।’

তামান্নার মুখে কতবার শুনেছি, ওই বাসার খাবারে নুন হয় না, ওরা মরিচও খায় না! অথচ আজ পরিবেশন শেষে রেসিপি জানার জন্য ফুপুকে কল দিয়ে বসল!

মঞ্জুও চেটেপুটে খেল। তামান্নার কান বাঁচিয়ে বলল, ‘আমাদের বউগুলো ভাবির মতো মমতাময়ী-মিশুক হয় না কেন!’

ছুটির দিন আজ। মঞ্জুর সঙ্গে গল্প করতে করতে বিকাল হয়ে গেল। এখন নাশতা বানানোর জন্য নুড্লস আনতে হবে। তামান্না দোকানে যাওয়ার তাড়া দিলে একান্তে বললাম, ‘বাদাইম্যা বন্ধুর জন্য এত টাকা খরচ করাবে কেন?’

তামান্না বিরক্ত হয়ে বলল, ‘সমস্যাগ্রস্ত মানুষের মনোবল অটুট রাখার জন্য বেশি কিছুই করা উচিত। তুমি পৃথিবীতে এসেছ শুধু নিজের শ্রাদ্ধ করতে!’

কথাটা পুরোপুরি সত্য নয়। আমি পৃথিবীতে এসেছি নাদিরা তামান্না নামের অসম্ভব মায়াবতী মেয়েটার স্বামী হতেও!

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম