সাক্ষাৎকার
ক্যাশলেস বাংলাদেশ : আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের ডিজিটাল রূপান্তরের যাত্রা
মো. রাফাত উল্লা খান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত)
যুগান্তর ডেস্ক
প্রকাশ: ৩০ নভেম্বর ২০২৫, ০১:২৫ এএম
মো. রাফাত উল্লা খান।
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
যুগান্তর : দেশে ক্যাশলেস লেনদেন বাস্তবায়নে কী কী উদ্যোগ নিচ্ছেন?
মো. রাফাত উল্লা খান : বাংলাদেশ সরকারের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ লক্ষ্য বাস্তবায়নের অন্যতম প্রধান ভিত্তি হচ্ছে ক্যাশলেস লেনদেন। বর্তমানে দেশে বছরে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয় শুধু নগদ অর্থ পরিচালনা, পরিবহণ, সংরক্ষণ ও নিরাপত্তার পেছনে। নগদ ব্যবস্থাপনার এই বিপুল ব্যয় কমানোর পাশাপাশি দুর্নীতি হ্রাস, আর্থিক স্বচ্ছতা বৃদ্ধি, লেনদেনের গতি বৃদ্ধি এবং দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক দক্ষতা উন্নত করার জন্য ডিজিটাল পেমেন্ট ইকোসিস্টেম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক শুরু থেকেই ক্যাশলেস বাংলাদেশ যাত্রায় নিজেকে একজন অগ্রগামী ও দায়িত্বশীল অংশীদার হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। আমরা বিশ্বাস করি, ডিজিটাল ব্যাংকিং শুধু একটি প্রযুক্তিগত উন্নয়ন নয়-এটি দেশের জনগণের জীবনমান উন্নয়নের অন্যতম শক্তিশালী মাধ্যম। তাই আমরা নগদহীন লেনদেনকে জনপ্রিয় করা, সহজলভ্য করা এবং নিরাপদ করার জন্য ধারাবাহিকভাবে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর সেবা চালু করছি।
ডিজিটাল ও ক্যাশলেস বাংলাদেশ গঠনে আমাদের প্রধান উদ্যোগগুলো—
উন্নত ও আধুনিক ইন্টারনেট ব্যাংকিং প্ল্যাটফর্ম : দ্রুত, নিরাপদ ও স্বয়ংক্রিয় লেনদেনের জন্য অ্যাকাউন্ট খোলা, অ্যাকাউন্ট ব্যবস্থাপনা, স্টেটমেন্ট দেখা, ফান্ড ট্রান্সফার (BEFTN, RTGS, NPSB), এমএফএস বা মোবাইল ব্যাংকিং এ টাকা পাঠানো, মোবাইল রিচার্জ এবং ডেটা কেনা, ইউটিলিটি বিল এবং কার্ড পেমেন্ট, ছজ পেমেন্ট, সেভিংস স্কিম বা ফিক্সড ডেপসিট খোলা সহ সবকিছুই এক অ্যাপে।
ডুয়েল কারেন্সি ডেবিট, প্রি-পেইড ও ইসলামিক ক্রেডিট কার্ড (লারিবা) : আন্তর্জাতিক ও দেশীয় লেনদেনে সম্পূর্ণ শরিয়াহভিত্তিক, সুদমুক্ত ডিজিটাল পেমেন্ট নিশ্চিত করতে আমরা চালু করেছি আমাদের কার্ড সার্ভিস এবং বর্তমানে প্রায় ৫.৫০ লাখের বেশি গ্রাহক আমাদের কার্ড সার্ভিস নিচ্ছেন এবং ডিজিটাল লেনদেন করছেন।
ইসলামিক ওয়ালেট : প্রান্তিক এবং সুবিধাবঞ্চিত গ্রাহকদের ঝামেলাহীন এবং নগদমুক্ত দৈনন্দিন লেনদেন সেবা দিতে আমরা ইসলামিক ওয়ালেট সেবা চালু করি যা ধীরে ধীরে গ্রাহকদের ডিজিটাল পেমেন্ট পার্টনার হিসাবে পরিচিতি পাচ্ছে।
বাংলা QR মার্চেন্ট এবং পেমেন্ট সার্ভিস : ক্যাশ ছাড়া লেনদেনের সহজতম মাধ্যম বাংলা QR কে সহজলভ্য করতে আমরা মার্চেন্ট নেটওয়ার্ক এবং QR পেমেন্ট সেবা চালু করেছি।
ডিজিটাল দান বক্স : মসজিদ, মাদ্রাসা ও দাতব্য প্রতিষ্ঠানের জন্য নিরাপদ, স্বচ্ছ দান ব্যবস্থাপনা এবং তাৎক্ষণিক লেনদেন নিশ্চিত করে আমরা ডিজিটাল দান বক্স সুবিধা চালু করেছি।
ইউনিফাইড এডুকেশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম : আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক শিক্ষার্থীদের ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য একটি সমন্বিত Education Management system (EMS) চালু করেছে যা টিউশন ফি সংগ্রহকে অনলাইন ও স্বয়ংক্রিয় করে শিক্ষাক্ষেত্রকে ডিজিটাল রূপান্তরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
এজেন্ট ব্যাংকিং ও ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (DFS) : আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক দেশের প্রত্যন্ত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দিতে এজেন্ট ব্যাংকিং ও ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসকে (DFS) অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে পরিচালনা করছে। আমাদের লক্ষ্য হলো—যেসব মানুষ প্রচলিত ব্যাংকিং সুবিধা থেকে বঞ্চিত, তাদের কাছে হাতের নাগালে, সহজ, নিরাপদ ও দ্রুত আর্থিক সেবা পৌঁছে দেওয়া। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে নগদ লেনদেনের নির্ভরতা কমে, ডিজিটাল পেমেন্ট বৃদ্ধি পায় এবং দেশের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি আরও শক্তিশালী হয়
যুগান্তর : ভারত, শ্রীলংকা ও পাকিস্তানের অভিজ্ঞতা কি কাজে লাগানো হচ্ছে?
মো. রাফাত উল্লা খান : বাংলাদেশে ক্যাশলেস সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশ ব্যাংক যে উদ্যোগগুলো নিয়েছে, তা ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলংকাসহ উন্নত ডিজিটাল অর্থনীতির দেশ সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপ-আফ্রিকার অভিজ্ঞতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বিশ্বে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (MFS)-এ বাংলাদেশের সাফল্য ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিকভাবে উদাহরণ হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে এবং এ খাতে বাংলাদেশ এখন শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর একটি।
বাংলাদেশ বর্তমানে ডিজিটাল আর্থিক খাতে একটি বড় রূপান্তরের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। এর মধ্যে উলেখযোগ্য কয়েকটি উদ্যোগ হলো—
১. প্রাইভেট ক্রেডিট ব্যুরো প্রতিষ্ঠা : ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সঠিক ক্রেডিট প্রোফাইল তৈরির মাধ্যমে আধুনিক ডিজিটাল ঋণব্যবস্থা শক্তিশালী করতে বাংলাদেশ শিগ্গির বেসরকারি ক্রেডিট ব্যুরো চালু করতে যাচ্ছে।
২. ডিজিটাল-ওনলি ব্যাংক চালু : এ উদ্যোগের ফলে শাখাবিহীন, সম্পূর্ণ প্রযুক্তিনির্ভর ব্যাংকিং সেবা চালু হবে, যা ২৪/৭, দ্রুত ও কম খরচে গ্রাহকদের জন্য ব্যাংকিং সহজ করে তুলবে।
৩. ই-মানি লাইসেন্স (টেলকো লেড মডেল) : বর্তমানে ব্যাংকনির্ভর মডেলের পরিবর্তে বাংলাদেশ ব্যাংক টেলকো-লেড ই-মানি লাইসেন্স চালুর প্রস্তুতি নিচ্ছে। ফলে টেলিকম কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে আরও সহজ, দ্রুত ও বিস্তৃত ডিজিটাল পেমেন্ট ইকোসিস্টেম তৈরি হবে।
৪. হোয়াইট-লেভেল মার্চেন্ট ও এজেন্ট নেটওয়ার্ক লাইসেন্স : স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠানগুলোকে মার্চেন্ট ও এজেন্ট নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার অনুমতি দিলে ডিজিটাল লেনদেন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও দ্রুত বিস্তৃত হবে।
৫.UPI-সদৃশ ইন্টারঅপারেবল অ্যাকাউন্ট-টু-অ্যাকাউন্ট (A2A) প্ল্যাটফর্ম : ভারতের UPI-এর মতো একটি ইন্টারঅপারেবল প্ল্যাটফর্ম চালু হলে বাংলাদেশে যে কোনো ব্যাংক ও পেমেন্ট সার্ভিস প্রোভাইডারের অ্যাকাউন্টের মধ্যে তাৎক্ষণিক, কম খরচে এবং নিরাপদ লেনদেন সম্ভব হবে। এটি হবে দেশের সর্ববৃহৎ আর্থিক উদ্ভাবনের অন্যতম।
৬. বাংলাদেশ কিউআর -এর সার্বজনীন ব্যবহার : প্রতিটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টকে একক মানসম্মত QR কোডের আওতায় আনা হলে ছোট-বড় সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে QR-ভিত্তিক ডিজিটাল পেমেন্ট সার্বজনীন হয়ে উঠবে। এটি ক্যাশলেস বাংলাদেশ গঠনে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
২০২৬ সালে এসব নীতিগত পরিবর্তন বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের ডিজিটাল ব্যাংকিং হবে আরও সহজ, দ্রুত, নিরাপদ এবং গ্রাহকবান্ধব। অর্থনীতির প্রতিটি পর্যায়ে ক্যাশলেস পেমেন্ট ও ডিজিটাল আর্থিক সেবা আরও বিস্তৃত হবে, যা বাংলাদেশকে একটি আধুনিক, কার্যকর এবং সম্পূর্ণ ডিজিটাল আর্থিক ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে নেবে।
সার্বিকভাবে বলা যায়, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সফল মডেল—বিশেষ করে ভারতের UPI ও ও ডিজিটাল পেমেন্ট ইকোসিস্টেমÑএবং এশিয়ার অন্যান্য উন্নত দেশের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ এখন ক্যাশলেস সমাজ গঠনের পথে দৃঢ়ভাবে এগিয়ে যাচ্ছে।
যুগান্তর : ভারতে ও পাকিস্তানে পি২পি/কিউআর লেনদেনে চার্জ নেইÑআপনারাও কি অনুসরণ করছেন?
মো. রাফাত উল্লা খান : ভারত ও পাকিস্তানে P2P এবং ছজ পেমেন্ট সম্পূর্ণ ফ্রি। বাংলাদেশও ধীরে ধীরে একই ব্যবস্থার দিকে এগোতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংক ভারতের মতো একটি A2A প্ল্যাটফর্ম চালু করার প্রস্তুতি নিচ্ছে, যা ফ্রি ট্রানজেকশনকে সহজ করবে।
এই প্ল্যাটফর্ম চালু না হওয়া পর্যন্ত, কেন্দ্রীয় ব্যাংক NPSB-এর মাধ্যমে ব্যাংক থেকে MFS বা PSP-এ P2Pলেনদেনের জন্য ফি নির্ধারণ করেছে। তা সত্তে¡ও, বর্তমানে আমাদের ব্যাংকসহ বেশ কিছু ব্যাংক ফ্রি সার্ভিস দিচ্ছে। তবে MFS-এ ক্যাশ ইন খরচ (এজেন্ট ও ডিস্ট্রিবিউটরের খরচ) থাকায় সম্পূর্ণ ফ্রি সেবা সম্ভব হচ্ছে না।
বাংলাদেশে QR পেমেন্টে অ্যাকোয়ারার হিসাবে অন্য ইস্যুকারকে IRF হিসাবে ০.৩০ শতাংশ থেকে ০.৭০ শতাংশ প্রদান করতে হয়, যা আমরা মার্চেন্ট থেকে MDR আকারে সংগ্রহ করি। তবে গ্রাহকরা এ সেবা বিনামূল্যেই পাচ্ছেন।
আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, বাংলাদেশ ব্যাংকের Payment Infrastructure System (PIS) ভবিষ্যতে এ খরচ আরও কমিয়ে দেশের ডিজিটাল লেনদেনকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে। আমরা সেই ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত—যেখানে প্রতিটি লেনদেন হবে দ্রুত, নিরাপদ এবং প্রায় বিনামূল্যে।
যুগান্তর : সেবার মান ও নিরবচ্ছিন্ন কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে কী পদক্ষেপ নিয়েছেন?
মো. রাফাত উল্লা খান : ডিজিটাল সেবা তখনই সফল হয় যখন গ্রাহক প্রযুক্তির কোনো জটিলতা অনুভবই করেন না, তিনি শুধুই সেবা উপভোগ করেন। এই লক্ষ্যেই আমরা ব্যাংকের প্রযুক্তিগত কাঠামো সম্পূর্ণভাবে পুনর্গঠন করছি। আমাদের কোর ব্যাংকিং সিস্টেম আপগ্রেড করা হচ্ছে, যাতে লেনদেন আরও দ্রুত ও নির্ভরযোগ্য হয়। একইসঙ্গে, আমরা আধুনিক ক্লাউড প্রযুক্তি ব্যবহার করছি, যা আমাদের সেবাকে আরও শক্তিশালী ও সিম্লেস করে তুলছে। তথ্য নিরাপত্তার জন্য আমরা বহুস্তরের সুরক্ষা ব্যবস্থা রেখেছি-প্রতিটি লেনদেন, প্রতিটি তথ্য সুরক্ষিত। সেবার মান ও নিরবচ্ছিন্ন কার্যকারিতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি নতুন পণ্য ও সেবা চালু করার জন্য পদক্ষেপগুলো উলেখ করা হলো-
উন্নত প্রযুক্তি অবকাঠামো : রিডান্ড্যান্ট সার্ভার ও নেটওয়ার্ক ব্যবহার।
রিয়েল-টাইম মনিটরিং : ২৪/৭ লেনদেন ও সিস্টেম পর্যবেক্ষণ।
ব্যাকআপ ও ডিজাস্টার রিকভারি : নিয়মিত ডেটা ব্যাকআপ এবং জরুরি পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা।
নিয়মিত সফটওয়্যার আপডেট : বাগ ও নিরাপত্তা ঝুঁকি কমানো।
নিরাপত্তা ও এনক্রিপশন : শক্তিশালী সাইবার সিকিউরিটি ব্যবস্থা।
প্রশিক্ষণ ও সাপোর্ট : কর্মীদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও ২৪/৭ গ্রাহক সাপোর্ট।
প্রক্রিয়াগত স্ট্যান্ডার্ড : SOP অনুযায়ী লেনদেন ও সেবা পরিচালনা।
নতুন পণ্য ও সেবা : ডিজিটাল ওয়ালেট, QR পেমেন্ট, A2A লেনদেন, ডেবিট/ক্রেডিট কার্ড ইন্টিগ্রেশন, স্বয়ংক্রিয় সঞ্চয় ও ঋণ প্রোডাক্ট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং বিজনেস টিউশন ফি কালেকশন সুবিধা।
যুগান্তর : ডিজিটাল চ্যানেলের প্রধান চ্যালেঞ্জ কী?
মো. রাফাত উল্লা খান : ডিজিটাল লেনদেনের সম্ভাবনা অসীম হলেও কিছু বাস্তব চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যা আমরা প্রতিদিন মোকাবিলা করছি।
প্রথমত, প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে গ্রাহক সচেতনতা এবং আর্থিক শিক্ষা ত্বরান্বিত করা। আবার, সাইবার নিরাপত্তার ঝুঁকি তো রয়েছেই—প্রতিদিন নতুন নতুন ধরনের জালিয়াতির চেষ্টা হয়। এজন্য আমাদের সব সময় সতর্ক থাকতে হয়, নিরাপত্তা ব্যবস্থা আপডেট রাখতে হয়। প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেট সংযোগের মানও কখনো কখনো সমস্যা তৈরি করে—নেটওয়ার্ক দুর্বল হলে লেনদেন বিলম্বিত হয়।
দ্বিতীয়ত, মানুষের দিক থেকে, অনেক ছোট ব্যবসায়ী এখনো ডিজিটাল লেনদেনের সঙ্গে পুরোপুরি পরিচিত নন। তাদের অনেকে হয়তো স্মার্টফোন ব্যবহার করতে জানেন, কিন্তু ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেম কীভাবে কাজ করে, কীভাবে হিসাব রাখতে হয়, কীভাবে সমস্যা সমাধান করতে হয়—এসব নিয়ে তাদের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। এজেন্ট ব্যাংকিং পয়েন্টগুলোতে দক্ষ লোকবল পাওয়াও একটা চ্যালেঞ্জ—আমাদের এমন মানুষ দরকার যারা শুধু প্রযুক্তি বোঝে তা-ই নয়, গ্রাহক সেবায়ও দক্ষ।
আর সবচেয়ে বড় বাধা হলো আমাদের ঐতিহ্যগত নগদ লেনদেনের অভ্যাস। বহু বছর ধরে আমরা হাতে টাকা নিয়ে, গুনে লেনদেন করে এসেছি। এ অভ্যাস পরিবর্তন করতে সময় লাগে, মানুষের আস্থা অর্জন করতে হয়। অনেকে ভাবেন, ডিজিটাল লেনদেন হয়তো জটিল, হয়তো নিরাপদ নয়। তাদের এ ধারণা পরিবর্তন করা আমাদের অন্যতম দায়িত্ব।
তৃতীয়ত, নিয়ন্ত্রক দিক থেকেও কিছু চ্যালেঞ্জ আছে। পেমেন্ট সার্ভিস প্রোভাইডার লাইসেন্স পেতে বেশ কিছু প্রক্রিয়া অতিক্রম করতে হয়, সময় লাগে। বিভিন্ন ব্যাংক ও পেমেন্ট প্রতিষ্ঠান আগে তাদের নিজস্ব কিউআর কোড ব্যবহার করত, এখন সবাইকে Bangla QR স্ট্যান্ডার্ডে রূপান্তরিত হতে হচ্ছে—এ পরিবর্তনেও সময় ও বিনিয়োগ লাগছে। এজেন্ট ব্যাংকিং চালু রাখতে হলে নিয়মিত বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা মেনে চলা, প্রতিবেদন জমা দেওয়া, পরিদর্শনের জন্য প্রস্তুত থাকা—এসব কাজও নিয়মিত করতে হয়।
যে দেশে নগদ ব্যবস্থাপনার খরচ বছরে ২০ হাজার কোটি টাকা, সেখানে ডিজিটাল রূপান্তর শুধু অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নয়-এটি ভবিষ্যতের একটি জাতীয় অঙ্গীকার।
তবে আশার কথা হলো, বাংলাদেশ ব্যাংক এ চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলার জন্য একের পর এক দূরদর্শী পদক্ষেপ নিচ্ছে। ২০২৪ সালের পেমেন্ট অ্যান্ড সেটেলমেন্ট সিস্টেমস অ্যাক্ট এ খাতে আইনি কাঠামো শক্তিশালী করেছে। পেমেন্ট সার্ভিস প্রোভাইডার লাইসেন্স নীতিমালা স্বচ্ছতা এনেছে। ডিজিটাল ব্যাংকিং লাইসেন্সের জন্য মূলধন এখন ৩০০ কোটি টাকা করা হয়েছে—যা প্রমাণ করে, শুধু প্রযুক্তি নয়, আর্থিক সক্ষমতা ও দীর্ঘমেয়াদি টেকসই পরিকল্পনা থাকতে হবে। জাতীয় ক্রেডিট স্কোর সিস্টেম চালু হচ্ছে, যা ঋণ বিতরণে স্বচ্ছতা আনবে। Bangla QR স্ট্যান্ডার্ড সবাইকে এক প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসছে। আর Payment Infrastructure System ev PIS ভবিষ্যতে লেনদেনের খরচ কমিয়ে গতি বাড়াবে।
আমি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলতে পারি-আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক ইতোমধ্যে সেই ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি সম্পন্ন করছে। আমরা শুধু ডিজিটাল সেবা তৈরি করছি না—আমরা এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে প্রত্যন্ত গ্রামে পৌঁছাচ্ছি, Bangla-QR-এর মাধ্যমে ছোট দোকানদারকে ডিজিটাল লেনদেনের মূলধারায় আনছি, PSP নীতিমালা মেনে নিরাপদ ডিজিটাল ওয়ালেট সেবা দিচ্ছি এবং আধুনিক নেটওয়ার্ক অবকাঠামোর মাধ্যমে নিরবচ্ছিন্ন সেবা নিশ্চিত করছি।
আমরা একটি সম্পূর্ণ ডিজিটাল ইকোসিস্টেম গড়ে তুলছি যা প্রতিটি বাংলাদেশীকে—শহরের ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে গ্রামের কৃষক, প্রবাসী শ্রমিক থেকে শিক্ষার্থী—সবাইকে আর্থিক সেবার মূলধারায় নিয়ে আসবে। আমরা বিশ্বাস করি, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার এ যাত্রায় প্রতিটি ব্যাংক, প্রতিটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের একটি জাতীয় দায়িত্ব রয়েছে।
এটাই আমাদের দায়িত্ব, এটাই আমাদের অঙ্গীকার।
