Logo
Logo
×

সম্পাদকীয়

জাতীয় খরা নীতিমালা তৈরি দায়বদ্ধতার সময় এখন

মো. শহিদুল ইসলাম

মো. শহিদুল ইসলাম

প্রকাশ: ২১ এপ্রিল ২০২৫, ১১:৫৩ এএম

জাতীয় খরা নীতিমালা তৈরি দায়বদ্ধতার সময় এখন

বাংলাদেশে বন্যা কিংবা ঘূর্ণিঝড় নিয়ে যতটা আলোচনার ঝড় ওঠে, খরা নিয়ে ততটা গভীর আলোচনায় আমরা পৌঁছাতে পারিনি এখনো। অথচ দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর দিকে তাকালে স্পষ্ট দেখা যায়— খরার ভয়াবহতা শুধু ফসলের ক্ষতি করে না, মানুষের জীবনযাত্রা, খাদ্যনিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও আর্থসামাজিক কাঠামোকেও ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে। খরায় আক্রান্ত প্রান্তিক মানুষের ক্ষতির খবরগুলো খুব কমই আসে জাতীয় আলোচনায়। 

খরাপ্রবণ বরেন্দ্র অঞ্চলের রাজশাহীর তানোর উপজেলার সুজলা মার্ডির ৬০ হাজার টাকার ষাঁড় গরু মারা গেছে। আঙ্গুরি বেগমের তিনটি ছাগল মারা গেছে। কৃষকের ফসল পুড়ে যায় খরায়– এ রকম অনেক ঘটনাই ঘটছে খরাপ্রবণ বরেন্দ্র অঞ্চলের গ্রামগুলোতে। তারা কোনো ক্ষতিপূরণ পায় না এবং পায়নি। বরেন্দ্র অঞ্চলে খরা ও পানিহীনতার কারণে মানুষ মারা গেছে, সহিংসতা বাড়ছে বরেন্দ্র অঞ্চলের সমাজে। পানিহীনতা ও ভূগর্ভে পানিশূন্যতা, প্রান্তিক মানুষের পানির অধিকারই শুধু নয়; এই পানির অধিকারহীনতায় ভুগছে এই অঞ্চলের প্রাণবৈচিত্র্য পরিবেশ। পরিবেশ তার নিজের অবস্থানে ভালো থাকার অধিকার আছে। এর সবই ঘটছে মূলত খরা ও পানির অভাবের কারণে। এ রকম বহু ঘটনা, দুর্ঘটনা ঘটছে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল অবস্থিত খরাপ্রবণ বরেন্দ্র অঞ্চলে। 

দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চল মূলত খরাপ্রবণ একটি এলাকা। দেশের এক-তৃতীয়াংশের বেশি ২২ জেলার অবস্থান এখানে। খরা শুধু আর বরেন্দ্র অঞ্চলের বিষয় নয়, খরা বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলকেও আঘাতে জর্ড়িত করছে। বলা যায়, গোটা বাংলাদেশেই খরা এখন একটি মারাত্মক দুর্যোগ হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। কিন্তু খরা নিয়ে আমাদের সুস্পষ্ট জাতীয় কোনো নীতিমালা নেই। 

খরা শুধু জাতীয় সংকটের বিষয় নয়, এখন এটি একটি বৈশ্বিক সংকটও বটে। জাতিসংঘ বলছে, ২০৫০ সালের মধ্যে খরা বিশ্বের তিন-চতুর্থাংরও বেশি মানুষকে প্রভাবিত করবে। বিশ্বব্যাংক অনুমান করছে, খরা ও সেই সঙ্গে পানির অভাব, ফসলের উৎপাদনশীলতা হ্রাস, সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং অতিরিক্ত জনসংখ্যার কারণে ২০৫০ সাল নাগাদ পৃথিবীর ২১৬ কোটি মানুষ অভিবাসনে বাধ্য হবে। আমরা স্পাষ্টভাবে এই দিকগুলো বরেন্দ্র অঞ্চলেই দেখতে পাচ্ছি। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর সমন্বয়হীন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কারণে বাংলাদেশে খরা ও প্রাকৃতি পানি ব্যবস্থাপনা সংকটের মুখে। খরা ও খরার প্রভাব মানুষসহ কৃষি প্রাণবৈচিত্র্যসহ পরিবেশের ওপর মারাত্মক আঘাত করছে বাংলাদেশে। 

গবেষণা ও উন্নয়নমূলক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইন্ডিজিনাস নলেজ-বারসিকের ২০২২ সালে ‘কৃষিজমির সংকট রূপ এবং সমাধানে করণীয়বিষয়ক মাঠ সমীক্ষায় দেখা যায়, বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষক বৈচিত্র্যময় ফসল চাষ করতে পারছেন না। খরার কারণে অনাবাদি বা অকৃষিজমির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৫ শতাংশ। প্রতিবেদনে দেখা যায়, খরা ও পানির অভাবসহ বিভিন্ন কারণে ১৯৭১ সালের পর থেকেই ৭০ শতাংশ প্রান্তিক কৃষক তার নিজের চাষের জমি হারিয়েছে। খরার প্রভাব খুব গভীরে, নীরব ঘাতকের মতো নিঃশেষ করছে।    

খরা শুধু মানুষেরই সংকট নয়, খরা এই ভুখণ্ডের সব প্রাণপ্রকৃতির ও পরিবেশের ক্ষতি করছে। তাই খরা মোকাবিলায় জনসংস্কৃতি, লোকায়ত জ্ঞান ও প্রযুক্তিগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে একটি জন-অংশগ্রহণমূলক জাতীয় খরা নীতিমালা তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। এই জাতীয় খরা নীতিমালা তৈরিতে বাস্তবভিত্তিক সংকট সমাধানের উদ্যোগ থাকবে, থাকবে কৃষকের কণ্ঠ, নারীর অভিজ্ঞতা, স্থানীয় জ্ঞান, যুব-তরুণদের ভাবনা এবং গবেষকদের বিশ্লেষণ ও সমাধানের নীতি। জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে একটি ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে বিবেচিত। দিনে দিনে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমাদের নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিচ্ছে। দুর্যোগ বাড়ছে। তেমনি খরা আমাদের নানাবিধ ক্ষতি করছে। বাংলাদেশ যদি একটি সুস্পষ্ট আলাদা জাতীয় খরা নীতিমালা তৈরি করতে পারে, তবে সেটি বিশ্ব জলবায়ু মঞ্চেরও একটি ভাবনার বিষয় হবে। যেসব ধনী দেশের কারণে আমাদের দিনের পর দিন জলবায়ু ঝুঁকি বাড়ছে, আমাদের দেশের ক্ষতি হচ্ছে তা জাতীয় খরা নীতিমালার মধ্য দিয়ে একটি জনদলিল হিসেবে উপস্থাপন করা যাবে। গ্রামের মধ্যে থাকা আদিবাসী সুজলা মার্ডির মতো অসংখ্য মানুষের খরার কারণে যেসব ক্ষতি হচ্ছে, ক্ষতি পূরণের দাবি হবে এই জাতীয় খরা নীতিমালা। বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জনমানুষের দীর্ঘদিনের দাবি— এই জাতীয় খরা নীতিমালা । 

খরায় ভুক্তভোগী মানুষের এই দাবি সরকার আন্তরিক হলেই সম্ভব। বর্তমান সরকার একটি সংস্কারের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে। আমরা মনে করি, পরিবেশিক যে সংকট, পরিবেশ নীতিমালার সীমাবদ্ধতা আছে, সেগুলোরও সংস্কার করুণ। যাতে জনবান্ধব হয় সব নীতিমালা। বর্তমান পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন একজন পরিবেশ ভাবনার মানুষ। আমরা প্রত্যাশা করি, এই সরকার বাংলাদেশের জন্য এই অতীব গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশ জাতীয় খরা নীতিমালাটি তৈরিতে ভূমিকা রাখবেন।  

লেখক : মো. শহিদুল ইসলাম

নৃবিজ্ঞানী ও পরিবেশ আইন গবেষক

বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইন্ডিজিনাস নলেজ- বারসিক 

ইমেইল: shahidul546mh@gmail.com


জাতীয় খরা নীতিমালা

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম