মৌ-পতঙ্গের ডানায় টিকে আছে আমাদের খাদ্য ও সংস্কৃতি
প্রকাশ: ২১ মে ২০২৫, ১২:১১ পিএম
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
'ভ্রমর কইয়্যা গিয়া যেন, কমলে না বোলায়ো কথা, ভ্রমর কইয়্যা গিয়া...'— বাংলাদেশের কিংবদন্তি বাউল সাধক রাধারমণ দত্তের এই গানে শুধু মানুষের প্রেম ভালোবাসাই নয়, মানুষের সঙ্গে গাছের, গাছের সঙ্গে প্রাণের-বৃক্ষ লতাপাতার— সবার সঙ্গে সবার সম্পর্ক। গান, কবিতা, খাদ্য, প্রাণ, লতাপাতা, মৌ-পতঙ্গ কত কিছুতেই আমাদের সংস্কৃতির সম্পর্ক। মৌ-পতঙ্গের একটি অন্যতম জাত— কালো ভ্রমর, নীল ভ্রমর। ভ্রমর নিয়ে কতই না বাঙালির সংস্কৃতির উপাদান আছে। ভ্রমর নেই, কিন্তু সংস্কৃতির সেই আলাপন, গল্প, কবিতা গানগুলো আছে। আজ ভ্রমর বিলুপ্তির সঙ্গে শুধু সাংস্কৃতির উপাদানই বিলুপ্তি হয়নি, হতে চলেছে মানবসভ্যতা।
গতকাল ছিল বিশ্ব মৌ-পতঙ্গ দিবস ২০২৫। প্রতি বছরের মতো ২০ মে বিশ্বব্যাপী এই দিবসটি পালন করা হলেও কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে সরকারিভাবে এটি এখনো পালন করার কোনো যৌথ প্রচেষ্টা দেখা যায়নি। এবারের মৌ-পতঙ্গ দিবসের প্রতিপাদ্য—“Bee inspired by nature to nourish us all”। প্রকৃতির দ্বারা অনুপ্রাণিত মৌমাছি আমাদের সবাইকে পুষ্টিকর খাদ্য তৈরিতে সহায়তা করে। এই বার্তাটি শুধু একটি পরিবেশবান্ধব আহ্বান নয়, বরং তা বিশ্বের খাদ্য নিরাপত্তা, কৃষি উৎপাদন ও পরিবেশ সুরক্ষার ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা দেয়। ‘মৌ-পতঙ্গ’ বলতে— আমরা শুধু মৌমাছিকেই বুঝি না। এর মধ্যে রয়েছে প্রজাপতি, ভোমরাপোকা, পাখি, বাদুড় এবং এমনকি কিছু প্রজাতির পিঁপড়া ও মাছিও। এরা সবাই পরাগবাহীর (pollinators) ভূমিকায় অবতীর্ণ। যখন তারা ফুলে ফুলে উড়ে বেড়ায়, তখন তারা এক ফুলের পরাগ অন্য ফুলে পৌঁছে দেয়, যা ফল, বীজ ও নতুন গাছের জন্ম দেয়। পৃথিবীর প্রায় ৭৫ শতাংশ খাদ্যশস্য এমন পরাগায়ননির্ভর ফসল। জীবন, খাদ্য ও প্রকৃতির নীরব নায়ক এই মৌ-পতঙ্গ। কিন্তু দিনে দিনে ভয়ংকরভাবে এই মৌ-পতঙ্গ কমে গেছে। মৌ-পতঙ্গ কমার পেছনে শস্য ফসল ফলের বাগানে কীটনাশকের ব্যবহার, জলবায়ু পরিবর্তনই এর মূল দায়ী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন পরিবেশবিজ্ঞানীরা। ঠিক একই দাবি গ্রামের কৃষক-কৃষাণীদের।
গোকুল মথুরা গ্রামের কৃষক জীতেন্দ্রনাথ বলেন, একসময় কালো ভ্রমর দেখা দিত, এখন সেটি বিলুপ্ত। আগে গাছের ডালে অনেক মৌমাছি চাক (বাসা) বাঁধত, এখন আর বড় গাছও নেই মৌমাছিও নেই। জলবায়ু পরিবর্তন, অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার, প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংস, নগরায়ন ও বন উজাড়ের কারণে পরাগবাহীদের সংখ্যা পৃথিবীজুড়ে আশঙ্কাজনকভাবে কমছে। ২০১৬ সালে জাতিসংঘের Intergovernmental Science-Policy Platform on Biodiversity and Ecosystem Services (IPBES) দ্বারা প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, বিশ্বব্যাপী ৪০ শতাংশের বেশি অমেরুদণ্ডী পরাগবাহক প্রজাতি, বিশেষ করে মৌমাছি ও প্রজাপতি, বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে। এই প্রতিবেদনটি ৭৭ জন আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞের দ্বারা প্রস্তুত করা হয়েছিল এবং এটি তিন হাজারেরও বেশি বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং ৬০টিরও বেশি স্থানীয় ও আদিবাসী জ্ঞান উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করে তৈরি করা হয়েছে।
আলবার্ট আইনস্টাইন একবার বলেছিলেন— “ OIf the bee disappeared off the surface of the globe, then man would have only four years of life left” এটি নিছক রূপক নয়। মৌমাছির সংকট মানেই মানুষের অস্তিত্বের সংকট। মৌ-পতঙ্গ সুরক্ষা এখন সময়ের দাবি। মৌ-পতঙ্গের বিলুপ্তি মানে মানবসভ্যতার বিলুপ্তি। পৃথিবীতে তাই মৌ-পতঙ্গ সুরক্ষায় অনেক বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ২০১৩ সালে ৩টি কীটনাশকের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় মৌমাছির হ্রাস ঠেকাতে। অন্যদিকে কানাডা ও আমেরিকা মৌ-পতঙ্গ সুরক্ষায় "Pollinator Protection Action Plan" নামে নীতিমালা তৈরি করেছে। নেপাল সাম্প্রতি তাদের জাতীয় মৌচাষ নীতিতে পরাগবাহীদের রক্ষায় সুনির্দিষ্ট ধারা যোগ করেছে। কিন্তু কৃষিপ্রধান বাংলাদশে মৌ-পতঙ্গ সুরক্ষায় সুনিদিষ্ট কোনো নীতিমালা বা কার্যক্রম না থাকায় অতীব গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়ে আমরা পিছিয়ে পড়ছি। বাংলাদেশের গ্রামীণ কৃষিব্যবস্থায় পরাগবাহীদের অবদান ঐতিহ্যগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ হলেও তা জাতীয়ভাবে প্রায় অবহেলিত। মনোকালচার বা এক ফসলভিত্তিক কৃষি, কাটনাশক রাসায়নিক নির্ভরতা এবং গাছপালা নিধনের কারণে মৌমাছি ও দেশীয় পতঙ্গের আবাস ধ্বংস হচ্ছে। অন্যদিকে বাংলাদেশে বিদ্যমান পরিবেশ এবং প্রাণবৈচিত্র্য সুরক্ষাসহ কৃষিনীতিমালাগুলোতে মৌ-পতঙ্গ সুরক্ষা বিষয়ে স্পষ্ট কোনো আলোচনা নেই। বাংলাদেশর অতিগুরুত্বপূর্ণ এবং প্রথম বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ আইনটি পরিবশে সংরক্ষণ ও দূষণ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু এতে মৌ-পতঙ্গ বা পরাগবাহীদের (Pollinators) সুরক্ষার জন্য নির্দিষ্ট কোনো বিধান নেই। অন্যদিকে বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য আইন ২০১৭, বাংলাদেশ গুড অ্যাগ্রিকালচারাল প্র্যাকটিসেস (GAP) নীতি ২০২০, এসব আইন নীতিমালাতেও পরাগবাহী মৌ-পতঙ্গ বিষয়ে সুরক্ষার জন্য সুনির্দিষ্ট বিধান নেই। বাংলাদেশ বিদ্যমান বালাইনাশক (পেস্টিসাইড) আইন ২০১৮ কীটনাশক ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে, তবে এতেও মৌ-পতঙ্গ পরাগবাহীদের ওপর এর প্রভাব বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। বাংলাদেশে এখনো অনেক কীটনাশক অনুমোদিত, যা মৌমাছি ও অন্যান্য পরাগবাহীদের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এগুলো বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকে। বিদ্যমান পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র্য আইন নীতিমালাগুলোতে মৌ-পতঙ্গ পরাগবাহীদের সুরক্ষার স্পষ্ট ধারা বা নীতিমালা রাখতে হবে। একই সঙ্গে দেশে জাতীয়ভাবে মৌ-পতঙ্গ সুরক্ষা নীতিমালা বা আইন তৈরি করতে হবে। যেসব কীটনাশক মৌ-পতঙ্গ বা জীব পরিবেশের জন্য হুমকি তা অতিশিগগিরই বন্ধের নির্দেশ দিতে হবে। আমরা প্রতি বছর ঢাকঢোল বাজিয়ে যেমন বাঘ সুরক্ষার সচেতনতা চালাই, সেই তুলনায় অতীব গুরুত্বপূর্ণ মৌ-পতঙ্গ সুরক্ষার জন্য কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ে না। সরকার চাইলে পরাগবান্ধব কৃষিনীতি প্রণয়ন করে পরাগবাহীদের অবদান ও সুরক্ষাকে গুরুত্ব দিতে পারে। একই সঙ্গে কীটনাশক নিয়ন্ত্রণ ও প্রাণপ্রকৃতিনির্ভর কৃষি ব্যবহার ও সচেতনতা বাড়তে পারে।
কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে মৌ-পতঙ্গ সুরক্ষায় কার্য়কর নীতিমালা তৈরি ও তা বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি। তা না হলে আমরা আগামীতে আরও ক্ষতির শিকার হব। কীটনাশকনির্ভর কৃষি, পরনির্ভরশীল কৃষি কখনো একটি দেশের জন্য কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না।
লেখক: নৃবিজ্ঞানী ও পরিবেশ আইন গবেষক
rshahid_546@yahoo.com

