Logo
Logo
×

সম্পাদকীয়

(প্রথম পর্ব)

ভূখণ্ড নয়, আগামী দুনিয়া নিয়ন্ত্রিত হবে ডিজিটাল বর্ডারে

মো. শহিদুল ইসলাম

মো. শহিদুল ইসলাম

প্রকাশ: ০৪ জুন ২০২৫, ০২:২৮ পিএম

ভূখণ্ড নয়, আগামী দুনিয়া নিয়ন্ত্রিত হবে ডিজিটাল বর্ডারে

ডিজিটাল বর্ডার, ছবি: অনলাইন থেকে নেওয়া

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমরা বিশ্ব মানচিত্রে ভূখণ্ডভিত্তিক বিভাজন ও আধিপত্যের রাজনীতি দেখেছি। যুদ্ধ, সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশের ছায়া ঘিরে রেখেছে কতশত সীমানা, যেখানে একেকটি রেখার নিচে পিষে গেছে ভাষা, সংস্কৃতি ও মানবজীবন। উপনিবেশিকতা কথাটি শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে একসময়ের দখলদার রাষ্ট্র, বন্দুকধারী সৈন্য, লুণ্ঠিত সম্পদ আর ভাষা ও সংস্কৃতি পরাধীন চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাওয়া জাতিগুলোর স্মৃতি। বর্তমান বিশ্বে উপনিবেশিকতা আর আগ্রাসনের রূপ তেমনটি নয়, এখন আর ভুখণ্ড দখল নয়।  আজকে শাসন চলে ডিজিটাল চ্যানেলে, নিয়ন্ত্রণ চলে অদৃশ্য তথ্যের মাধ্যমে। বিশ্বায়নের প্রথম তরঙ্গে শোনা গিয়েছিল তথ্যই হবে ভবিষ্যতের শক্তি। কিন্তু আজকের দিনে দাঁড়িয়ে নতুন এক বাস্তবতার মুখোমুখি আমরা, যেখানে বিশ্বরাজনীতি ও ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ ধীরে ধীরে স্থানান্তরিত হচ্ছে ‘ডিজিটাল সীমান্ত’ (Digital Border)। ডিজিটাল তথ্যই হয়ে উঠছে শোষণের নতুন হাতিয়ার। বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল অনেক দেশ এখন এক ধরনের অদৃশ্য ডিজিটাল উপনিবেশিকতার শিকার, যেখানে দেশীয় মানুষের প্রতিদিনের কর্মকাণ্ড, চিন্তা, যোগাযোগ ও ভোগাচরণ নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে বিদেশি করপোরেশন ও অ্যালগরিদমের দ্বারা আমাদের অজান্তেই। আধুনিক বিশ্বব্যবস্থায় তথ্য হয়ে উঠেছে নতুন খনিজসম্পদ, যাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে এক ভয়াবহ শোষণ ব্যবস্থাপনার কলোনি। অস্ত্র নয়, এখন তথ্য দিয়েই জাতির নিয়তি নির্ধারিত হয়।

আজকের মানুষ প্রতিমুহুর্তে যেসব ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করছে, যেমন— সোশ্যাল মিডিয়া, মোবাইলঅ্যাপ, ইন্টারনেট সার্চ, স্মার্ট ডিভাইস এসবের মাধ্যমে সে অনিচ্ছাকৃতভাবে নিজের চেতনা, অভ্যাস, ইচ্ছা, ভয় ও বিশ্বাস তুলে দিচ্ছে এক অনিয়ন্ত্রিত শক্তির হাতে। এই শক্তির নামে বড় বড় প্রযুক্তি কোম্পানি, যার মধ্যে গুগল, মেটা, অ্যামাজন, টিকটক বা এক্স (সাবেক টুইটার) অন্যতম। তারা জানে আপনি কী খাচ্ছেন, কোথায় যাচ্ছেন, কোন রাজনৈতিক চিন্তা পছন্দ করছেন সব কিছু। এগুলো শুধু বিজ্ঞাপন বিক্রির জন্য নয়; এগুলোর মাধ্যমে গড়ে উঠছে ‘বিহেভিয়ারাল প্রোফাইল’, যার দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা শুধু একক ব্যক্তি নয়, নিয়ন্ত্রণ করা যায় পুরো সমাজ-দেশকে।

স্টারলিংক ও ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে যে, তথ্য ও ইন্টারনেট এখন যুদ্ধের চেয়েও বেশি কৌশলগত শক্তি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সময় যখন ইউক্রেনের সব যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল, ঠিক তখন ইলন মাস্কের ‘Starlink’ স্যাটেলাইট সিস্টেমই ছিল তাদের প্রধান লাইফলাইন। এটি শুধু ইন্টারনেট নয়, যুদ্ধের মেরুদণ্ড হয়ে উঠেছিল। প্রশ্ন উঠেছে যে, একজন ব্যক্তির মালিকানাধীন একটি তথ্য পরিকাঠামো কি একটি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের চেয়ে বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠছে না? এর উত্তর ভয়াবহভাবে ‘হ্যাঁ’।

ইসরাইল-ফিলিস্তিন পরিস্থিতিও দেখায় তথ্য কেমন করে একপাক্ষিক হয়ে যায়। গাজায় যখন বোমা পড়ছে, তখন অনেক সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ফিলিস্তিনপন্থি কনটেন্টগুলো 'কম দৃশ্যমান' করে দিয়েছে। অ্যালগরিদম একতরফাভাবে যা দেখাতে চায়, তাই মানুষ দেখতে বাধ্য হয়। এটি আর শুধু প্রযুক্তি নয়, এটি হয়ে উঠেছে ‘সাংস্কৃতিক সেন্সরশিপ’, যার মাধ্যমে সত্যের ওপর পর্দা পড়ে যায়। 

কেনিয়ার লেখক নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো তার সবচেয়ে আলোচিত ও বিখ্যাত রচনা Decolonising the Mind: The Politics of Language in African Literature (১৯৮৬), যেখানে তিনি বহু আগেই বলেছেন—উপনিবেশবাদ কেবল ভূখণ্ড নয়, মানুষের মন ও সংস্কৃতিও দখল করে। 'পূর্বে তারা আমাদের ভূমি দখল করেছিল, এখন তারা দখল করছে আমাদের চিন্তা।'— এই বাক্যটি কোনো কবিতার লাইন নয়, বরং একবিংশ শতাব্দীর নতুন বাস্তবতা যেখানে উপনিবেশিকতা ফিরে এসেছে অন্য রূপে: ডেটা উপনিবেশ (Data Colonialism)। এখন আর সাগর পেরিয়ে যুদ্ধজাহাজ আসছে না, বরং অনলাইনে প্রতিনিয়ত প্রবেশ করছে লাখ লাখ নজরদারি অ্যালগরিদম, অ্যাপস, ক্লাউড সার্ভার আর বিগ ডেটা মেশিন। ফলাফল: গ্লোবাল সাউথ তথা উন্নয়নশীল দেশগুলো ধীরে ধীরে পরিণত হচ্ছে 'ডেটা কলোনি'-তে। ডেটা কলোনি, যেখানে দেশের জনগণের আচরণগত, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক তথ্য স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত হলেও নিয়ন্ত্রণ থাকে বৈশ্বিক করপোরেট বা প্রযুক্তি শক্তির হাতে। এ এক নতুন ধরনের শোষণ যেখানে তথ্যই হচ্ছে সম্পদ, আর মানুষ হচ্ছে সেই খনির কাঁচামাল। একবিংশ শতাব্দীর নতুন খনিজ ডেটা বা ডেটা কলোনি। বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান কোম্পানিগুলোর দিকে তাকালেই এটা স্পষ্ট হয়ে Apple, Google (Alphabet), Meta (Facebook), Amazon, Microsoft: তারা কেউ-ই তেল বা গ্যাস উত্তোলন করে না, তারা তথ্য উত্তোলন করে। The Age of Surveillance Capitalism-এ এই নতুন তথ্যভিত্তিক পুঁজিবাদের ভয়াবহতা তুলে ধরেছেন, যেখানে মানব আচরণকে ভবিষ্যদ্বাণীর জন্য ব্যবহারের যোগ্য ‘ডেটা’ হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। 

তাই পৃথিবীজুড়েই উপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলো লড়াই করছে নতুন নতুন ডিজিটাল কলোনি তৈরির। আজ আর ট্যাংক বা যুদ্ধজাহাজ দিয়ে নয়, বরং তথ্যের মাধ্যমে চলছে নতুন দখলদারি। এই নতুন শোষণের নাম ডেটা কলোনি। যেখানে মানুষ, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিদিনের আচরণ, অনুভব, পছন্দ-অপছন্দ— এমনকি রাজনৈতিক অবস্থান পর্যন্ত সংগৃহীত হয়ে যাচ্ছে তথ্য হিসেবে, যা নিয়ন্ত্রণ করছেন বৈশ্বিক করপোরেট ও প্রযুক্তি জায়ান্টরা। উপনিবেশিকতার এই নয়া ছকে আমরা কোথায়? 

লেখক: নৃবিজ্ঞানী ও পরিবেশ আইন গবেষক

ইমেইল: rshahid_546@yahoo.com

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম