ট্রাম্পের ‘৮টি যুদ্ধের অবসান’ : বাস্তবতা নাকি প্রহসন?
প্রকাশ: ১৮ অক্টোবর ২০২৫, ০২:৩২ পিএম
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: সংগৃহীত
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বিতর্কিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার দ্বিতীয় মেয়াদে আবারও দাবি করেছেন যে, তিনি বিশ্বজুড়ে ৮টি বড় যুদ্ধ বা সংঘাতের অবসান ঘটিয়েছেন। পাশাপাশি এর মাধ্যমে তিনি ‘লক্ষ লক্ষ প্রাণ বাঁচিয়েছেন’। সত্যিই কি তাই?
রাজনীতির জগতে নিজের ভাবমূর্তি সুন্দর করে তোলার প্রবণতা সব নেতার মধ্যেই দেখা যায়। ট্রাম্পও এর ব্যতিক্রম নন। নিজের সাম্প্রতিক ভাষণ ও সাক্ষাৎকারগুলোতে তিনি বারবার বলেছেন, কূটনীতি ও অর্থনৈতিক চাপের মাধ্যমে তিনি ৮টি আন্তর্জাতিক যুদ্ধ বা সংঘাত শেষ করেছেন।
যদি তার এই দাবিগুলো সত্য হতো, তাহলে তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় ও পুরস্কারযোগ্য—সম্ভবত নোবেল শান্তি পুরস্কারের যোগ্যও হতো।
কিন্তু বাস্তব অবস্থা ও স্বাধীন প্রতিবেদনের সঙ্গে তুলনা করলে এই দাবিগুলো কতটা টেকে? নিচে প্রতিটি দাবির প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করা হলো।
ট্রাম্পের দাবি ও এর কাঠামো
সম্প্রতি (সেপ্টেম্বর) জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ট্রাম্প ঘোষণা দেন যে, তিনি ‘সাতটি অন্তহীন যুদ্ধ’ শেষ করেছেন। পরে গাজা যুদ্ধবিরতির কথা উল্লেখ করে সংখ্যাটি ‘আট’ এ উন্নীত করেন।
তিনি দাবি করেন, কঠোর শুল্কনীতি ও ‘দৃঢ় মধ্যস্থতা’র মাধ্যমে তিনি শান্তি বয়ে এনেছেন। একই সঙ্গে নিষ্ক্রিয়তার জন্য জাতিসংঘকে দোষারোপও করেন।
কিন্তু বার্তা সংস্থা এপি, সিএনএন ও দ্য ইকোনোমিস্টের যাচাই ও বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ট্রাম্পের অধিকাংশ দাবি হয় অতিরঞ্জিত, নয়তো ভিত্তিহীন—কিছু ক্ষেত্রে তো আসলে কোনো যুদ্ধই ছিল না যা তিনি ‘শেষ’ করতে পারেন।
ট্রাম্পের কথিত ৮টি দাবির বিশ্লেষণ নিচে উল্লেখ করা হলো-
১. থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়া
২০২৫ সালের জুলাইয়ে দক্ষিণ এশিয়ার এই দুই প্রতিবেশী দেশের সীমান্তে অল্প সময়ের সংঘর্ষে কয়েক ডজন প্রাণহানি ঘটে। ট্রাম্প দাবি করেন, তিনি উভয় দেশের সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তি স্থগিতের হুমকি দিয়ে যুদ্ধবিরতি করাতে সক্ষম হন।
বাস্তবতা: যুদ্ধবিরতি খুব দ্রুতই ভেঙে পড়ে, পুরোনো সীমান্তবিরোধ এখনো বিদ্যমান। এটি মূলত সাময়িক সাফল্য, যুদ্ধের অবসান হয়নি।
২. কসোভো ও সার্বিয়া
ট্রাম্প দাবি করেন, তিনি এ দুই দেশের মধ্যেও সংঘাতের অবসান ঘটিয়েছেন।
বাস্তবতা: ২০২৫ সালে তাদের মধ্যে কোনো সক্রিয় যুদ্ধই ঘটেনি। ট্রাম্প আসলে ২০২০ সালের অর্থনৈতিক চুক্তির কথা বোঝাচ্ছিলেন, যা কখনো কার্যকর হয়নি। অর্থাৎ এটি ‘একটি কল্পিত যুদ্ধের অবসান’—একেবারেই প্রচারনির্ভর দাবি।
৩. রুয়ান্ডা ও কঙ্গো (ডিআরসি)
চলতি বছরের জুনে ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় তথাকথিত ‘ওয়াশিংটন শান্তিচুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু এতে দুই দেশের মূল বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর অংশগ্রহণই ছিল না।
বাস্তবতা হলো: সেখানে এখনো সহিংসতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘন অব্যাহত রয়েছে। অর্থাৎ যুদ্ধের অবসান নয়, কেবল কাগজে কলমে উদ্যোগ।
৪. ভারত ও পাকিস্তান
এ বছরের মে মাসে কাশ্মীর ইস্যুতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘর্ষের পর ট্রাম্প দাবি করেন, তার শুল্ক হুমকিতেই দুই দেশ যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়।
বাস্তবতা হলো: পাকিস্তান এই দাবি সমর্থন করলেও ভারত তা প্রত্যাখ্যান করে এসেছে বারবার। এছাড়া কোনো আনুষ্ঠানিক চুক্তিও হয়নি, সীমান্তে উত্তেজনা এখনো বিদ্যামান।
৫. ইসরাইল ও ইরান সংঘাত
২০২৫ সালের জুনে যুদ্ধবাজ ইসরাইল ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় বোমা হামলা চালায়। পরে ইরানও পালটা জবাব দেয়। যুক্তরাষ্ট্রও এতে জড়িয়ে পড়ে। ১২ দিনের এই সংঘাতে উভয় দেশের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
ট্রাম্প দাবি করেন, তার নির্দেশে মার্কিন বিমান হামলা ইরানকে যুদ্ধবিরতিতে বাধ্য করে।
কিন্তু বাস্তবতা হলো- ট্রাম্প নিজেই এই যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ছিলেন; ফলে তার ‘যুদ্ধ বন্ধ করার’ দাবি হাস্যকর। যুদ্ধ থেমেছে, কিন্তু কোনো টেকসই সমাধান বা চুক্তি হয়নি।
৬. মিশর ও ইথিওপিয়া
মিশর ও ইথিওপিয়ার মধ্যে গ্র্যান্ড রেনেসাঁ বাঁধ ইস্যুতে কূটনৈতিক টানাপোড়েন ছিল, কিন্তু কখনো যুদ্ধ হয়নি।
বাস্তবতা হলো- ট্রাম্পের দাবি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। এটি ‘যুদ্ধ প্রতিরোধ’ নয়, বরং কল্পিত এক সংঘাতের রাজনৈতিক ব্যবহার।
৭. আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান
২০২৫ সালের আগস্টে ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় এই দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিককরণের একটি প্রাথমিক চুক্তি হয়।
বাস্তবতা: গুরুত্বপূর্ণ হলেও এটি শান্তিপ্রক্রিয়ার সূচনা মাত্র, যুদ্ধের অবসান নয়। সীমান্ত ও নিরাপত্তা সমস্যা এখনো অমীমাংসিত।
৮. ইসরাইল ও হামাস (গাজা)
২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে অবরুদ্ধ গাজায় চলমান রক্তক্ষয়ী আগ্রাসনে এ পর্যন্ত ৬৮ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। দুই বছরের মাথায় ২০২৫ সালের অক্টোবরে ট্রাম্প ২০ দফা পরিকল্পনা দেন, যার আওতায় গাজায় যুদ্ধবিরতি ও মানবিক সাহায্য কার্যক্রম শুরু হয়।
বাস্তবতা: যুদ্ধবিরতি আংশিক হলেও স্থায়ী শান্তি এখনো অধরা; ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে বিচ্ছিন্ন হামলা ও ইসরাইলি হুমকি অব্যাহত রয়েছে।
পরিশেষে বলা যায়, ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘৮টি যুদ্ধের অবসান’ দাবিটি বাস্তবতার তুলনায় রাজনৈতিক প্রচারণা ও আত্মপ্রচারমূলক বয়ান ছাড়া আর কিছু নয়।
কিছু ক্ষেত্রে (যেমন: মিশর–ইথিওপিয়া বা কসোভো–সার্বিয়া) তো কোনো যুদ্ধই ছিল না, অন্য ক্ষেত্রে কেবল সাময়িক যুদ্ধবিরতি হয়েছে, যা মূল সমস্যার সমাধান করেনি।
অতএব, তার এই ‘আট মাসে আট যুদ্ধ শেষ’— এই দাবিটি অতিরঞ্জিত, বিভ্রান্তিকর এবং রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
ট্রাম্পের এই বক্তব্য শান্তির ইতিহাসে কোনো বাস্তব পদক্ষেপ নয়, বরং নিজের ভাবমূর্তি রক্ষার এক কূটকৌশল। এক কথায়, বাস্তবতার চেয়ে প্রচারণাই এখানে মুখ্য।







