রক্তাক্ত পেহেলগাম: দায় স্বীকার করা ‘টিআরএফ’ সম্পর্কে যা জানা গেল
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ২৩ এপ্রিল ২০২৫, ০৭:৫৩ পিএম
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
যেখানে গেলে সাধারণত সান্নিধ্য মেলে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও নিরবচ্ছিন্ন শান্তির— কাশ্মীরের সেই পেহেলগামে মঙ্গলবার (২২ এপ্রিল) দুপুরে ঘটে গেল এক রক্তক্ষয়ী ঘটনা। সৌন্দর্যের লীলাভূমি গোটা উপত্যকাই রূপ নেয় মৃত্যুপুরীতে।
এদিন বন্দুকধারীদের গুলিতে নিহত হন অন্তত ২৬ জন পর্যটক। যাদের বেশিরভাগই ভারতের পশ্চিমাঞ্চল থেকে আসেন ছুটি কাটাতে ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে।
ঘটনার কিছু সময়ের মধ্যেই টেলিগ্রামে একটি ঘোষণা ছড়িয়ে পড়ে। তাতে বলা হয়, ‘দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ বা টিআরএফ এই হামলার দায় স্বীকার করেছে।
টিআরএফ: একটি ‘ভার্চুয়াল ফ্রন্ট’ থেকে বাস্তবতায়
২০১৯ সালে ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল এবং জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহারের পরই মূলত টিআরএফ নামে একটি ভার্চুয়াল ফ্রন্ট আত্মপ্রকাশ করে। এর শুরু হয়েছিল সামাজিক মাধ্যমে প্রচারণার মধ্য দিয়ে।
‘রেজিস্ট্যান্স’ শব্দটি ব্যবহার করে তারা সরাসরি ইসলামিক পরিচয় এড়িয়ে একটি জাতীয়তাবাদী ভাবমূর্তি তুলে ধরতে চেয়েছিল।
তবে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো শুরু থেকেই টিআরএফ-কে পাকিস্তানভিত্তিক লস্কর-ই-তইবার ছদ্মবেশী ফ্রন্ট হিসেবে দেখে আসছে।
হামলার কারণ কী?
টিআরএফ-এর বিবৃতিতে বলা হয়, ‘কাশ্মীরে ‘বহিরাগতদের’ বসতি স্থাপন ঠেকাতেই এই হামলা চালানো হয়েছে’।
যদিও নিহতরা সবাই পর্যটক, বসতি স্থাপনকারী নয়। তবুও টিআরএফ এই হামলার মাধ্যমে একটি সুস্পষ্ট বার্তা দিতে চেয়েছে। সেটা হলো- কাশ্মীরকে ভারতের ‘করদ রাজ্যে পরিণত করার’ চেষ্টার বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ চলছে।
মোদি সরকারের নীতির প্রশ্নবিদ্ধতা
এদিকে কাশ্মীরে স্বাভাবিকতা ফিরেছে—গত কয়েক বছর ধরে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এমন দাবি ক্রমাগত প্রচার করে আসছে। পর্যটনকেন্দ্রিক প্রচারণা ও বিনিয়োগও সেই ভাবমূর্তিরই অংশ। কিন্তু পাহেলগামের হত্যাকাণ্ড দেখিয়ে দিল, পরিস্থিতি মোটেই ‘স্বাভাবিক’ নয়।
এ বিষয়ে দক্ষিণ এশীয় সন্ত্রাস বিশ্লেষক অজয় সাহনি বলেন, ‘শূন্য সন্ত্রাসবাদ—এই কল্পনা কখনো বাস্তব হতে পারে না, যদি না রাজনৈতিকভাবে সমাধান আনা যায়’। টিআরএফ-এর এই হামলা মোদি সরকারের ‘স্বাভাবিকতা প্রচারণা’র ওপর সরাসরি আঘাত।
টিআরএফ-এর কৌশলগত রূপান্তর
কাশ্মীরের আগের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো মতো টিআরএফ সোশ্যাল মিডিয়ায় সরাসরি ও উন্মুক্ত প্রচারণা চালায় না। তারা ফিরে গেছে আগের সেই ‘শ্রেণিগত গোপনীয়তা, ক্ষুদ্র অস্ত্র, লক্ষ্যভিত্তিক হামলা’-র কৌশলে।
২০২০ সালের পর থেকে টিআরএফ একাধিক পুলিশ সদস্য, অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য, এমনকি সাংবাদিকদের ওপর হামলারও দায় স্বীকার করেছে।
২০২২ সালে গোষ্ঠীটি একাধিক কাশ্মীরি সাংবাদিককে ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ আখ্যা দিয়ে হুমকি দেয়। এর ফলে তৎক্ষণাৎ অনেকে চাকরি ছাড়েন। কারণ ইতিহাস বলে, টিআরএফ যাদের নামে হুমকি দেয়, তাদের অনেকে আর জীবিত থাকেন না।
নতুন লক্ষ্যবস্তু: পর্যটক
এর আগ পর্যন্ত কাশ্মীরি বিদ্রোহীরা পর্যটকদেরকে কখনোই লক্ষ্যবস্তু করেনি। অর্থাৎ কাশ্মীরে আসা পর্যটকদের হামলার বাইরে রাখত তারা। কারণ পর্যটন ছিল কাশ্মীরের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি। কিন্তু এবারের হামলা সেই ‘অলিখিত নিয়ম’ ভেঙে দিল।
টিআরএফ মূলত এবার সরাসরি অর্থনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব তৈরির পথ বেছে নিল। এর ফলে:
- কাশ্মীরের পর্যটন শিল্প ধসে পড়বে;
- ভারতের ‘ক্যাম্পেইন অফ নর্মালসি’ ভেঙে যাবে;
- আন্তর্জাতিক মহলে কাশ্মীর নিয়ে আবার উদ্বেগ বাড়বে।
কূটনীতি না ফেরালে আগুন আরও ছড়াবে
সূতারং কাশ্মীরের মতো স্পর্শকাতর ভূখণ্ডে রাজনৈতিক সংলাপ ও জনসম্পৃক্ত কৌশল ছাড়া কেবল নিরাপত্তা-নির্ভর নীতি দীর্ঘমেয়াদে ব্যর্থ হবেই। টিআরএফ-এর মতো গোষ্ঠীগুলো সেই শূন্যতাকেই কাজে লাগাচ্ছে। সেখানে মূলত প্রতিক্রিয়া নয়, প্রয়োজন পূর্বাভাসভিত্তিক কৌশল।
পর্যটকদের রক্তে পেহেলগামের মাটি রঞ্জিত হলো। তবে ভারতের উচিত সেই রক্তের প্রতিক্রিয়ায় শুধু প্রতিশোধ না নিয়ে প্রশ্ন করা—কাশ্মীরের সত্যিকার স্বাভাবিকতা কোন পথে?
