কোনো পরিস্থিতিতে কি আত্মহত্যা জায়েজ?
মুফতি আরিফুর রহমান
প্রকাশ: ০২ অক্টোবর ২০২৫, ১১:২১ এএম
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
প্রশ্ন: এমন কোনো দুনিয়াবি কষ্ট আছে, যাতে করে আত্মহত্যা করা জায়েজ হয়ে যায়? নাকি হাজার কষ্টেও আত্মহত্যা করা না জায়েজ? সারাজীবন জাহান্নামে থাকতে হবে? কোনো ছাড় নেই?
উত্তর: জীবন শুধু আল্লাহ তায়ালার দেওয়া একটি মহান নেয়ামতই নয়, বরং এটি একটি বড় আমানতও বটে। আল্লাহ তাআলা বলেন- অতঃপর সে দিন তোমাদেরকে নিয়ামতরাজি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে (যে, তোমরা তার কী হক আদায় করেছ?) (সুরা তাকাসুর, আয়াত ৮)
আল্লাহ আমাদের এই দেহ, মন, সময় ও ক্ষমতা সবকিছুই দিয়েছেন—আমরা এগুলোর মালিক নই, বরং রক্ষক মাত্র। তিনি আমাদের জীবন আমাদের ইচ্ছামতো ব্যবহার করার জন্য দেননি।
আল্লাহ তাআলা বলেন- আমি জিন ও মানুষকে কেবল এজন্যই সৃষ্টি করেছি যে, তারা আমার ইবাদত করবে। অর্থাৎ, জীবনের মূল উদ্দেশ্য ইবাদত, আনুগত্য, ও আল্লাহর বিধান মেনে চলা—না যে, আমরা যা খুশি তাই করব। (সুরা আয-যারিয়াত, আয়াত ৫৬)
তিনি এটি একটি পরীক্ষা হিসেবে দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন- যিনি মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন তোমাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য যে, কর্মে তোমাদের মধ্যে কে উত্তম। তিনিই পরিপূর্ণ ক্ষমতার মালিক, অতি ক্ষমাশীল। (সুরা আল-মুলক, আয়াত ২)
প্রিয় বোন! এই পৃথিবী সুখের চিরস্থায়ী আবাস নয়—এটি হলো এক পরীক্ষার মাঠ, যেখানে কখনো আনন্দ আসে, আবার কখনো নেমে আসে দুঃখ-কষ্টের অন্ধকার।
আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেন, আর আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব (কখনও) কিছুটা ভয়-ভীতি দ্বারা, (কখনও) ক্ষুধা দ্বারা এবং (কখনও) জান-মাল ও ফল-ফসলের ক্ষয়ক্ষতি দ্বারা। সুসংবাদ শোনাও তাদেরকে, যারা (এরূপ অবস্থায়) সবরের পরিচয় দেয়। (সুরা বাকারা, আয়াত ১৫৫)
অন্য আয়াতে তিনি বলেন, “নিশ্চয়ই কষ্টের সঙ্গে রয়েছে স্বস্তি।” (সুরা ইনশিরাহ, আয়াত ৬)
আল্লাহ আমাদের আগেই জানিয়ে দিয়েছেন—দুঃখ-কষ্ট আসবে। কিন্তু তার সঙ্গে আশার আলোও দিয়েছেন—যারা ধৈর্য ধরে, তারা সফল হবে ইনশাআল্লাহ। তবে শয়তান এমন সময়েই আমাদেরকে হতাশ করে ফেলে, আত্মধ্বংসের পথে ঠেলে দিতে চায়। তাই আমাদের অবশ্যই ধৈর্য ধরতে হবে, এবং আল্লাহর উপর পূর্ণ ভরসা রাখতে হবে।
প্রিয় বোন! জীবন অত্যন্ত মূল্যবান। সামান্য চিন্তাও আমাদের চোখ খুলে দিতে পারে যে, জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত কত দামী। আখেরাতে যখন আর কোনো আমলের সুযোগ থাকবে না, তখন এই সময়ের সত্যিকার মূল্য বুঝে আসবে। তাই জীবনের একটি মুহূর্তও যেন নষ্ট না হয়, সে ব্যাপারে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।
আত্মহত্যা করা হারাম। কোনভাবেই তা জায়েয হতে পারে না।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন একে স্পষ্ট ভাষায় হারাম ঘোষণা করেছেন। ইরশাদ হচ্ছে- আর তোমরা নিজেদের কাউকে হত্যা করো না। নিঃসন্দেহে আল্লাহ তা’আলা তোমাদের প্রতি দয়ালু। (সুরা নিসা-২৯)
রাসুল সা. আত্মহত্যা করার ভয়াবহ শাস্তির কথা উল্লেখ করে ইরশাদ করেছেন- হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত।
রাসুল সা. ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি পাহাড়ের উপর থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে, সে জাহান্নামের আগুনে পুড়বে, চিরদিন সে জাহান্নামের মধ্যে অনুরূপভাবে লাফিয়ে পড়তে থাকবে। যে ব্যক্তি বিষপান করে আত্মহত্যা করবে, তার বিষ জাহান্নামের আগুনের মধ্যে তার হাতে থাকবে, চিরকাল সে জাহান্নামের মধ্যে তা পান করতে থাকবে, যে ব্যক্তি লোহার আঘাতে আত্মহত্যা করবে, সে জাহান্নামের মধ্যে লোহা তার হাতে থাকবে, চিরকাল সে তার দ্বারা নিজের পেটে আঘাত করতে থাকবে। (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-৫৪৪২, সুনানে নাসায়ী, হাদিস নং-১৯৬৪)
এ হাদিস দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে, আত্মহত্যাকারী লোকটি যে পদ্ধতিতে আত্মহত্যা করেছে, উক্ত পদ্ধতিতে সে জাহান্নামে চিরকাল শাস্তি পেতে থাকবে।
এ হাদিস দ্বারা যদিও আত্মহত্যাকারী চিরস্থায়ী জাহান্নামী বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু বিষয়টি আসলে এমন নয়। বরং আত্মহত্যাকারী ব্যক্তি যদি ঈমানদার হয়, আর ঈমানের সাথেই যদি মৃত্যুবরণ করে থাকে, তাহলে সে চিরস্থায়ী জাহান্নামী হতে পারে না।
চিরস্থায় জাহান্নামী হবে কেবল কাফের-মুশরিকরা। কোন মুসলমান চিরস্থায়ী জাহান্নামী হতে পারে না। তবে দীর্ঘস্থায়ী জাহান্নামী হতে পারে। এ হাদিস দ্বারা উদ্দেশ্যও এটাই। আরবের পরিভাষায় خالدا مخلداশব্দ, যার অনুবাদ করা হয়, “চিরকাল”মূলত এর দ্বারা আরবের লোকেরা কখনো কখনো দীর্ঘস্থায়ী অবস্থাকে বুঝিয়ে থাকেন।
এ হাদিসেও উদ্দেশ্যও দীর্ঘস্থায়ী হওয়া। চিরস্থায়ী হওয়া নয়। (দ্রষ্টব্য শরহু সহীহিল বুখারী লিইবনে বাত্তাল, উমদাতুল কারী)
এক কথায় আত্মহত্যা করা কবীরা গুনাহ। আর কবীরা গুনাহ তওবা দ্বারা মাফ হয়ে যায়। কিন্তু আত্মহত্যাকারী ব্যক্তির তওবার কোন সুযোগ নেই। কিন্তু তওবা না করলেও আল্লাহ তাআলা ইচ্ছে করলেই উক্ত ব্যক্তিকে নিজ রহমতে মাফ করে দিতে পারেন। কিংবা তাকে দীর্ঘস্থায়ী শাস্তি দিতে পারেন।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- নিশ্চয় আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেন না, যে তার সাথে কাউকে শরীক করে। এছাড়া যাকে ইচ্ছা, ক্ষমা করেন। যে আল্লাহর সাথে শরীক করে সে সুদূর ভ্রান্তিতে পতিত হয়। (সুরা নিসা-১১৬)
কিন্তু ঈমানদার ব্যক্তি কিছুতেই চিরস্থায়ী শাস্তি পেতে পারে না। রাসূল সা. ইরশাদ করেছেন, হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত।
রাসূল সা. ইরশাদ করেন- যে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”বলবে আর তার অন্তরে একটি যব পরিমাণও নেকী থাকবে, তাকে জাহান্নাম থেকে বের করা হবে এবং যে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” বলবে আর তার অন্তরে একটি অণু পরিমাণও নেকী থাকবে তাকে জাহান্নাম থেকে বের করা হবে। (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-৪৪, সহিহ মুসলিম, হাদিস নং-১২৫)
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে বুঝার এবং আমল করার তাওফিক দান করেন।
