স্ত্রীর চিকিৎসা খরচ বহন করা কি স্বামীর ওপর আবশ্যক?
মুফতি আবদুর রহমান হোসাইনী
প্রকাশ: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:৪৫ পিএম
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বিবাহ বন্ধনের কারণে স্ত্রীর ভরণ-পোষণ প্রদান করা স্বামীর ওপর আবশ্যক। পূর্বেকার ফুকাহায়ে কেরাম জীবনের মৌলিক প্রয়োজনীয়তা যেমন খাবার, পোশাক ও বাসস্থানকে ভরণ-পোষণের অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
তবে যুগ ও প্রচলিত রীতি-নীতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রয়োজনীয়তার ব্যাখ্যাও পরিবর্তিত হয়। বর্তমানে রোগব্যাধির আধিক্যের কারণে চিকিৎসাসেবা জীবনের প্রয়োজনীয়তার অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ চিকিৎসাসেবা ব্যতীত স্ত্রীর জন্য স্বামীর ঘরে জীবনযাপন সম্ভব নয়।
এজন্য সমকালীন অনেক ইসলামি আইন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা সেবাকে ‘নফকার’ (ভরণ-পোষণের) অন্তর্ভুক্ত হিসেবে গণ্য করেছেন। তাই সামর্থ্য অনুযায়ী স্ত্রীর চিকিৎসার খরচ বহন করা স্বামীর ওপর আবশ্যক।
পূর্বের ফুকাহায়ে কেরাম চিকিৎসার খরচ স্বামীর ওপর আবশ্যক বলে ফতওয়া না দেওয়ার অন্যতম একটি কারণ ছিল, সে সময় চিকিৎসা বিজ্ঞান এতটা উন্নত ছিল না, যতটা আজকের দিনে হয়েছে। ফলে তখন মানুষের অসুস্থতা বা রোগব্যাধি বর্তমান সময়ের মতো এত বেশি ধরা পড়তো না। তদুপরি, যদি কোনো রোগ ধরা পড়তো, তাহলে সেই রোগের চিকিৎসা ঘরোয়াভাবে করা হতো। কারণ প্রায় সব রোগের চিকিৎসাই তখন ঘরোয়া পদ্ধতিতে সম্পন্ন করা হতো।
তাছাড়া কখনও ডাক্তার দেখানোর প্রয়োজন হলেও খরচ হতো খুবই অল্প। কারণ সে যুগে চিকিৎসার খরচ বর্তমান সময়ের তুলনায় অনেক কম ছিল। এসব কারণেই সে সময়ের ফুকাহায়ে কেরাম চিকিৎসার খরচকে স্বামীর ওপর আবশ্যক বলে গণ্য করেননি।
তবে বর্তমান প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। ঘরোয়াভাবে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা একেবারেই সম্ভব নয়। অপরদিকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের অগ্রগতির কারণে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার খরচ বহুগুণ বেড়েছে। ফলে বর্তমান সময়ে স্ত্রীর চিকিৎসার খরচ স্বামীর ওপর আবশ্যক বলে ফতওয়া দেওয়া ইসলামি শরিয়াহর মূলনীতির সাথে অধিক মানানসই।
এ কারণেই সমকালীন অনেক ইসলামি আইন বিশেষজ্ঞ স্ত্রীর চিকিৎসার খরচ বহন করা স্বামীর ওপর আবশ্যক বলে ফতওয়া দিয়েছেন।
শায়খ ড. ওহবাহ আজ জুহাইলি রাহি. বলেছেন, চিকিৎসা ব্যয়: চার মাজহাবের ফকিহগণ সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে, অসুস্থ স্ত্রীর চিকিৎসার খরচ বহন করা স্বামীর ওপর ওয়াজিব নয়। যেমন চিকিৎসকের ফি, শিঙ্গা লাগানোর খরচ, রক্তপাত বন্ধ করার খরচ বা ওষুধের দাম। এগুলোর খরচ স্ত্রীর সম্পদ থেকে প্রদান করতে হবে যদি তার নিজের সম্পদ থাকে। আর যদি স্ত্রীর কোনো সম্পদ না থাকে, তাহলে যার ওপর স্ত্রীর ভরণ-পোষণের দায়িত্ব রয়েছে, তার ওপর এই খরচ বহন করা আবশ্যক হবে।
কারণ, চিকিৎসা মূলত দেহের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য প্রয়োজন, যা সুবিধা বা উপকার গ্রহণকারী ব্যক্তির ওপর আবশ্যক নয়। যেমন ভাড়া করা বাড়ির ‘মেরামত খরচ’ বাড়ির মালিকের ওপর থাকে, ভাড়াটিয়ার ওপর নয়।
আমার কাছে প্রতীয়মান হয় যে, অতীতে চিকিৎসা করা মৌলিক প্রয়োজন ছিল না। কারণ মানুষ সাধারণত স্বাস্থ্যবিধি এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা মেনে চলার ফলে চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ত না। তাই ফকিহগণের সিদ্ধান্ত তাদের সময়ের প্রচলিত রীতির ওপর ভিত্তি করে ছিল।
কিন্তু বর্তমানে চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা খাদ্য ও পুষ্টির প্রয়োজনীয়তার মতো। বরং তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ অসুস্থ ব্যক্তি সাধারণত যা দিয়ে চিকিৎসা করা যায়, সেটাকেই সবকিছুর ওপরে প্রাধান্য দেন। অসুস্থ ব্যক্তি কি তীব্র যন্ত্রণা ও কষ্টে ভোগার সময় খাবার খেতে পারবেন? এমনকি তার জীবনের ঝুঁকি থাকলে?
এজন্য আমি মনে করি, স্বামীর ওপর স্ত্রীর চিকিৎসার ব্যয় অন্যান্য জরুরি ব্যয়ের মতোই ওয়াজিব। যেমন সন্তানের চিকিৎসার ব্যয় পিতার ওপর বাধ্যতামূলক, যা সর্বসম্মতিক্রমে স্বীকৃত। আর এটি কি সঙ্গত হবে যে, স্বামী সুস্থ অবস্থায় স্ত্রী থেকে উপকৃত হবে, কিন্তু অসুস্থ অবস্থায় তাকে তার পরিবারের কাছে পাঠিয়ে দেবে চিকিৎসার জন্য ? (আল ফিকহুল ইসলামি ওয়া আদিল্লাতুহু ১০/৭৩৮১)
শাইখুল ইসলাম আল্লামা মুফতি তাকি উসমানি বলেছেন, অনুসন্ধান সত্ত্বেও কুরআন ও সুন্নাহর এমন কোনো দলিল পাওয়া যায়নি, যেখানে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, চিকিৎসার খরচ স্বামীর ওপর আবশ্যক নয়। তাই আমার মত হলো, পবিত্র কুরআনে যেখন ভরণ-পোষণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সেখানে ‘المعروف’ (প্রচলিত রীতি) এর শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে। এর অর্থ এই দাঁড়ায় যে, ভরণ-পোষণের সীমা বা ধরণ নির্ধারণ করা হয় প্রচলিত সামাজিক রীতির ওপর ভিত্তি করে।
পূর্ববর্তী যুগে যেহেতু চিকিৎসার ব্যয় খুব বেশি হত না। সম্ভবত এই কারণে সে সময়ের প্রচলিত রীতি অনুযায়ী চিকিৎসার খরচ ভরণ-পোষণের অন্তর্ভুক্ত ছিল না।
যদি এই ব্যাখ্যা সঠিক হয়, তাহলে সামাজিক রীতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই বিষয়ে বিধানও পরিবর্তন হওয়া উচিত। আর এটি স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, আমাদের এই সময়ে প্রচলিত সামাজিক রীতি অনুযায়ী চিকিৎসার খরচ ভরণ-পোষণের অংশ হিসেবে গণ্য হয়। (ফতওয়া উসমানি ২/৪৯১)


