‘জানের বদলে জান সদকা’ করা যাবে কি?
ইসলাম ও জীবন ডেস্ক
প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৬:৫৫ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
মানুষ বিপদ–আপদ, দুর্ঘটনা বা অশুভ আশঙ্কা থেকে রক্ষা পেতে অনেক সময় লোকজ বিশ্বাসে ভর করে। এর মধ্যে একটি প্রচলিত ধারণা হলো—‘জানের বদলে জান সদকা করা’, অর্থাৎ কোনো বিপদ বা মৃত্যুঝুঁকি এড়াতে পশু জবাই করে নিজের জীবনকে রক্ষা করার চেষ্টা। প্রশ্ন হলো, ইসলামে কি এমন কোনো নিয়ম আছে? এ বিষয়ে কুরআন-হাদিস কী বলে এবং ইসলামী স্কলাররা কী মত দিয়েছেন—এসবই এখানে আলোচনা করা হলো।
১. মানুষের জীবন ও মৃত্যু আল্লাহর হাতে
কুরআনে সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে, জীবন-মৃত্যু কেবল আল্লাহর বিধান, কোনো পশু জবাই দিয়ে তা বদলানো যায় না। আল্লাহ তাআলা বলেন—
وَمَا كَانَ لِنَفْسٍ أَنْ تَمُوتَ إِلَّا بِإِذْنِ اللَّهِ كِتَابًا مُؤَجَّلًا
‘আর কোনো প্রাণী আল্লাহর অনুমতি ছাড়া মারা যায় না, তা নির্দিষ্টভাবে লিখিত আছে।’ (সুরা আল-ইমরান: আয়াত ১৪৫)
আরেক আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন—
قُلۡ لَّنۡ یُّصِیۡبَنَاۤ اِلَّا مَا كَتَبَ اللّٰهُ لَنَا ۚ هُوَ مَوۡلٰىنَا ۚ وَ عَلَی اللّٰهِ فَلۡیَتَوَكَّلِ الۡمُؤۡمِنُوۡنَ
‘আল্লাহ আমাদের জন্য যা নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন তাছাড়া অন্য কিছুই আমাদের ঘটবে না, তিনিই আমাদের রক্ষক, আর আল্লাহর উপরই মু’মিনদের ভরসা করা দরকার।’ (সুরা আত-তওবা: আয়াত ৫১)
কুরআনুল কারিমের এ আয়াত থেকে বিষয়টি সুস্পষ্ট বা পরিষ্কার যে, কোনো বদলি, তাবিজ বা জবাই করা পশু মানুষের ভাগ্য বা জীবনকে বদলাতে পারে না।
২. কুরআন-হাদিসে ‘বদলি কুরবানি’ বা ‘জান সদকা’ নামে কিছু নেই
নবী (সা.) কখনো বলেননি— কারও জীবন রক্ষার্থে পশু জবাই করতে। সাহাবাদের জীবনে এমন কোনো উদাহরণও নেই।
ইসলামি শরিয়তের স্বীকৃত জবাই হলো—
> ঈদুল আজহার কুরবানি
> আকিকা
> নফল সাদাকা হিসেবে পশু জবাই (কোনো বিপদ এড়ানোর উদ্দেশ্যে নয়)
৩. বিপদ থেকে বাঁচতে ‘সদকা’ করা সুন্নাহ–সমর্থিত কিন্তু ‘জানের বদলে জান’ নয়।
সদকা করলে আল্লাহ তাআলা খুশি হন, বিপদ-আপদ দূর হয়। হাদিসে এসেছে, বিপদাপদ সদকাকে অতিক্রম করতে পারে না। নবী (সা.) বলেছেন—
السَّدَقَةُ تَدْفَعُ الْبَلَاءَ
‘সদকা বিপদ দূর করে।’
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন—
سَابِقُوا بِالصَّدَقَةِ، فَإِنَّ الْبَلَاءَ لَا يَتَخَطَّاهَا
‘তোমরা অতিসত্বর সদকার দিকে ধাবিত হও, কারণ বিপদ-আপদ সদকাকে অতিক্রম করতে পারে না। (শুআবুল ইমান ৩০৮২)
রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন—
إِنَّ الصَّدَقَةَ تُطْفِئُ سَخَطَ الرَّبِّ، وَتَدْفَعُ مِيتَةَ السُّوءِ
‘সদকা আল্লাহ তাআলার ক্রোধ প্রশমিত করে এবং খারাপ মৃত্যু থেকে রক্ষা করে। (সুনানে তিরমিজি: ৬৬৪)
এখানে ‘সদকা’ বলতে বোঝানো হয়েছে— গরিব–মিসকিনকে দান, সাহায্য, কল্যাণমূলক কাজে ব্যয়। এটি জীবন বদলি হিসেবে পশু জবাই নয়।
ইসলামি স্কলারদের মতামত
১. ইবন বায (রহ.) বলেন—
‘কারো জীবন বাঁচানোর উদ্দেশ্যে পশু জবাই করা শরিয়তে ভিত্তিহীন। এটি কুসংস্কার ও শরীয়ত-বহির্ভূত আচরণ।’ (ফাতাওয়া ইবন বায)
২. শাইখ সালিহ আল-ফাওযান (হাফি.) উল্লেখ করেন—
‘জীবন রক্ষার বদলে পশু জবাই করা জাহেলিয়াতের রীতির অংশ। মুসলমানের জন্য এ ধরনের বিশ্বাস রাখা হারাম।’
আবার অনেক আলেম বলেছেন, দুর্ঘটনা, বিপদ ও অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে জানের বদলে জান, এই ধরনের মানত করা ইসলামের শরিয়তের মধ্যে জায়েজ। কিন্তু ইসলাম এই কাজকে উৎসাহিত করে না। বরং, ইসলাম এ জাতীয় কাজে সদকার প্রতি উৎসাহিত করে। এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সদকাই উত্তম পন্থা। আর এই সদকা হতে পারে আল্লাহর জন্য পশু কোরবানি, টাকা দান করার মাধ্যমে। সদকার বিভিন্ন মাধ্যম ও উপায় আছে।
তবে জানের বদলে জানের সদকা বলির পর্যায়ে পড়বে না। কারণ বলি দেব-দেবীর নামে করা হয়ে থাকে। মুসলমানেরা আল্লাহর নামে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আল্লাহর বিধানের আলোকে এই কাজটি করে থাকেন। ফলে এটাকে বলি বলা যাবে না। তাই কেউ যদি এই ধরনের মানত করে থাকেন, তাহলে ওয়াজিব হচ্ছে, এই ধরনের মানতপূরণ করা। তবে উত্তম হচ্ছে, অসুস্থ বা সংকটগ্রস্ত মানুষের জন্য দান করে দেওয়া।
‘জানের বদলে জান সদকা’— ইসলামে এমন কোনো বিধান নেই। এটি লোকজ কুসংস্কার, যা তাওহিদ-সম্মত নয়। জীবন-মৃত্যু, বিপদ–আপদ—সবই আল্লাহর হাতে নির্ধারিত। কোনো পশু জবাই মানুষের ভাগ্য বদলাতে পারে না। তবে— সদকা, দোয়া, ইস্তিগফার, সৎকর্ম— এসবের মাধ্যমে আল্লাহর রহমত কামনা করা সুন্নাহমতে বৈধ এবং অত্যন্ত প্রশংসনীয়।

