রজব: আত্মশুদ্ধির পথে সময়ের নীরব আহ্বান
প্রকাশ: ২২ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৩:২০ পিএম
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
মানুষের জীবন প্রতিনিয়ত ছুটে চলে সময়ের স্রোতে। এই স্রোতের মাঝেই কিছু সময় আসে, যা মানুষকে থামতে শেখায়, নিজের দিকে ফিরে তাকাতে বাধ্য করে।
ইসলামি বর্ষপঞ্জিকার রজব মাস তেমনই এক সময়। এটি কোনো উৎসবের ডাক নয়, বরং আত্মসংযম, অনুশোচনা ও আল্লাহর দিকে ফিরে যাওয়ার এক গভীর নীরব আহ্বান। রজব মানুষকে বাহ্যিক ব্যস্ততা থেকে সরিয়ে এনে অন্তরের দরজায় দাঁড় করিয়ে দেয়।
সম্মানিত মাস হিসেবে রজবের কুরআনি অবস্থান
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা সময়ের গুরুত্ব ও পবিত্রতা সম্পর্কে স্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বলেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে মাসের সংখ্যা বারো—আল্লাহর কিতাবে, যেদিন তিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। এর মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত। সুতরাং তোমরা এসব মাসে নিজেদের প্রতি জুলুম করো না।” (সূরা আত-তাওবা, ৩৬)
এই আয়াত শুধু সময়ের হিসাব নয়, বরং নৈতিক দায়িত্বের ঘোষণাও বটে। ‘নিজেদের প্রতি জুলুম করো না’ এই নির্দেশনা ইঙ্গিত করে যে, এসব মাসে পাপ, অন্যায় ও সীমালঙ্ঘন থেকে দূরে থাকা আরও বেশি জরুরি।
রাসুলুল্লাহ সা. এই আয়াতের ব্যাখ্যায় চারটি সম্মানিত মাসের নাম উল্লেখ করে বলেন, “বছর বারো মাসের। এর মধ্যে চারটি হারাম মাস—যুলকাদাহ, যুলহিজ্জাহ, মুহাররম এবং রজব।” (সহিহ বুখারি, হাদিস, ৩১৯৭; সহিহ মুসলিম, হাদিস, ১৬৭৯)
এই ঘোষণার মাধ্যমে রজব মাসের মর্যাদা ও গুরুত্ব সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।
আত্মসংযম ও প্রস্তুতির সূচনালগ্ন
ইসলামি চিন্তাধারায় রজবকে রমজানের প্রস্তুতির প্রথম ধাপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সালাফে সালেহিনদের দৃষ্টিতে আত্মশুদ্ধি ছিল একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া—যার সূচনা রজবে, গভীরতা শাবানে এবং পরিপূর্ণতা রমজানে। এই দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের শেখায়, আত্মিক উন্নয়ন কখনো হঠাৎ ঘটে না, এটি সময়, সচেতনতা ও আন্তরিক চেষ্টার ফল।
রজব মাস মানুষকে নিজের জীবনের দিকে নতুন করে তাকাতে শেখায়। এই সময় একজন মুমিন নিজের ভুল, অবহেলা ও গুনাহের হিসাব নিতে পারে এবং নিজেকে সংশোধনের পথে এগিয়ে যেতে পারে।
ইবাদত ও আত্মশুদ্ধির প্রকৃত দিকনির্দেশনা
রজব মাসে নির্দিষ্ট কোনো ফরজ ইবাদত বা বিশেষ নামাজ শরিয়তসম্মতভাবে প্রমাণিত নয়। তবে এই মাসে তাওবা, ইস্তিগফার, নফল ইবাদত, কুরআন তিলাওয়াত ও দোয়ার প্রতি মনোযোগী হওয়া অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ।
রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, “আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় আমল হলো সেই আমল, যা নিয়মিত করা হয়—যদিও তা অল্প হয়।”(সহিহ বুখারি, হাদিস, ৬৪৬৪)
এই হাদিস রজব মাসে ধারাবাহিক ইবাদত ও আত্মশুদ্ধির অভ্যাস গড়ে তোলার গুরুত্ব স্পষ্ট করে।
বিদআত থেকে সতর্কতা ও সুন্নাহর ভারসাম্য
রজব মাসকে কেন্দ্র করে ইতিহাসে কিছু আমল প্রচলিত হয়েছে, যেগুলোর পক্ষে শক্ত কুরআনি বা সহিহ হাদিসি দলিল পাওয়া যায় না। ইসলাম ইবাদতের ক্ষেত্রে আবেগের চেয়ে দলিলকে অগ্রাধিকার দেয়।
রাসুলুল্লাহ সা. যেভাবে ইবাদত করেছেন, সেভাবেই ইবাদত করাই একজন মুমিনের জন্য নিরাপদ ও গ্রহণযোগ্য পথ।এই ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিই ইসলামের সৌন্দর্য—যেখানে অতিরঞ্জন নয়, বরং সংযম ও সচেতনতাই তাকওয়ার পরিচয়।
রজবের অন্তর্নিহিত শিক্ষা
রজব মাস উচ্চস্বরে কিছু করতে বলে না। এটি মানুষকে চুপচাপ নিজের অন্তরের দিকে তাকাতে শেখায়। এই মাস মনে করিয়ে দেয়, আল্লাহর দিকে ফিরে যাওয়ার জন্য বড় কোনো উপলক্ষের প্রয়োজন নেই—প্রয়োজন শুধু আন্তরিক নিয়ত, অনুশোচনা এবং পরিবর্তনের সাহস। রজব আমাদের শেখায় সময়ের মূল্য, আত্মসংযমের শক্তি এবং নীরব আত্মশুদ্ধির সৌন্দর্য। এটি এমন এক সময়, যখন একজন মানুষ নিজের ভুল স্বীকার করে আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে পারে—নতুন করে শুরু করার প্রত্যাশায়।
লেখক: শিক্ষার্থী, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়,কায়রো, মিশর



