শরিয়া আইন নিয়ে যত ভুল ধারণা, কুরআন–হাদিসের আলোকে বাস্তব চিত্র
প্রকাশ: ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১:০৮ এএম
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
শরিয়া আইন—শব্দটি শুনলেই অনেকের মনে প্রথম যে ছবি ভেসে ওঠে, তা হলো কঠোর শাস্তি বা মধ্যযুগীয় কোনো ব্যবস্থা। সংবাদমাধ্যম, আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ধারণা আরও পোক্ত হয়েছে।
কিন্তু শরিয়া আইন আদতে কী, কোথা থেকে এসেছে, কীভাবে প্রয়োগের কথা বলা হয়েছে—এসব প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর খুব কম আলোচনায় আসে।এই লেখায় শরিয়া আইনকে কোনো আবেগী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নয়, বরং তথ্য, কুরআন–হাদিস ও ইতিহাসের আলোকে দেখার চেষ্টা করেছি।
শরিয়া আইন বলতে কী বোঝায়
সহজ ভাষায় বললে, শরিয়া আইন হলো ইসলামের বিধানগত কাঠামো। এতে শুধু শাস্তিমূলক আইন নয়, বরং মানুষের দৈনন্দিন জীবন পরিচালনার দিকনির্দেশনাও অন্তর্ভুক্ত।
শরিয়ার আওতায় পড়ে, নামাজ, রোজা, জাকাতের মতো ইবাদত। বিয়ে, তালাক, উত্তরাধিকার আইন। ব্যবসা ও আর্থিক লেনদেন, সামাজিক আচরণ ও নৈতিকতা এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় ন্যায়বিচার।
কুরআনে বলা হয়েছে, তিনি তোমাদের জন্য দ্বীনের সেই পথ নির্ধারণ করেছেন, যা তিনি নূহকে দিয়েছিলেন। (সূরা আশ-শূরা, ৪২:১৩)
অর্থাৎ শরিয়া কোনো নতুন বা বিচ্ছিন্ন ধারণা নয়, এটি ইসলামের সামগ্রিক জীবনব্যবস্থার অংশ।
‘শরিয়া’ শব্দের অর্থ কোথা থেকে এলো
‘শরিয়া’ আরবি শব্দ। এর আদি অর্থ হলো পানির দিকে যাওয়ার পথ। মরুভূমির সমাজে পানি মানেই জীবন। সেই বাস্তবতা থেকেই শরিয়া শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে—জীবনকে সঠিক পথে পরিচালনার অর্থে।
কুরআনে শব্দটি সরাসরি এসেছে, ‘অতঃপর আমি তোমাকে দ্বীনের একটি সুস্পষ্ট শরিয়ার উপর প্রতিষ্ঠিত করেছি।’(সূরা আল-জাসিয়া, ৪৫:১৮)
এখানে ‘সুস্পষ্ট’ শব্দটি গুরুত্বপূর্ণ। শরিয়া গোপন বা অস্পষ্ট কোনো আইন নয়।
শরিয়া ও ফিকহ: বিভ্রান্তির একটি বড় জায়গা
খুব সাধারণ একটি ভুল হলো—শরিয়া ও ফিকহকে এক করে দেখা।
১. শরিয়া হলো আল্লাহর নির্ধারিত মূলনীতি
২.ফিকহ হলো আলেমদের ব্যাখ্যা ও বাস্তব প্রয়োগের চেষ্টা
এই কারণেই ইসলামী বিশ্বে বিভিন্ন মাজহাব রয়েছে। ইমাম আবু হানিফা, ইমাম মালিক বা ইমাম শাফেয়ি—তাদের ব্যাখ্যায় পার্থক্য থাকলেও মূল শরিয়ায় বিরোধ নেই।
ফলে কোনো দেশে ভুল বা কঠোর প্রয়োগ হলে, সেটিকে পুরো শরিয়ার সঙ্গে এক করে দেখা বাস্তবসম্মত নয়।
শরিয়া আইনের উৎস কী কী
শরিয়া আইন চারটি প্রধান উৎসের ওপর দাঁড়িয়ে আছে।
কুরআন: ইসলামী আইনের প্রধান ভিত্তি। এতে কিছু বিষয়ে সরাসরি আইন আছে, আবার অনেক ক্ষেত্রে নীতিগত দিকনির্দেশ দেওয়া হয়েছে। “আমি কিতাবে কোনো কিছুই অবহেলা করিনি।”(সূরা আল-আনআম, ৬:৩৮)
সুন্নাহ: রাসূলুল্লাহ সা.-এর কথা ও কাজ কুরআনের ব্যাখ্যা হিসেবে কাজ করে। “রাসূল তোমাদের যা দেন, তা গ্রহণ কর।” (সূরা আল-হাশর, ৫৯:৭)
ইজমা: রাসূল সা. এর পর সাহাবি ও পরবর্তী আলেমদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত।
কিয়াস: নতুন সমস্যার ক্ষেত্রে কুরআন–হাদিসের আলোকে যুক্তিনির্ভর সিদ্ধান্ত। আধুনিক মাদকদ্রব্য নিষিদ্ধ হওয়ার বিষয়টি এর একটি পরিচিত উদাহরণ।
শরিয়া আইনের মূল লক্ষ্য কী
শরিয়া আইনকে শুধু শাস্তির তালিকা হিসেবে দেখলে এর আসল উদ্দেশ্য আড়ালে থেকে যায়।
ইসলামী আইনবিদদের মতে, শরিয়ার মূল লক্ষ্য পাঁচটি বিষয় রক্ষা করা—
১. মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতা
২. জীবন ও নিরাপত্তা
৩. বুদ্ধি ও বিবেক
৪. সম্পদ
৫. মানুষের সম্মান ও পারিবারিক কাঠামো
ইমাম শাতিবি তার গ্রন্থে লিখেছেন, “শরিয়ার সব বিধান মানুষের কল্যাণের জন্য।”
এই লক্ষ্যগুলো মাথায় না রাখলে শরিয়ার কোনো বিধান বোঝা সম্ভব নয়।
দণ্ডবিধি নিয়ে যে বিষয়গুলো প্রায়ই বলা হয় না
শরিয়া আইন নিয়ে আলোচনায় সবচেয়ে বেশি আসে দণ্ডবিধির প্রসঙ্গ। কিন্তু কয়েকটি বাস্তব দিক প্রায়ই উপেক্ষিত থাকে।
প্রথমত, শরিয়ার শাস্তিমূলক আইন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নিজের মতো করে প্রয়োগ করতে পারে না। এটি কেবল রাষ্ট্রীয় বিচারব্যবস্থার বিষয়।
দ্বিতীয়ত, প্রমাণের মানদণ্ড অত্যন্ত কঠোর। যেমন, ব্যভিচারের অভিযোগ প্রমাণে চারজন নির্ভরযোগ্য সাক্ষীর শর্ত রয়েছে (সূরা আন-নূর, ২৪:৪)।
তৃতীয়ত, সন্দেহ থাকলে শাস্তি কার্যকর করা যায় না। রাসূল সা. বলেছেন, “সন্দেহের ক্ষেত্রে শাস্তি রহিত করো।” (সুনান তিরমিজি, ১৪২৪)
এই কারণেই ইসলামী ইতিহাসে বাস্তবে দণ্ড কার্যকরের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে খুবই কম।
শরিয়া মানা কি মুসলমানের জন্য বাধ্যতামূলক
ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে শরিয়া মানা ঈমানের সঙ্গে সম্পর্কিত।
কুরআনে বলা হয়েছে, যারা আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তা দিয়ে বিচার করে না—তারাই জালিম। (সূরা আল-মায়িদা, ৫:৪৫)
আরও বলা হয়েছে, তারা ঈমানদার হতে পারে না, যতক্ষণ না রাসূলকে বিচারক মানে। (সূরা আন-নিসা, ৪:৬৫)
তবে এখানে শরিয়া মানা বলতে কেবল শাস্তি নয়, বরং ন্যায়, সততা ও দায়িত্বশীল আচরণকেও বোঝানো হয়েছে।
ইতিহাসে শরিয়া আইনের প্রয়োগ
মদিনা সনদকে অনেক ইতিহাসবিদ বিশ্বের প্রথম লিখিত সামাজিক চুক্তিগুলোর একটি হিসেবে উল্লেখ করেন। সেখানে মুসলিম ও অমুসলিম সবার অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছিল।
খলিফা উমর (রা.)–এর শাসনামলে শাসক নিজেই আদালতে হাজির হয়েছেন, এই ঘটনা ইসলামী ইতিহাসে সুপরিচিত।
এতে বোঝা যায়, শরিয়া কেবল শাসিতদের জন্য নয়, শাসকদের জন্যও সমানভাবে প্রযোজ্য ছিল।
লেখক: শিক্ষার্থী, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়,কায়রো, মিশর

