Logo
Logo
×

ইসলাম ও জীবন

ভারতবর্ষে চিশতিয়া সিলসিলার ইতিহাস

Icon

মুহাম্মাদ রবিউল হক

প্রকাশ: ০৭ জুন ২০২০, ০৩:৩১ পিএম

ভারতবর্ষে চিশতিয়া সিলসিলার ইতিহাস

ছবি: সংগৃহীত

কোরআনের ভাষায় যা ‘তাযকিয়াতুন নাফস’ হাদিসের ভাষায় যা ‘ইহসান’ কালক্রমে তাই পরিভাষায় ‘তাসাউফ’ নাম ধারণ করেছে। 

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাসাউফের প্রসিদ্ধ চার তরিকা বা সিলসিলা; কাদেরিয়া, সোহরাওয়ার্দীয়া,চিশতিয়া ও নকশবন্দিয়ার প্রসর লাভ করে।

অবশ্য এই চার শাখার বিভিন্ন উপ-শাখাও বিশ্বময় ইসলামের ব্যাপক খেদমত আঞ্জাম দিয়েছে এবং এখনও  দিচ্ছে।

ভারতবর্ষে ইসলাম প্রচার-প্রসারে, দাওয়াত-তাজদিদের ক্ষেত্রে এবং ইসলামী সভ্যতা-সংস্কৃতির ভিত্তি ও কাঠামো বিনির্মাণে এই চার সিলসিলার অবদান অনস্বীকার্য।  

তবে ভারত উপমহাদেশে দ্বীনের প্রচার-প্রসারের জন্য মহান আল্লাহ চিশতিয়া সিলসিলাকে নির্বাচন করেন এবং এই তরিকার ধারক-বাহকদের রুখ-গতি ভারতবর্ষমুখী করে দেন।

এই উপমহাদেশে যার মাধ্যমে চিশতিয়া তরিকার আগমন তিনি খাজা আবু মুহাম্মাদ চিশতি (র.)। 

মাওলানা জামি’র ‘নাফহাতুল উনস’ নামক গ্রন্থের মতে ‘তিনি গায়েবি নির্দেশনা অনুযায়ী সুলতান মাহমুদ গজনির সঙ্গে সোমনাথ অভিযানে ৭০ বছর বয়সে জিহাদে শরিক হোন।’

উল্লেখ্য, ভারত উপমহাদেশে ইসলাম আগমন যার হাত ধরে বা যাকে মুসলিম ভারতের স্থপতি বলা হয় তিনি হলেন মুহাম্মাদ ইবন কাসিম ছাকাফি (৯৩ হিজরি) (র.)। তিনি সিন্ধু থেকে মুলতান পর্যন্ত ইসলামের নিশান উড়িয়েছিলেন।

কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ভারতবর্ষ বিজয়ের সৌভাগ্য সুলতান মাহমুদ গজনবি (৪৪১ হি.) অর্জন করেন, আর ভারতবর্ষে  সুদৃঢ় ইসলামী সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপনের কৃতিত্বের দাবিদার সুলতান শিহাবুদ্দীন মুহাম্মাদ ঘোরি (৬০২ হি.)।

এখানে আধ্যাত্মিক, নৈতিক ও ঈমানী বিজয় প্রতিষ্ঠার মূল স্থপতি হলেন শায়খুল ইসলাম খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতি (র.) (৬২৭ হি.) যিনি চিশতিয়া সিলসিলারই অন্যতম মুজাদ্দিদ ছিলেন। 

খাজা সাহেব সুলতান শিহাবুদ্দীন ঘোরীর সেই সব সেনাবাহিনীর সঙ্গে ছিলেন যারা আজমিরের রাজা রায় পাথুরা (পৃথ্বিরাজ)কে পরাজিত করে ভারতবর্ষের বিজয়কে পূর্ণতা দান করেছিলেন।

খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতির (র.) জীবদ্দশায়ই ভারতবর্ষের রাজধানী আজমির থেকে দিল্লীতে স্থানান্তরিত হয় এবং খাজা সাহেব তার স্থলাভিষিক্ত হিসেবে খাজা কুতবুদ্দীন বখতিয়ার কাকিকে (র.) দিল্লীতে অধিষ্ঠিত করেন।

খাজা বখতিয়ার কাকি (র.) তার স্থলাভিষিক্ত হিসেবে খাজা ফরিদুদ্দীন গঞ্জে শকরকে (র.) (যিনি শায়খুল কবির নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন) তার ‘খিরকা’ ও ‘লাঠি’ প্রদান করে যান। 

খাজা ফরিদুদ্দীন গঞ্জে শকর (র.) মুলতানের ‘আজুদহন’ নামক স্থানে খানকা স্থাপন করেন। এটা ছিল সুলতান নাসিরুদ্দিন মাহমুদ ও গিয়াস উদ্দীন বলবনের শাসনকাল। 

তার সমসাময়িক ছিলেন সোহরাওয়ার্দী সিলসিলার খ্যাতনামা মুরশিদ শায়খুল ইসলাম বাহাউদ্দীন যাকারিয়া মুলতানি (র.)। এটা ছিল সুলতান নাসিরুদ্দিন মাহমুদ ও গিয়াস উদ্দিন বুলবনের শাসনামল।

হজরত খাজা গঞ্জে শকরের (র.) দুইজন খলিফা; সুলতানুল মাশায়িখ খাজা নিজামুদ্দীন দেহলবি (র.) ও খাজা আলাউদ্দিন আলি সাবির পিরানে কলীরির (র.) মাধ্যমে এই সিলসিলার সুখ্যাতি দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে এবং তাদের সিলসিলার অন্য লোকদের মাধ্যমে এখন পর্যন্ত তা সঞ্জীবন ও প্রতিষ্ঠিত রয়েছে।

সুলতানুল মাশায়িখ খাজা নিজামুদ্দীন আউলিয়া (র.) সায়্যিদ বংশীয় ছিলেন। তার পূর্বপুরুষ বোখারা থেকে এসে লাহোরে অবস্থান করেন এবং পরে বাদায়ূনে স্থায়ী হোন ও দিল্লীতে খানকা প্রতিস্থাপন করেন। 

তিনি চিশতিয়া নিজামিয়া সিলসিলা প্রতিষ্ঠা করেন এবং বায়াত ও তরবিয়াতের মাধ্যমে তরবিয়াত ও সংস্কারের কাজ আঞ্জাম দিতে থাকেন।

সুলতানুল মাশায়িখের (র.) খলিফাদের মধ্যে সায়্যিদ নাসিরুদ্দীন মাহমুদ চেরাগে দিল্লীকে তার স্থলাভিষিক্ত করে যান। 

যার খ্যাতি দুনিয়াব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। সুলতান জালাল উদ্দিন খিলজির সচিব ও সভাকবি আমির খসরু, ‘তারিখে ফিরোজ শাহি’র লেখক কাজি জিয়াউদ্দিন বারনি সুলতানুল আউলিয়া র.-এর মুরিদ ছিলেন।

শায়খ নাসিরুদ্দিন চেরাগে দিল্লী (রহ.) মুরিদ ও খলিফাদের মধ্যে শায়খ আহমদ থানেশ্বরি, মাওলানা খাওয়াজগি দেহলবি ও তার প্রিয় শাগরেদ কাজি শিহাবুদ্দীন আহমদ (শরাহ কাফিয়া' যা 'শরাহ হিন্দি' নামে আরব-আজমে বিখ্যাত-এর লেখক)।  

হাশিয়া (টিকাকার) লেখকদের মধ্যে আল্লামা গাযরূনি এবং মীর গিয়াস উদ্দিন মানসুর শিরাজিও শায়খ চেরাগে দিল্লীর মুরিদ ছিলেন। 

‘দরসে নিজামি’র (বিশ্বব্যাপী যার খ্যাতি সর্বজনস্বীকৃত) প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা নিজামুদ্দীনর খলিফা ও বংশধর এই সিলসিলার সঙ্গে রূহানী সম্পর্ক রাখতেন। 

নিজামিয়া চিশতিয়া সিলসিলার মহান বুযর্গগণ জ্ঞান-বিজ্ঞান,সাহিত্য-পাণ্ডিত্য এবং দরস-তাদরিসের এমন খেদমত-আঞ্জাম দিয়েছেন যা ইতিহাসে পাতায় সংরক্ষিত রয়েছে।

নিজামুদ্দীন আওলিয়ার পূর্বে চিশতিয়া সিলসিলার মাশায়েখগণের জীবনী, ‘মালফুযাত’ বা ‘মাকতুবাত’ সংরক্ষণের রেওয়াজ ছিল না। 

সুলতানুল আউলিয়াই প্রথম তার মালফুজাতসমূহ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন যা ‘ফাওয়াইদুল ফুয়াদ’ নামে প্রসিদ্ধ।

খাজা আলাউদ্দিন আলি সাবির পিরানে কলীরি যিনি শায়খুল কবির গঞ্জে শকরের মু’জায এবং সাবিরিয়া চিশতিয়া সিলসিলার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তার সম্পর্কে ইতিহাসে তেমন স্পষ্ট আলোচনা পাওয়া যায় না। 

আশ্চর্যজনক বিষয় হল এই মহান বুযর্গ সম্পর্কে  ইতিহাস নীরব থাকলেও তার প্রতিষ্ঠিত সিলসিলার মাধ্যমে মহান আল্লাহ্  উচ্চ মর্যাদা, জ্ঞান ও প্রজ্ঞা,দূরদৃষ্টিসম্পন্ন অধিকন্তু আল্লাহর কাছে মাকবুল ও প্রিয় বান্দাদের দ্বারা খিদমত নিয়েছেন যাদের ফয়েজ-বরকত সারা পৃথিবীর মানুষকে শিক্ত করেছে এবং এর ধারাবাহিতা এখনও চলমান রয়েছে।

সাবিরিয়া চিশতিয়া সিলসিলার যে সব মাশায়িখ, আরিফ,মুহাক্কিক ও সংস্কারক জন্মেছেন তাদের মধ্যে মাখদুম আহমদ আব্দুল হক রুদাওলভি। যাকে অনেকে হিজরী নবম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ হিসেবে পরিগণিত করেছেন। 

শায়খ আব্দুল কুদ্দুস গাঙ্গুহি, শায়খ মুহিব্বুল্লাহ এলাহাবাদী,শায়খুল আরব ওয়াল আজম হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কি, কুতুবুল ইরশাদ রশীদ আহমদ গাঙ্গুহি, কাসিমুল উলুম কাসিম নানুতবি (যিনি দারুল উলুম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতা), হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলি থানবি, শায়খুল হিন্দ মাহমুদ হাসান দেওবন্দি, শায়খ খলিল আহমদ সাহারানপুরি, শায়খ আব্দুর রহিম রায়পুরি, শায়খ হুসাইন আহমদ মাদানি, মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলবি (তাবলিগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা), শায়খুল হাদিস যাকারিয়া কান্ধলবি, মাওলানা আব্দুল কাদির রায়পুরি, মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী, সাইয়্যিদ আবুল হাসান আলি নদভি প্রমুখ। 

দারুল উলুম দেওবন্দ ও মাজাহিরুল উলুমের তা’লিমি খেদমত,আশরাফ আলি থানবির লেখনি আর মাওলানা ইলিয়াসের দাওয়াত ও তাবলিগের দ্বারা এই সিলসিলার ফয়েজ বিশ্বময় প্রসার লাভ করেছে।

‘তারিখে মাশায়িখে চিশত’ গ্রন্থের লেখক অধ্যাপক খালিক আহমদ নিজামি বলেন, বিগত শতাব্দীগুলোতে কোনো বুজর্গই চিশতিয়া সিলসিলার সংস্কারমূলক মৌলিক নীতিগুলো এমনভাবে চুষে নিতে সক্ষম হয়নি যেমনটি মাওলানা ইলিয়াস সক্ষম হয়েছেন। (পৃ:২৩৪)

বর্তমানে বিশ্বব্যাপী সাবিরিয়া চিশতিয়া সিলসিলার খেদমতের বর্ণনা দিতে হলে স্বতন্ত্র নিবন্ধের প্রয়োজন।


লেখক: শিক্ষক, মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ


 

চিশতিয়া সিলসিলা

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম