Logo
Logo
×

ইসলাম ও জীবন

ফিলিস্তিন রক্ষায় সুলতান আব্দুল হামিদের অবদান

Icon

ইয়াহইয়া নাদিম

প্রকাশ: ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ০৯:৩০ পিএম

ফিলিস্তিন রক্ষায় সুলতান আব্দুল হামিদের অবদান

মজ্জাগতভাবে ইহুদিরা বিশ্বাসঘাতক। চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র, গুপ্তহত্যা, স্বার্থপরতা, লিপ্সা, ওয়াদাভঙ্গ ইত্যাদি তাদের স্বভাব। এই নিকৃষ্ট স্বভাবের কারণে তারা অভিশপ্ত হয়েছে। 

তাদের স্বভাবের পরিচয় দিয়ে পবিত্র কুরআনে বহু আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে। এই হীন চরিত্র ও বিশ্বাস ঘাতকতার কারণে তারা বিতাড়িত হয়েছে বিভিন্ন দেশ থেকে। 

কোনো কালে কোনো যুগে একটি দেশও তাদেরকে আশ্রয় দিতে রাজি হয়নি। অবশেষে ঊনবিংশ শতাব্দিতে ইহুদি পণ্ডিতেরা ষড়যন্ত্র ও ছলচাতুরির আশ্রয় নিয়ে নিজ সম্প্রদায়ের জন্য একটি আবাসভূমি গড়ে তোলার পরিকল্পনা গ্রহন করে।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে, ‘জায়নবাদী আন্দোলন’ একটি পরিকল্পনা হিসাবে আবির্ভূত হয়। যার লক্ষ্য ছিল ইহুদিদের জন্য একটি জাতীয় স্থায়ী আবাসভূমি তৈরি করা। আন্দোলনটি পূর্ব ও মধ্য ইউরোপের ইহুদিদের মধ্যে খুব জনপ্রিয়তা লাভ করে। এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন বিখ্যাত অস্ট্রিয়ান সাংবাদিক থিওডর হার্জল (১৮৬০-১৯০৪খ্রি.), যিনি১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে সুইজারল্যান্ডের বাসেলে সর্ব প্রথম জায়নিস্ট সম্মেলন করতে সক্ষম হন।  

তার টার্গেট ছিল ধনী প্রভাবশালী ও মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের বোঝানো এবং তার আন্দোনলের প্রতি সমর্থন অর্জন করা। তবে এই আবাসভূমি কোথায় হবে, এক্ষেত্রে ২টি প্রস্তাবনা পাওয়া যায়। একটি হলো উগাণ্ডা, ২য়টি হলো আর্জেন্টিনা। কিন্ত তিনি  

ফিলিস্তিনকেই বেছে নেন একটি স্থায়ী আবাসভূমি তৈরি করার জন্য, এবং সবাইকে ফিলিস্তিনের গুরুত্ব  বুঝানোর চেষ্টা করেন। অবশেষে সবাই তার প্রস্তাবনায় সম্মত হয়। উদ্দেশ্যে সফল করতে অনুদান সংগ্রহ করে আর্থিক ফাণ্ড তৈরি করার জন্য সেই সম্মেলনেই একটি সংস্থার গোড়াপত্তন করে। যার নাম দেয়  ‘ইহুদি সংস্থা’। সাংগঠনিকভাবে প্রস্তাবিত এই আবাসভূমির দিকে পাড়ি জমাতে সকল ইহুদিদের মাঝে ব্যাপক প্রচারণা শুরু হয়।

সুলতান আবদুল হামিদের সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টা

পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য জায়োনিস্ট সংগঠনটি শক্তিধর দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ জোরদার করে। ইউরোপীয় দেশগুলোর প্রভাবশালী লিডারদের সঙ্গে, বিশেষ করে জার্মানের কায়সার উইলিয়ামের সঙ্গে সংগঠনটির ভালো সম্পর্ক ছিলো।

এদিকে সুলতান হামিদ সামরিক শিল্প আধুনিকীকরণ এবং বার্লিন-বাগদাদ রেলওয়ের মতো বিশাল প্রকল্প স্থাপন করার মধ্যে দিয়ে এই অঞ্চলে ব্রিটিশ ও ফরাসি সম্প্রসারণ প্রতিহত করার প্রয়াসে জার্মানের কায়সার উইলিয়ামের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রেখেছিলেন। জায়োনিস্ট সংগঠনটি এই সম্পর্কের সুবিধা নিয়ে সুলতান হামিদের সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টা করে। 

হার্জল তার প্রভাবশালী বন্ধুদের মাধ্যমে জার্মান সম্রাটকে ইহুদিবাদী আন্দোলনের লক্ষ্য সম্পর্কে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন, এবং জায়নবাদী আন্দোলন সম্মেলনের এক বছর পরে সম্রাটের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। 

জার্মান কায়সার হার্জলকে বলেছিলেন: “মাত্র একটি সংক্ষিপ্ত শব্দে বলুন, আমি সুলতানের কাছে কী চাইবো? হার্জল তাকে উত্তর দিল: সুলতানের কাছে আপনি সুপারিশ করবেন, তিনি যেন জার্মানের নিরাপত্তার অধীনে আমাদেরকে একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করার অনুমতি দেন।

জার্মান সম্রাট সুলতানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এ প্রস্তাবনা পেশ করলে সুলতান তা কঠোরভাবে প্রত্যাখান করেন। বস্তুত তিনি দূরদর্শীতার মাধ্যমে ইহুদিদের দূরভিসন্ধি বুঝতে পেরেছিলেন। 

উসমানী সাম্রাজ্য তখন কঠিন অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি  ছিলো। তাই হার্জল ভাবলো, সুলতানকে লোভনীয় কোনো প্রস্তাব দিলে হয়তো তিনি রাজি হবেন। তাই তিনি ১৮৯৬ ও ১৯০২ এর মাঝামাঝি সময়ে ৫ বার ইস্তাম্বুলে সফর করেন। এক সময় তিনি সুলতানের অস্ট্রিয়ান ইহুদি বন্ধু নিউলিনস্কির মধ্যস্থতায় সুলতানের সঙ্গে দেখা করতে সফল হয়।

হার্জলকে তাড়িয়ে দিলেন সুলতান

হার্জল তার ডায়েরীতে লিখেন, ১৯০১ সালে সুলতানের সঙ্গে সাক্ষাত করে নিম্নোক্ত প্রস্তাবনা পেশ করে: মাননীয় সুলতান, অটোমান সাম্রাজ্য ১৮৭৮ সালে সাইপ্রাস দ্বীপটি নিজ সাম্রাজ্যর অন্তর্ভূক্ত করে নিয়েছে। আমাদের আবেদন, সেই দ্বীপটি বৃটেনকে ফেরত দিন। তাহলে আমরাও আপনাকে একটা বিষয়ের নিশ্চয়তা দেই। তা হলো: বৃটেন কর্তৃক সহযোগীতার ফলে আরমেনিয়া ইস্যুটি খিলাফতে উসমানীয়াকে সংকটে ফেলেছে, এবং পূর্ব আনাদোলের ঐক্যকে হুমকির মুখে ফেলেছে। ইহুদি সংগঠনটি বৃটেনের সকল প্রকার সাহায্য সহযোগীতা বন্ধ করে দিবে। 

সুলতান এই প্রস্তাবের জবাবে বলেন, দেখুন, এই সম্পত্তির মালিক আমি নই। মালিক হলো জনগন। রক্তের বিনিময় তারা এই জমিন অর্জন করেছে। সুতরাং আমি তা কিছুতেই বিক্রি করতে পারবোনা। যদি কেউ তা নিতে চায়, তাহলে রক্তের মূল্যেই নিতে হবে। আর আমরা ও এই জমিন রক্ত দিয়ে হিফাজত করবো ইনশাআল্লাহ। 

হার্জল হাল ছাড়লোনা। সে ভাবলো, খিলাফাতে উসমানিয়া ঋণে জর্জরিত। কাজেই সুলতানকে লোভনীয় কোনো প্রস্তাব দিলে তিনি রাজি হবেন। তাই সে সুলতানকে পাঁচ মিলিয়ন স্বর্ণ লিরার প্রস্তাব দিয়ে বললো, জাহাঁপনা! আপনি ইহুদিদেরকে ফিলিস্তিনে হিজরতের অনুমতি দিন এবং তাদের পক্ষ থেকে এই উপঢৌকন গ্রহন করুন।  তারা আপনার অনুমতি ও অনুগ্রহের আশায় রয়েছে। 

সুইজারল্যান্ডের বাসেলে সর্ব প্রথম জায়নিস্ট সম্মেলনের পর সুলতান সংগঠনটির কার্যক্রম তার নেতা কর্মী বিশেষ করে হার্জল , গুরুত্বপূর্ণ কিছু সাংবাদিক ও লেখকদের গতিবিধি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষন করছিলেন ইউরোপে থাকা গোয়েন্দাদের মাধ্যমে। অবশেষে তিনি বুঝতে পারলেন যে, সংগঠনটির তৎপরতা এবং ষড়যন্ত্র সুদূরপ্রসারী। তাই পরবর্তীতে হার্জল যখন পুনরায় তার সাক্ষাতে আসে, তখন তিনি হার্জলকে তার সঙ্গীসহ তাড়িয়ে দেন। 

সুলতান আবদুল হামিদ তার ডায়েরিতে বৈঠকের বিস্তারিত উল্লেখ করেছেন, যেখানে তিনি লিখেছেন: প্রাচ্যে ইহুদিদের যতটুকু শক্তি ও দাপট আছে তার  চেয়ে বেশি শক্তি ও প্রভাব রয়েছে ইউরোপে। আর এই কারণেই বেশিরভাগ ইউরোপীয় দেশ ফিলিস্তিনে ইহুদিদের অভিবাসনের পক্ষে। এই নিকৃষ্ট  জাতি থেকে পরিত্রাণ তারা ও চায়। অবশ্যই ফিলিস্তিনে অভিবাসীদের পুনর্বাসনের পরিকল্পনা ও চিন্তার বিরুদ্ধে আমাদের শক্তভাবে দাঁড়াতে হবে। জায়নবাদীদের নেতা হার্জল কখনো আমাকে তার পরিকল্পনা ও ইচ্ছা বোঝাতে সক্ষম হবেনা। সে মূলত ফিলিস্তিনে কৃষিকাজ করে তার ইহুদি ভাইদের জন্য জমিন সুরক্ষিত করতে চাইছে, যাতে করে দীর্ঘমেয়াদি অবস্থানে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তাদের সমস্যায় পড়তে না হয়, এবং ধীরে ধীরে ফিলিস্তিনে ইহুদি অভিবাসনের‌ শেকড় মজবুত করা যায়। 

কুদসে সুলতান আব্দুল হামিদের অবদান

ইহুদিবাদী আন্দোলন এবং ফিলিস্তিনে ইহুদি অভিবাসনের পরিকল্পনা সংগঠনটির সম্মেলনের অন্তত দুই দশক আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। বিশেষ করে যখন রাশিয়ান ইহুদিদের উপর দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়ার পর যখন ইউরোপীয় দেশগুলিতে  তাদেরকে কোণঠাসা করার জন্য অভিযান চালানো হয়। 

তবে ফিলিস্তিনে ইহুদি অভিবাসীদের শতাংশ সেই সময়ে মোট ইহুদি অভিবাসনের ২% এর বেশি ছিল না। কিন্তু এই শতাংশের সংখ্যা কম থাকা সত্ত্বেও কুদসের  উসমানী গভর্নর এই অভিবাসীদের গভীরভাবে লক্ষ্য রাখেন‌ এবং তাদের ইস্তাম্বুলে পাঠিয়ে দেন। উসমানীয় খলিফা ইহুদিদের দুরভিসন্ধি বুঝতে পেরে ফিলিস্তিনে বসতি স্থাপনের আবেদন কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করেন। 

ইহুদিরা ব্যর্থ হয়ে ছল চাতুরির আশ্রয় নেয়। ফিলিস্তিনে দীর্ঘ সময় অবস্থানের জন্য তারা‌ উসমানী দূতাবাস থেকে হজ্জের ভিসা নিয়ে কুদসে প্রবেশ করে। এরপর তারা ইউরোপীয় দেশগুলির কাছ থেকে, বিশেষ করে ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের কাছ থেকে একটি পুরানো আইনের অধীনে নিরাপত্তা চায়। কেননা পূর্ব থেকে ইউরোপীয় দেশগুলি এবং উসমানীয় সাম্রাজ্যের মধ্যে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা প্রদানের ব্যাপারে চুক্তি ছিল। 

সুলতান ইহুদিদের চালাকি বুঝতে পেরে ভিসা নিয়ে কুদসে প্রবেশের ক্ষেত্রে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করে কুদসের‌ গভর্নর বরাবর চিঠি লিখে বেশ কয়েকটি ফরমান জারি ১৮৮৪ সালের এই ফরমানে তিনি লিখেন:

এক- কুদসে প্রবেশ করতে হলে ইহুদিদের সঙ্গে অবশ্যই উসমানীয় দূতাবাস থেকে প্রদত্ত ভিসা থাকতে হবে। দুই - কুদসে প্রবেশ করে ৩০ দিনের বেশি থাকতে পারবেনা। 

তিন - ৩০ দিনের বেশি অবস্থান করলে উসমানীয় সাম্রাজ্য কোনো নিরাপত্তা প্রদান করবেনা। চার- ৩০দিন পর কুদস থেকে প্রস্থানের ব্যপারে কুদসের গভর্নরকে নিশ্চয়তা দিতে হবে। 

১৮৯০ এবং ১৮৯১ সালে সুলতান আবদুল হামিদ তিনটি শাহী ফরমান জারি করেন-

(এক)  ইহুদি অভিবাসীদের আমেরিকায় তাড়িয়ে নির্দেশ দেন। কারণ তাদের উপস্থিতি ভবিষ্যতে কুদসে একটি ইহুদি হুকুমত প্রতিষ্ঠার দিকে পরিচালিত করবে। 

(দুই) ইহুদিদের ফিলিস্তিনে বসতি স্থাপন করতে দেওয়া যাবে না, কারণ তাদের অস্তিত্ব কুদসের জন্য ক্ষতিকর। 

(তিন) ইহুদি অভিবাসন এবং তাদের জন্য কৃষিকাজের কোনো অনুমতি নেই। বরং এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতা জরুরি। কেননা এর দ্বারা তাদের লক্ষ্য হল একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা এবং ফিলিস্তিনি জনগণের ক্ষতি করা ও পর্যায়ক্রমে তাদের উৎখাত করে ভূমি দখল করা। এই কারণেই তিনি ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে কুদসের গভর্নরের প্রতি নির্দেশ জারি করে বলেন , ফিলিস্তিনে সরকারি জমি (উসমানীয় জমি) ইহুদিদের কাছে বিক্রি করা নিষিদ্ধ! এমনকি তারা উসমানীয় প্রজাও হলেও। 

একই সময়ে সুলতান আব্দুল হামিদ কুদসে এবং সেখানের জনগণের জন্য সকল ধরণের সুবিধা প্রদান করেন এবং সম্ভাব্য সকল উপায়ে সমর্থন করতে আগ্রহী ছিলেন। এছাড়াও তিনি কুদসের শিক্ষার্থীদের জন্য উসমানীয় স্কুল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে, বিশেষ করে ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির দরজাও খুলে দিয়েছিলেন। এর অনেক প্রমাণ রয়েছে। 

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ডাক্তার হুসাম আবু আল-সৌদ যিনি উনিশ শতকের শেষের দিকে উসমানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করেছিলেন এবং দরিদ্র কুদসবাসীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা প্রদানের ক্ষেত্রে খ্যাত ছিলেন। এমনকি তাদের বিনামূল্যে ওষুধও সরবরাহ করেছিলেন তিনি। 

এছাড়াও  আলী আল-নাশাশিবি, যিনি একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পশুচিকিৎসা বিষয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। নাজিফ আল-খালিদি, যিনি সুলতান আব্দুল হামিদের আমলে ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে পড়াশোনা করেছিলেন এবং পরে হেজাজ রেলওয়ে প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছিলেন।

কুদস ও ফিলিস্তিনের ইতিহাসবিদ আরিফ আল-আরিফ কুদসে সুলতান আব্দুল হামিদের অনেক অবদান ও  সুযোগ-সুবিধার কথা উল্লেখ করেছেন, বিশেষ করে ৮৭ কিলোমিটার দীর্ঘ কুদস-ইয়াফা রেলপথ, যা নির্মাণ করতে (১৮৮৯ থেকে ১৮৯২ সালের মধ্যে ) তিন বছর লেগেছিল। 

এই রেলপথ কুদসের বাসিন্দাদের যাতায়াত ব্যবস্থাকে সহজতর এবং স্থানীয় অর্থনীতি গতিশীল করেছিল। এর ফলে ভূমধ্যসাগরের ইয়াফা বন্দরের তুলনায় এটিতে প্রবেশ করা সহজ হয়েছিল। আবদুল হামিদ ফিলিস্তিনের পবিত্র নগরীর অবকাঠামোর উন্নতি এবং সংস্কারের দিকেও মনোযোগ দিতে বেশ আগ্রহী ছিলেন। 

১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি কুদসের রাস্তা এবং গলি থেকে পুরনো টাইলস সরিয়ে ফেলেন এবং নতুন টাইলস প্রতিস্থাপন করেন। ঐতিহাসিক আল আরিফের বর্ণনা অনুসারে বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশক পর্যন্ত এই টাইলস  বিদ্যমান থাকে।

কুদসে সুলতান আব্দুল হামিদ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলির মধ্যে থেকে উল্লেখযোগ্য হলো তিনি কুদস শহরের পশ্চিমে শেখ বদর মহল্লায় পৌর হাসপাতাল নির্মাণ করেন। ১৯০৫ সালে কুদসের  ইঞ্জিনিয়ারদের সহায়তায় তিনি টেলিফোন নেটওয়ার্ক নির্মাণ করেন। 

১৯০৯ সালে ইয়াফা গেটের উপর ঘড়ির টাওয়ারটিও তাঁর নির্মিত। যদিও সুলতান সুলেমান আল-কানুনী কুদসে পানির সমস্যা নিরসনের জন্য ‘সুলতান পুল’ তৈরি করেন, যা কুদস শহরে সারা বছর‌ পানি  সরবরাহ করত।  কুদস শহরে তিনি অনেক পানির ফোয়ারা ও তৈরি করেন। তবে তার নাতি সুলতান আব্দুল হামিদের পুরনো ফোয়ারাগুলি সংস্কার এবং আরো নতুন নতুন ফোয়ারা নির্মাণ করার আগ্রহ ছিল। 

১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে সুলতান আব্দুল হামিদ শহরের প্রাচীর সংলগ্ন বাব আল-খলিল তথা খলিল গেটে  পানির লাইন বা ঝর্ণা নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, কিন্তু ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে কুদস দখলের পর ব্রিটিশরা তা ভেঙে ফেলে। সুলতান আবদুল হামিদ কুদসের হেরেমে বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত পানির লাইন ও ফোয়ারা, পশ্চিমে (বাব আল-কাত্তানিন) কাত্তানিন গেটের ফোয়ারা এবং পাথরের সিঁড়ি পুনর্নিমাণ করেন‌ একই সঙ্গে মামলুক সুলতান কাইতবে ফোয়ারাও  সংস্কার করেন।

সুলতান আব্দুল হামিদ কুদস শহরে আরো অন্যান্য উন্নয়ন প্রকল্প প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন, যেমন কুদসে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে পানির চাহিদা পূরণ এবং খরার মৌসুমে পানির সংকট দূর করতে শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত আরতাস গ্রাম থেকে শহরের দিকে পানি স্থানান্তর করতে চেয়েছিলেন।

কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো, ইংরেজরা ১৯২৫ সালে এই পানি অন্যদিকে সরিয়ে নেয়। সুলতান আব্দুল হামিদ শহরের ধর্মীয় স্থাপনাগুলোর দিকেও মনোযোগ দেন, বিশেষ করে আল-আকসা এবং মসজিদে কুব্বাতুস সাখরার সংস্কারের প্রতি গুরুত্ব দেন। 

এগুলোর ভিত্তি ও ভেতরের চত্বর তিনি পুনর্নিমাণ করেন‌। পাশাপাশি তিনি শিক্ষাগত উন্নয়ন প্রকল্প ও হাতে নেন। তিনি ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে কুদসের গভর্নর আহমেদ রশিদ বে কে “রশিদিয়া স্কুল” প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দিয়েছিলেন। 

প্রিয় পাঠক!‌ সুলতান আব্দুল হামিদের ১৮৭৬ থেকে ১৯০৯ পর্যন্ত তার দীর্ঘ শাসনামলে আমরা তার দুটি টার্গেট লক্ষ্য করেছি। এক—ফিলিস্তিনকে সুরক্ষার জন্য ইহুদিদের বিরুদ্ধে তার শক্ত অবস্থান। 

দুই — ফিলিস্তিনে শিক্ষা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন, নির্মাণ ও সংস্কার, ধর্মীয় স্থাপনার সংস্কার ও সুরক্ষা ইত্যাদি। শেষের দিকে এসে উসমানীয় সাম্রাজ্যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সহ আরো বিভিন্ন রকমের কঠিন সংকটের সম্মুখীন হয়, এরপরও সুলতান আব্দুল হামিদ ইহুদিদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে ছিলেন। 

ফিলিস্তিন রক্ষায় অর্থের লোভ , হুমকি ধামকি কিংবা চোঁখ রাঙ্গানির ভয় করেননি তিনি। তিনি ছিলেন বাতিল শক্তির বিরুদ্ধে আপসহীন এক বাহাদুর সুলতান। সম্প্রতি মাজলুম ফিলিস্তিনবাসী, মাজলুম আকসার জন্য প্রয়োজন আরেক সালাহুদ্দীন, আরেক সুলতান হামিদ! 

তথ্যসূত্র: আলজাজিরা

ফিলিস্তিন সুলতান আব্দুল হামিদ

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম