Logo
Logo
×

অন্যান্য

মিতব্যয় মানুষের জীবনে বরকত ও শান্তির চাবিকাঠি

মুহাম্মদ ছাইফুল্লাহ

মুহাম্মদ ছাইফুল্লাহ

প্রকাশ: ০৫ নভেম্বর ২০২৫, ০৭:৫৪ পিএম

মিতব্যয় মানুষের জীবনে বরকত ও শান্তির চাবিকাঠি

মিতব্যয়। ছবি: সংগৃহীত

মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ভারসাম্য এবং মধ্যপন্থার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয় ইসলাম।  শক্তি, অর্থ, সময় এবং সুযোগ—এ সব কিছুর মধ্যে মিতব্যয়ী হওয়া, অপব্যয় ও অতিরিক্ততা পরিহার করা শুধু দুনিয়াতেই নয়, পরকালেও শান্তি এবং মুক্তি অর্জনের জন্য অপরিহার্য। এ জন্য মানবতার সেবায় সব সময় মিতব্যয় ও মধ্যপন্থাকে আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে ইসলাম।

মধ্যপন্থা ও মিতব্যয়ের তাৎপর্য

ইসলাম ধর্মে জীবনযাত্রার প্রতিটি ক্ষেত্রে মধ্যপন্থা ও মিতব্যয়ের ওপর অত্যধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তার বান্দাদের হুকুম দিয়েছেন, যাতে তারা তাদের সম্পদ, সময় ও শক্তি সঠিকভাবে ব্যবহার করে এবং কোনো কিছুতেই অতিরিক্ততা বা অপচয় না ঘটায়।

মধ্যপন্থা ইসলামের একটি মৌলিক শিক্ষা, যার মাধ্যমে ব্যক্তি শুধু আল্লাহর নির্দেশনা অনুসরণ করে চলতে পারে এবং একে অপরকে ক্ষতিগ্রস্ত করে না বরং সমাজের উপকারে আসে। এটি মানুষের জীবনে আধ্যাত্মিক শান্তি, সামাজিক ভারসাম্য ও দুনিয়া এবং পরকালে সফলতা অর্জনের জন্য অপরিহার্য।

মিতব্যয় শুধু অর্থের সংরক্ষণ নয় বরং এটি ব্যক্তিগত আচরণ ও আধ্যাত্মিক চরিত্রের একটি পরিচায়ক। ইসলামি শিক্ষা অনুসারে, আল্লাহ ব্যয়ের ক্ষেত্রে অপব্যয়, কৃপণতা বা অতিরিক্ত খরচের বিপক্ষে সতর্ক করেছেন। কারণ মিতব্যয়ী জীবনই বরকত আনে এবং একে ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ গুণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আল্লাহ তাআলা তার বান্দাদের মিতব্যয়ী হওয়ার জন্য বারবার তাগিদ দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন-

وَ لَا تَجۡعَلۡ یَدَكَ مَغۡلُوۡلَۃً اِلٰی عُنُقِكَ وَ لَا تَبۡسُطۡهَا كُلَّ الۡبَسۡطِ فَتَقۡعُدَ مَلُوۡمًا مَّحۡسُوۡرًا

‘আর তুমি বদ্ধমুষ্টি হয়ো না এবং একেবারে মুক্তহস্তও হয়ো না; হলে তুমি তিরস্কৃত ও অনুতপ্ত (নিঃস্ব) হয়ে পড়বে।’ (সুরা বনি ইসরাইল: আয়াত ২৯)

এ আয়াত থেকে বুঝা যায়, আল্লাহর নিয়ামতগুলো যদি তার নির্দেশিত পদ্ধতিতে ব্যবহার করা না হয়, তবে মানুষ বিপদ-আপদ, অভাব-অনটনের সম্মুখীন হয় এবং রিজিকের বরকত চলে যায়।  আর যে ব্যক্তি মধ্যপন্থায় থাকে, সে শুধু নিজের জীবনকে সুন্দরভাবে গড়ে তোলে না বরং তার আশপাশের পরিবেশেও শান্তি ও সমৃদ্ধি আনে। তাই মানুষের উচিত, আল্লাহর নিয়ামতসমূহ ব্যবহারের ক্ষেত্রে মধ্যপন্থা অবলম্বন করা, যাতে অপব্যয় ও কৃপণতা পরিহার করা যায় এবং জীবনে শান্তি ও বরকত আসে।

রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর বাণী এবং ইসলামি শিক্ষা অনুযায়ী, মিতব্যয়ী জীবনযাপন মানুষকে দারিদ্র্যের হাত থেকে রক্ষা করে এবং এটি আল্লাহর বরকত অর্জনের এক গুরুত্বপূর্ণ উপায়।  তিনি বলেছেন-

‘যে ব্যক্তি পরিমিত ব্যয় করে, সে নিঃস্ব হয় না।’ (মুসনাদে আহমাদ: ৭/৩০৩)। 

মধ্যপন্থা ও মিতব্যয়ী হওয়ার মাধ্যমে ব্যক্তি অতিরিক্ত খরচ, আর্থিক সংকট, দারিদ্র্য এবং সামাজিক অস্থিরতা থেকে মুক্ত থাকতে পারে। উপরন্তু, এটি পরকালেও আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পুরস্কার লাভের পথ সুগম করে।

অপব্যয়ের ক্ষতিকর প্রভাব

অপব্যয় শুধু আর্থিক দিকেই ক্ষতি সৃষ্টি করে না, বরং এর মাধ্যমে মানুষের রিজিকের বরকতও চলে যায়।  আল্লাহ তাআলা বলেছেন-

یٰبَنِیۡۤ اٰدَمَ خُذُوۡا زِیۡنَتَكُمۡ عِنۡدَ كُلِّ مَسۡجِدٍ وَّ كُلُوۡا وَ اشۡرَبُوۡا وَ لَا تُسۡرِفُوۡا ۚ اِنَّهٗ لَا یُحِبُّ الۡمُسۡرِفِیۡنَ

‘হে আদম সন্তান! প্রত্যেক সালাতের সময় সুন্দর পোশাক পরিচ্ছদ গ্রহণ কর, আর খাও এবং পান কর। তবে অপব্যয় ও অমিতাচার করবে না, নিশ্চয়ই আল্লাহ অপব্যয়কারীদের ভালোবাসেন না।’ (সুরা আরাফ: আয়াত ৩১) 

রাসূলুল্লাহ (সা.)ও নিজ জীবনযাপনে অপব্যয়ের বিরুদ্ধে কঠোর ছিলেন।  একবার তিনি সাদ (রা.)-কে অজুর মধ্যে অতিরিক্ত পানি ব্যবহার করতে দেখে প্রশ্ন করেছিলেন-

مَا هَذَا السَّرَفُ ‏"‏ فَقَالَ أَفِي الْوُضُوءِ إِسْرَافٌ قَالَ ‏"‏ نَعَمْ وَإِنْ كُنْتَ عَلَى نَهَرٍ جَارٍ‏"‏

‘হে সাদ! অপচয় করছ কেন?’ সাদ (রা.) বলেছেন, ‘অজুতে কি অপচয় হয়?’ তখন নবী (সা.) বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ, প্রবহমান নদীতে বসেও যদি তুমি অতিরিক্ত পানি ব্যবহার করো, তা অপচয়।’ (ইবনে মাজাহ ৪২৫)

মিতব্যয়ী জীবন: দারিদ্র্য মুক্তির উপায়

যারা উপার্জন ও ব্যয়ে পরিমিতবোধের চর্চা করবে, তারা কখনো অভাবগ্রস্ত হবে না। রাসুল (সা.) হাদিসে পরিষ্কারভাবে বলেছেন, যারা মিতব্যয়ী জীবনযাপন করেন, তারা কখনো দারিদ্র্যের মুখোমুখি হন না।  হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে তিনি বলেন- ‘যে ব্যক্তি পরিমিত ব্যয় করে, সে নিঃস্ব হয় না।’ (মুসনাদে আহমাদ ৭/৩০৩)

আল্লাহর পছন্দ ও অপছন্দ

অনেক সময় আমরা খরচের ক্ষেত্রে হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি, লোকদেখানো খরচ করি, যা পরকালে কোনো লাভ বয়ে আনে না।  হাদিসে এসেছে-

‘আল্লাহ আমাদের তিনটি বিষয় পছন্দ করেন—তার ইবাদত করা, তার সঙ্গে কাউকে অংশীদার না করা এবং ঐক্যবদ্ধ থাকা। অন্যদিকে, তিনটি বিষয় অপছন্দ করেন— অহেতুক কথা বলা, অহেতুক প্রশ্ন করা এবং অনর্থক সম্পদ বিনষ্ট করা। ’(মুসলিম ১৭১৫)

অতএব, আমাদের দৈনন্দিন জীবনে মিতব্যয়ী হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।  বাবা-মা, ভাইবোন ও স্ত্রী-সন্তানদের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যয় করা উচিত, তবে খেয়াল রাখতে হবে যেন কোনো অনর্থক খরচ না হয়।  কেননা আল্লাহ তাআলা বলেছেন-

اِنَّ الۡمُبَذِّرِیۡنَ كَانُوۡۤا اِخۡوَانَ الشَّیٰطِیۡنِ ؕ وَ كَانَ الشَّیۡطٰنُ لِرَبِّهٖ كَفُوۡرًا

‘নিশ্চয়ই অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই। আর শয়তান নিজ প্রতিপালকের প্রতি ঘোর অকৃতজ্ঞ।’ (সুরা বনি ইসরাইল: আয়াত ২৭)

আসুন, আমরা সবাই ইসলামিক আদর্শে মিতব্যয়ী জীবনযাপন করি।  আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি।  দুনিয়ার জীবনে শান্তি ও বরকত অর্জন করি। মিতব্যয়ী হয়ে  পরকালেও শান্তি এবং মুক্তি অর্জনের জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম